skip to Main Content

ফিচার I মন থেকে মুখশ্রী

মন খারাপের প্রতিক্রিয়া চেহারায়ও দেখা যায়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের সহজ এবং কার্যকর দাওয়াই নিয়ে লিখেছেন জাহেরা শিরীন

মনে যা অনুভূত হয়, তা-ই চেহারায় ফুটে ওঠে। মানসিক অবস্থা ত্বকেও প্রভাব ফেলে। অতিরিক্ত ব্রণ থেকে শুরু করে অকালে বুড়িয়ে যাওয়ার পেছনে এটি বড় কারণ। উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা বা অবসাদের মতো অসুস্থতায় দামি কসমেটিক আর হাইএন্ড স্যালনের ট্রিটমেন্টে সমাধান অনিশ্চিত। সারবে না ত্বকের সমস্যাও।
আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (এপিএ) বেশ কয়েক বছর ধরে গবেষণা করছে সাইকোডার্মাটোলজি নিয়ে। মনের সঙ্গে মুখত্বকের সম্পর্ক বোঝাই এর মূল উদ্দেশ্য। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দিতে শুরু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। প্রমাণ মিলেছে, মানসিক অস্থিরতা ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। দেহের সবচেয়ে বড় এই অংশে রয়েছে ঘর্মগ্রন্থি, রক্তনালি, স্নায়বিক ক্ষুদ্রাংশসহ এমন সব কোষ, যা সরাসরি পরিপাকতন্ত্র ও স্নায়ুতন্ত্রে নিয়ন্ত্রিত হয়। ফলে ত্বক সহজেই আলোড়িত হয় মানসিক অবস্থার মাধ্যমে।
মূলত দুশ্চিন্তা, অবসাদ কিংবা উত্তেজনার ফলে দেহ থেকে প্রাকৃতিকভাবেই একধরনের স্ট্রেস হরমোন নিঃসৃত হয়। কর্টিসল। এটি শরীরকে প্রতিকূল অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সাহায্য করে। এর সামান্য মাত্রা তেমন কোনো প্রভাব না ফেললেও অতিরিক্ত কর্টিসল নিমেষে ত্বকের ক্ষতি করতে পারে। এটি অনিদ্রা ছাড়াও হরমোনের তারতম্য সৃষ্টি করে, যার সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে ত্বকে।
অ্যাকনে বা ব্রণ
ত্বকের প্রদাহজনিত এ সমস্যাগুলোর মূল কারণ অনেকটাই মানসিক। অবসাদ ও দুশ্চিন্তা থেকে দেহে কর্টিসল উৎপাদনের মাত্রা প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে যায়। এটি ত্বকের ঘর্মগ্রন্থিগুলোর স্বাভাবিকতায় প্রভাব ফেলে। ফলে অস্বাভাবিক ঘন আর আঠালো তেল তৈরি শুরু করে গ্রন্থিগুলো। যাতে মৃতকোষ সারাইয়ের কাজ কঠিন হয়, লোমকূপগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এতে ত্বকে ক্ষতিকর জীবাণুর সংক্রমণ বাড়ে। ফলে অ্যাকনে আর ব্রণ দেখা দেয়।
রোজেশিয়া, একজিমা আর সোরাইসিস
কর্টিসল নামের স্ট্রেস হরমোন ত্বকের স্বাভাবিক হায়ালুরনিক অ্যাসিড উৎপাদনে বাধা দেয়। ফলে আর্দ্রতা হারিয়ে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। চুলকানি ছাড়াও দেখা দেয় চামড়া ওঠা খসখসে ভাব। এতে ত্বকে রোজেশিয়া, একজিমা আর সোরাইসিসের মতো সমস্যা সৃষ্টি হয়।
