skip to Main Content

এডিটরস কলাম I বর্ষবরণের নতুন প্রত্যয়

যত দীর্ঘ হোক রাত, দিগন্তে আলোর রেখা আসবেই। এই বন্দিদশা থেকে আমাদের মুক্তি ঘটবে। আবার কর্মচাঞ্চল্যে ভরে উঠবে পৃথিবী

কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির বঙ্গদেশে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে বাংলা নববর্ষের প্রবর্তন করা হয় ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে- এটা আমরা জানি। ইতিহাস কৃতিত্বটা মোগল সম্রাট আকবরকে দিলেও এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠা বাঙালিকেই করতে হয়েছে। একটা জাতির নিজস্ব কালপঞ্জি- আত্মপরিচয়ের অংশ হিসেবে এটা কম গৌরবের বিষয় নয়। বাংলা ভাষা, বাংলা বছর, বাংলাদেশ একই সূত্রে গাঁথা। সে জন্য বাঙালিকে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। ১৯৫৪ সালের পূর্ববাংলার সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগ উৎখাত হয়ে যাওয়ার পরই শুধু যুক্তফ্রন্ট সরকার ও তার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে বাঙালির জাতিগঠন ও জাতীয়তাবাদের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা নির্দেশ করেন এবং সে বছর বিপুল উৎসাহে নববর্ষ উদযাপিত হয়েছিল।

পৃথিবীতে প্রচলিত অধিকাংশ বর্ষপঞ্জির উৎপত্তি কোনো না কোনো ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাংলা নববর্ষে সে ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। কৃষিকাজ ও খাজনা সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তাই এর প্রচলনকে অনিবার্য করে তুলেছে। পরে এতে যুক্ত হয়েছে ব্যবসায়িক বিনিময়ের হিসাব-নিকাশ। এখন পয়লা বৈশাখ বাঙালির সংস্কৃতির অংশ। আনন্দ যাপনের সামাজিক উপলক্ষ। সম্প্রদায়-শ্রেণি-পেশা-বয়সনির্বিশেষে বাংলা ভূ-খন্ডের সব মানুষের প্রাণের উৎসব।


কিন্তু এই উৎসব এবার আমরা কীভাবে উদযাপন করতে পারি? প্রশ্নটি এই কারণে যে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী মহামারির রূপ নিয়েছে, গ্রাস করছে বাংলাদেশের একের পর এক জনপদ, আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন। একে প্রতিরোধের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছে, তাতে বিশেষভাবে জোর দেওয়া হয়েছে ব্যক্তিগত ও সামাজিক দূরত্বের ওপর। ফলে, সারা পৃথিবীর মতোই বাংলাদেশেও জনসমাগম বন্ধ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমও স্থগিত করা হয়েছে। এমনকি, বাড়িতে বা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আত্মীয়কে দেখতে যাওয়াও নিরাপদ বলে ভাবা হচ্ছে না। বাস্তবিক, উৎসবের চেয়ে আত্মরক্ষাই এখন প্রধান বিবেচ্য হয়ে উঠেছে। তাহলে কি এবার উদযাপিত হবে না বাঙালির বর্ষবরণ? মোটেই নয়। কেবল উদযাপনের ধরনটা পাল্টাতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ মেনে আমরা তা করতে পারি। চারদেয়ালের মধ্যে যেভাবে আছি, সেভাবেই- যা কিছু আছে আমাদের, সেসব নিয়ে। দৃশ্যমান সমাগমের চেয়ে প্রাণের অদৃশ্য বন্ধন এবারের বর্ষবরণে বাঙালির পাথেয় হোক।


করোনাভাইরাসের কবলে পড়ে পৃথিবী আজ বিপন্ন। উন্নত দেশগুলো পর্যন্ত এই দুর্যোগ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। প্রাণহানির বিপুলতা যেমন এড়ানো দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে, তেমনি অর্থনীতিতেও নেমে এসেছে ঘোরতর বিপর্যয়। বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশও এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সেগুলোর একটি হলো, সম্ভাব্য অর্থনৈতিক স্থবিরতা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী-ঘোষিত বিপুল অঙ্কের আর্থিক প্রণোদনা। যার পরিমাণ ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। খাদ্য উৎপাদনে গতিশীলতা বজায় রাখতে কৃষি খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনাও দেওয়া হচ্ছে। অনেকেরই ধারণা, এই মহামারি বিশ্ববাসীকে যে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ফেলবে, তা কাটিয়ে উঠতে কমপক্ষে দুই বছর লাগবে। কিন্তু সেজন্য চাই যথাযথ প্রস্তুতি ও সময়োচিত পদক্ষেপ। বোধ করি, এ ক্ষেত্রে আমাদের সরকার দেরি করেনি। কিন্তু দেশে নানামুখী শিল্প-বাণিজ্যের পাশাপাশি সৌন্দর্যসেবা খাতও রয়েছে, যেখানে কর্মীর সংখ্যার বিপুলতা উপেক্ষণীয় নয়। করোনাকালীন বিপর্যয়ের মধ্যে কেবল ব্যক্তিগত বা বেসরকারি চেষ্টায় একে টিকিয়ে রাখা এবং পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব। এ ব্যাপারে সরকারের সুনজর প্রত্যাশা করি।


যত দীর্ঘ হোক রাত, দিগন্তে আলোর রেখা আসবেই। এই বন্দিদশা থেকে আমাদের মুক্তি ঘটবে। আবার কর্মচাঞ্চল্যে ভরে উঠবে পৃথিবী। কিন্তু এই অপেক্ষা যেন প্রলম্বিত না হয়। সে জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে। জীবনধারায় আরও পরিচ্ছন্নতা আনতে হবে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, পেশাগত- সব ক্ষেত্রেই। মনে রাখা দরকার, আমাদের প্রত্যেকের প্রাণ অশেষ মূল্যবান এবং জীবন কখনো কোনোভাবে অপচয়ের বস্তু হতে পারে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top