ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I বনেদি পোশাক
ওত কতুর সবার জন্য নয়। ফলে এর ডিজাইনার এবং ব্র্যান্ডও হাতে গোনা। দামি, জমকালো আর বিরল এই পরিধেয়র গল্প লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
ওত কতুর হচ্ছে অভিজাতদের ফ্যাশন। প্রতিবছরের জানুয়ারি ও জুলাই মাসে প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় এই পোশাকের জমকালো প্রদর্শনী। সবাই ফ্যাশন ডিজাইনার, তবে কেউ কেউ ওত কতুরের। হাতে গোনা কয়েকজন এবং কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এই পোশাক তৈরি করে থাকে। ফ্যাশন বিশ্বে ওত কতুর ডিজাইনার হতে পারা একটি বিশেষ মর্যাদার বিষয়।
ওত কতুরের অর্থ ‘হাই সুইং’ বা ‘হাই ফ্যাশন’। এগুলো সাধারণত অত্যন্ত দামি এবং উচ্চমানসম্পন্ন হয়ে থাকে। কখনো কখনো অস্বাভাবিক ফ্যাব্রিক দিয়ে, বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে সম্পূর্ণ হাতে তৈরি করা হয়। এর আরেক মানে পোশাকটি নির্দিষ্ট ডিজাইনে তৈরি হয় একজনের জন্যই। এ ধরনের পোশাক তৈরিতে প্রচুর অর্থ, শ্রম, সময় ও দক্ষতার প্রয়োজন হয়। একটি পোশাক বানাতে কারিগরেরা ৭০০ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় পর্যন্ত কাজ করে থাকেন।
প্যারিস ছাড়া বিশ্বের আর কোথাও ওত কতুর পোশাকের প্রদর্শনী হয় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় একবার চেষ্টা করা হয়েছিল এটিকে বার্লিনে নিয়ে যাওয়ার। তবে সে সময়ের লে শম্ব্রে সিন্দিক্যাল দে লা ওত কতুরের প্রেসিডেন্ট লুসিয়েন লেলং পরিকল্পনাটি দৃঢ়তার সঙ্গে ভেস্তে দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘হয় প্যারিস নয়তো কোথাও না’।
সতেরো শতকে রোজ বারটিন নামের একজন মহিলা ফ্যাশন ডিজাইনার ছিলেন। তিনি ফরাসি রানি ম্যারি অ্যান্টোনেটের পোশাক তৈরি করতেন। সে দেশের সংস্কৃতিতে তাকে ফ্যাশন এবং ওত কতুর আনার কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে ওত কতুর বিকাশে সবচেয়ে বড় অবদান চার্লস ফ্রেডরিখ ওয়রথ নামের একজন ইংরেজ ভদ্রলোকের। তিনি ১৮৫৬ সালে ইংল্যান্ডের লিংকনশায়ার থেকে প্যারিসে আসেন। এখানে গ্যাজেলিন নামের একটি কাপড়ের দোকানে তৈরি পোশাক বানিয়ে বিক্রি শুরু করেন। ফলে কাপড় বিক্রির সঙ্গে একেবারে পোশাক তৈরি করিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়। ১৮৫৮ সালে তিনি প্রথম রু দে লা পাইয়ে ‘ওয়রথ এহ বোবারগ’ নামে নিজস্ব একটি বুটিক হাউস খোলেন। ফরাসি অভিজাত মহলের মহিলাদের কাছে তার তৈরি পোশাকের কদর ছিল অনেক। এক অনুষ্ঠানে ওয়রথের ক্রেতা ভ্যালেরি ফিউলের পরনে লাইলাক রঙের সিল্ক কাপড়ে লিলি ফুলের বাহারি ডিজাইনের গাউন দেখে রীতিমতো মুগ্ধ হন তৃতীয় নেপোলিয়নের স্ত্রী প্রিন্সেস ইউজিন। এরপর থেকেই তিনি হয়ে ওঠেন ওয়রথের এক নাম্বার ক্রেতা। প্রিন্সেস ইউজিনের সব পোশাকই ডিজাইন করতেন তিনি। এমন আরও অনেক ভক্ত ছিল তার। এ সময়ে সাধারণ দরজি থেকে ফ্যাশন ডিজাইনার কথাটির প্রচলন। ওয়রথ কেবল ওত কতুর তৈরিতে দক্ষতাই দেখাননি, তিনিই প্রথম ফ্যাশন ডিজাইনার হিসেবে নিজের তৈরি পোশাকের বার্ষিক প্রদর্শনীর আয়োজন করতেন।
১৮৬৮ সালে ওয়রথের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় লে শম্ব্রে সিন্দিক্যাল দে লা ওত কতুর। এটির সুরক্ষাই ছিল প্রতিষ্ঠানটির প্রধান লক্ষ্য। নামটি ফরাসি আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
চাইলেই যে কেউ তার পোশাককে ওত কতুর বলতে পারবে না। এই লেবেল ব্যবহার করতে হলে ডিজাইনার বা ফ্যাশন হাউসকে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়। সেগুলো প্রচলনের কাজ করে লে শম্ব্রে সিন্দিক্যাল দে লা কতুর। ১৯৪৫ সালে নিয়মগুলো পাকাপোক্তভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়। এ সময় কতুর হাউস ছিল ১০৬টি।