অকালে বুড়িয়ে যাওয়া
স্ট্রেস হরমোন কর্টিসল ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়াকে ত্বরান্বিত করে। বলিরেখা, দাগছোপ বাড়িয়ে দেয়। ফলে উজ্জ্বলতা আর টান টান ভাব কমে আসে। এ হরমোনের ঊর্ধ্বমুখিতা দেহের অ্যান্টিএজিং হরমোন ‘ডিহাইড্রোপিয়ান্ড্রোস্টেরন’ (ডিএইচইএ)-এর উৎপাদনে প্রভাব ফেলে। এ কারণে দুশ্চিন্তা বা অবসাদগ্রস্ত অবস্থায় দামি অ্যান্টিএজিং প্রোডাক্ট ব্যবহারেও আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। এমন অবস্থা হলে কিছু ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন খুব ঘন ঘন ফুটে ওঠে চেহারায়। যেমন চোখ কিংবা কপাল কুঁচকে ফেলা অথবা ঠোঁট চেপে ধরে রাখা। এগুলো চেহারার নির্দিষ্ট এসব অংশে বলিরেখা সৃষ্টি করতে পারে।
শুষ্ক, নিষ্প্রাণ ত্বক
স্ট্রেসের ফলে পানি পানের প্রবণতা কমে যায়। এতে চা, কফি, সফট ড্রিঙ্ক, সোডা, এমনকি অ্যালকোহলেও আসক্তি বাড়ে। ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়। এর প্রভাব পড়ে ত্বকে। আর্দ্রতার অভাব ত্বককে শুষ্ক রুক্ষ ও ম্যাড়ম্যাড়ে করে তোলে। লাবণ্য হারিয়ে যায়।
আন্ডার আই ব্যাগে আক্রান্ত
যেকোনো মানসিক সমস্যা প্রভাব ফেলে স্বাভাবিক ঘুমের নিয়মে। এতে চোখের নিচের পাতায় পানি জমতে শুরু করে। দেখা দেয় পাফি আই প্রবলেম। স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি অবসাদগ্রস্ত আর ক্লান্ত দেখায় চেহারা।
এসব সমস্যা এড়াতে মনের যত্ন নেওয়া জরুরি। পাশাপাশি ত্বকের যত্নও রাখতে হবে। এ জন্য বাড়তি সাবধানতা দরকার।
 দুশ্চিন্তা, অবসাদ বা উত্তেজনা- মনের যেকোনো অসুখে সৃষ্ট ব্রণ সারাইয়ের সবচেয়ে কার্যকর সমাধান ঘুম। প্রথমেই ঠিক করে নিতে হবে এর নিয়ম। কারণ, স্ট্রেস মানেই কম ঘুম। এর ফলে দেহে কর্টিসলের বাড়তি উৎপাদন, যা ব্রণের প্রকোপ বাড়াবে। নিয়মিত খাবার, ব্যায়াম, ইয়োগা, ডিপব্রিদিং এক্সারসাইজ- সর্বোপরি নিজের সঠিক যত্ন নেওয়া শুধু শরীরের জন্য নয়, ত্বকের সুস্থতাতেও জরুরি। নিজেকে ভালো রাখার চর্চা করা চাই নিয়মিত। স্ট্রেস থেকে সৃষ্ট ব্রণ বা অ্যাকনে সারাতে বিউটি বক্সে রাখা দরকার স্যালিসাইলিক অ্যাসিড, বেনজয়েল পারঅক্সাইড আর রেটিনলের মতো উপাদানে তৈরি সৌন্দর্যপণ্য। এগুলোর প্রতিটি ব্রণ নিরাময়ে কার্যকর। স্যালিসাইলিক অ্যাসিড বন্ধ হয়ে যাওয়া লোমকূপ খুলে দেয়। বেনজয়েল পারঅক্সাইড জীবাণুরোধের সঙ্গে প্রদাহ সারাইয়ে সাহায্য করে। রেটিনল ত্বককোষ উৎপাদনের মাত্রা বাড়ায়। ব্যবহার করা যেতে পারে টি ট্রি অয়েল অথবা স্যালিসাইলিক অ্যাসিডযুক্ত পিম্পল প্যাচ কিংবা স্টিকার। ভালো ব্র্যান্ডের অ্যাকনে স্পট ট্রিটমেন্ট ক্রিমও কাজে দেয়।
