ফিচার I রোজার বৈচিত্র্য
রোজার মাসে অভুক্ত থাকার সময়-হিসাবে যেমন বৈচিত্র্য আছে পৃথিবীতে, তেমনি দেশভেদে ইফতারেও রয়েছে ভিন্নতা
দেশে দেশে দিন-রাতের সময়ের হিসাব ভিন্ন। এমনও এলাকা আছে, যেখানে মাত্র ৫৫ মিনিটের জন্য সূর্যাস্ত হয়। পৃথিবীর আহ্নিক ও বার্ষিক গতির কারণে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময়ের তারতম্য ঘটে। ফলে একই রোজায় কোনো অঞ্চলের মানুষ অভুক্ত থাকে ৯ ঘণ্টা, কোনো স্থানে ২৩ ঘণ্টা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রোজা থাকার সময়ের দৈর্ঘ্য লক্ষ করলেই এই বৈচিত্র্য বোঝা যায়। কেননা, রোজার শুরু সূর্যোদয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও সূর্যাস্তের সঙ্গে ইফতারের যোগ রয়েছে।
সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রোজা রাখতে হয় উত্তর গোলার্ধের বাসিন্দাদের। ২০ থেকে ২৩ ঘণ্টা। আইসল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডে খুব অল্প সময়ের জন্যই সূর্যাস্ত হয়। সেখানে রাত হয় মাত্র ৫৫ মিনিটের জন্য। সন্ধ্যা হয় ১২টা ৪৫ মিনিটে এবং সূর্যোদয় ঘটে ১টা ৩০-এ। ফিনল্যান্ডের উলু শহরের বাসিন্দারা ২৩ ঘণ্টা রোজা রাখেন। দেশটির অন্যান্য অঞ্চলে ২২ ঘণ্টা রোজা রাখতে হয়। এত দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা কষ্টসাধ্য হওয়ায় সেখানকার ইসলামিক স্কলাররা মত দিয়েছেন প্রতিবেশী মুসলিম দেশের রীতি অনুসরণ করতে। কিন্তু সেখানকার মুসলমানরা তা সত্ত্বেও দীর্ঘ ২৩ ঘণ্টা রোজা রাখেন। তারা ইফতার ও সেহরি করার জন্য সময় পান মোটে ৪৫ মিনিট। ল্যাপল্যান্ড অঞ্চলেও এ রকম দীর্ঘ সময় রোজা রাখার চল রয়েছে।
আইসল্যান্ড ও গ্রিনল্যান্ডের মুসলমানদের জন্য এই সময় প্রায় ২২ ঘণ্টা। রাত দুইটায় সেহরি করে ঘুমান তারা। তারপর সকাল হয়; পুরো দিন গিয়ে রাত ১২টায় ইফতার করেন। সুইডেনে রোজা রাখার সময় কিছুটা কম, ২০ ঘণ্টা। কিন্তু গ্রীষ্মকালে সেটাও বেশ কষ্টের হয় সে দেশের মুসলিমদের জন্য। যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, ডেনমার্ক, বেলারুশ, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, কাজাকিস্তান, বেলজিয়াম, চেক রিপাবলিক, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরির মুসলমানরা ১৯ ঘণ্টা রোজা রাখেন।