ওত কতুরের মর্যাদা অর্জন করতে হলে তিনটি শর্ত মানতেই হবে। সেগুলো হলো- ডিজাইনারকে অবশ্যই একজন বিশেষ ক্রেতার জন্য এক বা একাধিক ফিটিংসহ মেড টু অর্ডার ড্রেস তৈরি করতে হবে। ডিজাইনারের কমপক্ষে ২০ জন কর্মীসহ একটি অ্যাটেলিয়ের বা ওয়ার্কশপ থাকা জরুরি। সর্বোপরি প্রতিবছরের জানুয়ারি ও জুলাই মাসে নিজেদের কমপক্ষে ৫০টি বা তার বেশি পোশাক প্রদর্শন করতে হবে। এসব শর্ত মানতে পারলেই কেবল একজন ডিজাইনার লাভ করবেন ওত কতুরের মর্যাদাপূর্ণ সদস্যপদ। বর্তমানে শম্ব্রে সিন্দিক্যাল দে লা কতুরের সদস্য সংখ্যা ৪১। তারা তিন ভাগে বিভক্ত। প্রধান, করেসপনডেন্ট (বিদেশি) ও অতিথি সদস্য। ১৬টি ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রধান সদস্য। শ্যানেল, জ্য পল গতিয়ের, ডিওর, জিভাঁশি, জিয়ামবাতিস্তা ভালি, শিয়াপারেল্লি উল্লেখযোগ্য। প্যারিসে এগুলোর এক বা একাধিক ফ্ল্যাগশিপ কতুর হাউস আছে। করেসপনডেন্ট সদস্যদের মধ্যে এলি সাব, ভারসাচি, ফেন্ডি কতুর, জর্জিও আরমানি। রাহুল মিশরা, জুহাইর মুরাদ, রালফ অ্যান্ড রুশোর মতো নামী ব্র্যান্ড আছে অতিথি সদস্য হিসেবে। সিন্দিক্যাল প্রতিবছর পাঁচ থেকে ছয়টি নতুন ব্র্যান্ড আমন্ত্রণ জানায় প্যারিস কতুর উইকে তাদের কালেকশন প্রদর্শনের জন্য। এ ক্ষেত্রে অতিথি সদস্যরা কালেকশনের লেবেল হিসেবে শুধু ‘কতুর’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারে।
এই দুটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান কেবল কতুর উইক আয়োজন করে ক্ষান্ত হয় না। ডিজাইনারদের প্রতিটি পোশাক পাইরেসির হাত থেকে রক্ষা করাও তাদের প্রধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কোনো সদস্যের পোশাক কপি করে কেউ যদি নিজের নামে চালিয়ে দেয় বা পোশাকের লেবেলে ‘ওত কতুর’ শব্দ ব্যবহার করে, তাহলে সেই ব্র্যান্ড বা ডিজাইনারের বিরুদ্ধে মামলা করার ক্ষমতা রাখে প্রতিষ্ঠানটি।
ওত কতুর পোশাকের ক্রেতার সংখ্যা খুব সামান্য। সারা বিশ্বে সাকল্যে ৪ হাজার। মূলত বিভিন্ন দেশের উচ্চ শ্রেণির ফ্যাশনসচেতন মহিলারাই এর ক্রেতা। এখন বেশির ভাগ ক্রেতা আসে চীন, রাশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে। উল্লেখযোগ্য হলেন জর্ডানের রানি রানিয়া, বিলিয়নিয়ার আলেক্সান্ডার লেবেদেভের স্ত্রী এলিনা পারমিনোভা, শেখ হামিদ বিন খলিফা আল থানির দ্বিতীয় স্ত্রী শেখ মোজাহ বিনতে নাসের। তবে ব্রিটিশ সোশ্যালাইট গিনেসের উত্তরসূরি ডাফনে গিনেস প্রতিবছর ফ্যাশন উইক থেকে অন্তত কয়েকটি পোশাক কেনেন। জিভাঁশি ও অ্যালেক্সান্ডার ম্যাককুইনের বাঁধা কাস্টমার তিনি। এমনকি তার সংগ্রহের ওত কতুর কালেকশনের প্রদর্শনী করা হয়েছিল ফ্যাশন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে।
এই উইক ফ্যাশন জগৎ ও সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ধনী ব্যক্তিদের মিলনমেলা। ক্রেতা দেখেই বোঝা যায় ওত কতুর পোশাকের দাম কেমন হবে। দিনের বেলার পোশাক শুরু হয় ১০ হাজার মার্কিন ডলার থেকে। সান্ধ্য পোশাকের দাম ২০ হাজার মার্কিন ডলার বা তার থেকে বেশি। ক্রেতারা চেকবুক হাতে নিয়ে বসেন। পোশাক পছন্দ হলেই সেটা কিনে নেন।
১৯৪৬ সালের দিকে স্বীকৃত ওত কতুর হাউস ছিল ১০৬টি। ১৯৭০ সাল আসতে না-আসতে সেই সংখ্যা হয়ে যায় মাত্র ১৯। কারণ, লে শম্ব্রে সিন্দিক্যাল দে লা ওত কতুরের কঠোর নিয়ম। এ ছাড়া সংখ্যা কমার একটি কারণ হলো ব্যাপক লোকসান। মর্যাদা টিকিয়ে রাখতে ফ্যাশন হাউসগুলোকে প্রচুর অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হয়। হাতে গোনা কিছু ক্রেতার কাছে পোশাক বিক্রি করে সে পরিমাণ মুনাফা তো হয়ই না, বরং অনেক ক্ষেত্রে লোকসানের মুখ দেখতে হয়। তবু ডিজাইনাররা প্রতিবছর নানা কায়দায় বানিয়ে থাকেন নয়নাভিরাম সব ওত কতুর। এই পোশাকের প্রদর্শনী ডিজাইনারদের সৃজনশীলতা প্রকাশের একটি বিশাল ক্ষেত্র। তাই লোকসান যতই হোক, ওত কতুর হাউসগুলো নিজেদের ঐতিহ্য রক্ষার ক্ষেত্রে আপসহীন।
ছবি: ইন্টারনেট