এ ছাড়া আলাস্কার ফেয়ারব্যাংকসে ১৯ ঘণ্টা ১৭ মিনিট, অ্যাংকারিজে ১৮ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট, স্কটল্যান্ডের এডেনবার্গে ১৮ ঘণ্টা ১২ মিনিট, ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডনে ১৭ ঘণ্টা ৫১ মিনিট, জার্মানির বার্লিনে ১৭ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট, কানাডার টরন্টোয় ১৫ ঘণ্টা ৫৮ মিনিট, ওয়াশিংটনের সিয়াটলে ১৬ ঘণ্টা ৩১ মিনিট, ইতালির রোমে ১৫ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট, গ্রিসের অ্যাথেন্সে ১৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট, ইরানের তেহরানে ১৫ ঘণ্টা ২৬ মিনিট, ইরাকের বাগদাদে ১৫ ঘণ্টা ১৪ মিনিট, লেবাননের বৈরুতে ১৫ ঘণ্টা ১৬ মিনিট, ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে ১৫ ঘণ্টা ০৬ মিনিট, মিসরের কায়রোতে ১৫ ঘণ্টা ০৬ মিনিট, পেরুর লিমায় ১৫ ঘণ্টা ৪২ মিনিট, আমেরিকার নিউইয়র্কে ১৫ ঘণ্টা ৩৮ মিনিট, আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে ১৫ ঘণ্টা ০১ মিনিট, রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় ১৬ ঘণ্টা ২৩ মিনিট রোজা থাকতে হয়।
কম সময় রোজা রাখার দেশও আছে। আর্জেন্টিনায় মাত্র সাড়ে ৯ ঘণ্টা। অস্ট্রেলিয়ায় ১০, ব্রাজিলে ১১, মিসরে প্রায় ১৬, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনে ১৫, কুয়েত, ইরাক, জর্ডান, আলজেরিয়া, মরক্কো, লিবিয়া ও সুদানে ১৪, কাতারে ১৪ ঘণ্টা ৪০ মিনিট; এশিয়ার পাকিস্তানে প্রায় ১৫ ঘণ্টা এবং ভারতীয় মুসলমানরা ১৪ ঘণ্টা ১৬ মিনিট রোজা রাখেন। এ ছাড়া ফিলিপাইনে সোয়া ১৪ ঘণ্টা, মালয়েশিয়ায় ১৩ ঘণ্টা ৪০ মিনিট, ফ্রান্সে ১৭ ঘণ্টা ১১ মিনিট, ইতালিতে ১৭ ঘণ্টা, সিঙ্গাপুরে ১৩ ঘণ্টা ৩৪ মিনিট, কানাডায় পৌনে ১৫ ঘণ্টা এবং কেনিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় সোয়া ১৩ ঘণ্টা রোজা রাখতে হয়।
এটিকে কেন্দ্র করে মুসলিম দেশগুলোতে আজকাল ইফতার ও সেহরির বৈচিত্র্যপূর্ণ কিছু সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। কিছু লোকাচার আবার বেশ পুরোনো। যেমন মিসরীয় তরুণেরা ক্যাফে ও রেস্তোরাঁতেই ইফতার করতে অভ্যস্ত। রমজান মাসে রাতে তারা ঘরে বাতি জ্বালায় এবং বাইরে ফানুস ওড়ায়। তুরস্কে সেহরির সময় অলিগলিতে ড্রাম বাজিয়ে ও গান গেয়ে মানুষের ঘুম ভাঙানো হয়। সেহরি ও ইফতারে অনেক সময় কামানের গোলার শব্দ শোনা যায় দেশটিতে। মসজিদের পাশে মাসব্যাপী চলে বইমেলা ও কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতা। তুর্কির মুসলমানরা খেজুরের পরিবর্তে জলপাই খেয়ে ইফতার শুরু করেন। মালয়েশিয়ানরা রোজার আগমনে সাইরেন বাজান। একে অন্যকে ‘শাহরুন মোবারাকুন’ বলে অভিবাদন জানান। উপহার বিনিময় করেন। তারাবিহর শেষে শিক্ষামূলক আসর বসে সে দেশের মসজিদগুলোতে। রোজার মাসে ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোয় এ ধরনের আরও অনেক সংস্কৃতির দেখা মেলে। বৈচিত্র্য থাকে তাদের সেহরি ও ইফতারের খাবারের তালিকায়। যেমন সৌদি আরবে ইফতারে কুনাফাসহ নানা ধরনের খাবার থাকে। তারা সাম্বুচা খায়, যেটি আমাদের দেশের সমুচার মতোই। ভেতরে থাকে মাংসের কিমা। এ ছাড়া স্যালাড, স্যুপ, দই, লাবাং, খবুজ ও তমিজ নামের রুটি থাকে। খেজুর তো খায়ই। দুবাইয়ে খাওয়া হয় রুটি ও ভেড়ার মাংসে তৈরি চপ। সঙ্গে থাকে মসুর ডালের স্যুপ ও স্যালাড। এই ডিশকে একসঙ্গে ‘মেজে’ বলে। সৌদির মতো মিসরেও কুনাফা খাওয়ার রীতি আছে। পাশাপাশি কাতায়েফও খায়। ইফতারে মিতব্যয়িতার পরিচয় দেয় ইরানিরা। তাদের আয়োজনে বেশি কিছু থাকে নাÑ রুটি, পনির, মিষ্টি, খেজুর ও হালুয়া। মস্কোর মুসলমানরা ফলাহার করে। পাশাপাশি স্যুপ, রুটি ও কাভাসকে নামের পানীয় পান করে। সিরিয়ান ইফতারির পদ হালুয়া। পরে তারা দিজাজ, সয়াইয়া, খবুজ, সরবা নামের খাবার খায়। পাকিস্তানিদের থালায় থাকে চিকেন রোল, স্প্রিং রোল, শামি কাবাব। এ ছাড়া কিছু ফলের স্যালাডের পাশাপাশি মিষ্টি ও ঝালজাতীয় খাদ্য, জিলাপি, সমুচা, নিমকি থাকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের একেক অঞ্চলের ইফতার একেক রকমের হয়। যেমন হায়দরাবাদে হালিম, তামিলনাড়ু ও কেরালায় ননবো কাঞ্জি। পাশাপাশি থাকে বন্ডা ও পাকোড়া। ব্রিটেনে খেজুর, ফল, স্যুপ, জুস, রুটি, ডিম, মাংস, চা-কফি ইত্যাদি খাওয়া হয়। ইতালিতে চলে বার্গারজাতীয় খাদ্য এবং নানা রকম ফল। তুর্কিরা ‘রমজান কিবাবি’ নামের একটি বিশেষ কাবাব দিয়ে ইফতার করে। মার্কিন মুসলিমদের তালিকায় থাকে খেজুর, খুরমা, স্যালাড, পনির, রুটি, ডিম, মাংস, ইয়োগার্ট, হট বিনস, সুুপ ও চা। এই পদগুলো চলে কানাডাতেও। অস্ট্রেলিয়ানরা খায় স্যান্ডউইচ, পনির, মাখন, দুধজাতীয় খাবার, নানা প্রকার ফল। দক্ষিণ কোরিয়ায় নুডলস, স্যুপ, ফলের রস। পর্তুগিজরা পাস্টার দি নাতা খায়। এটি এক প্রকার কেক। সারডিন মাছের কোপ্তাও থাকে। এ ছাড়া প্রেগোরোজ, ট্রিনচেডো, প্রাউজ স্প্রিং গ্রিল ও স্যুপ খায় তারা। জাপানে মাশি মালফুফ চলে। এটি আঙুর, বাঁধাকপির পাতা ও চাল মিশিয়ে বানানো হয়। মটরশুঁটি ও গরুর কলিজা দিয়ে তৈরি কিবদাও থাকে জাপানি মুসলিমদের ইফতারে। মালয়েশিয়ানরা আখের রস ও সয়াবিন মিল্ক খায়। এ ছাড়া লেমাক লাঞ্জা, আয়াম পেরিক, নাসি আয়াম, পপিয়া বানাস নামের বিশেষ খাবারগুলো তৈরি হয় ইফতারের জন্য। স্প্যানিশরা শরমা, ডোনার কাবাব, হামাস খায়। পাশাপাশি থাকে লাম্ব কোফতা, আলা তুরকা, পাইন অ্যাপেল ও টমেটো স্যালাড।
আমাদের দেশেও ইফতারের বৈচিত্র্য আছে। রাজধানীবাসী চকবাজারের ইফতারের প্রাচুর্য সম্পর্কে জানেন। গ্রামাঞ্চলে অবশ্য জাউ ভাত কিংবা খিচুড়ি দিয়ে ইফতার করার রেওয়াজ আছে। কোথাও কোথাও চিড়া-গুড়ও চলে।
❙ ফুড ডেস্ক