 স্ট্রেসের ফলে ত্বকে বুড়িয়ে যাওয়ার সমাধানও ঘুম। স্ট্রেস হরমোন কর্টিসলের দৌরাত্ম্য কমাতে পারলেই দেহে বাড়বে অ্যান্টিএজিং হরমোনের উৎপাদন। প্রাকৃতিকভাবেই প্রতিরোধ করা যাবে ত্বকের বুড়িয়ে যাওয়া। এ ছাড়া দুশ্চিন্তা বা উত্তেজনায় অবচেতন মনেই যে হরেক রকম মুখভঙ্গি তৈরি হয়ে যায়, তা রুখতে সচেতনতা দরকার। চর্চার মাধ্যমে কপাল বা চোখ কুঁচকানো ও ঠোঁট চেপে ধরার অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। ক্লিয়ার ফেস টেপ পরে নিয়েও এসব ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
 চোখের চারপাশের ফোলা ভাব কমাতেও টানা আট ঘণ্টার ঘুম দরকার। ঘুম আনতে এক কাপ ক্যাফেইন ফ্রি ক্যামোমাইল চায়ের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। মানসিক অস্থিরতা কমাতে এটি কাজ করে। একটা চামচ ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা হলে তা আলতো করে চেপে ধরা যেতে পারে চোখের ফোলা অংশে। ম্যাসাজও চলতে পারে ইনার থেকে আউটার কর্নারে।
 স্ট্রেসের ফলে ত্বকের শুষ্কতা কমিয়ে, আর্দ্রতা বাড়ানোর উপায় প্রাচীন টোটকা প্রচুর পানি পান। অন্তত আট গ্লাস। বাড়তি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ডোজের জন্য গ্রিন টি চলতে পারে। খেতে হবে উচ্চ মাত্রার পানিযুক্ত ফল ও সবজি। যেমন শসা, টমেটো, বিট ইত্যাদি। এসবে মিলবে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পানি। কুইক হাইড্রেশন ড্রিঙ্কের জন্য নিয়মিত হায়ালুরনিক অ্যাসিডযুক্ত সিরামের ব্যবহার বেশ কার্যকর।

বিশেষজ্ঞদের মত, বিউটি রুটিনের সামান্য হেরফেরে দুশ্চিন্তা, অবসাদ আর উত্তেজনার মতো মানসিক অসুখ সেরে যেতে পারে। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত তেমনি চারটি উপায়-
 নিজেকে নিজে উপহার দেওয়া। হোক কোনো বিশেষ দিনে, কিংবা উপলক্ষ ছাড়াই। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মত, নিজেকে নিজে ভালোবাসার একটু প্রয়াসই পাল্টে দিতে পারে মানসিক অসুস্থতা। মস্তিষ্ক-নিঃসৃত ডোপামিন সরাসরি মুড বুস্ট করতে সহায়তা করে। উপহার হিসেবে নিজের পছন্দের ব্র্যান্ডের কোনো কসমেটিক বেছে নেওয়া যায়। এতে মন ভালো থাকবে।
 নিজের লুক নিয়ে নিরীক্ষা। ছোটখাটো নয় বরং দুঃসাহসিক কোনো পরিবর্তন। যেমন কোমর পেরোনো বড় চুল ববে ছেঁটে ফেলা কিংবা চুলের রঙ পাল্টানো। এতে বাইরে থেকে যেমন বদল ঘটবে, পাল্টে যেতে পারে ভেতরটাও। মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মত, পছন্দসই পরিবর্তন মানুষের মনে ইতিবাচক সাড়া তৈরি করে।
 নিজের প্রতি মনোযোগ। মুখে দাগছোপ, ব্রণ অথবা মানুষের অযাচিত কথা পেছনে ফেলে নিজেকে ভালোবাসতে হবে সব সময়। তবেই স্ট্রেসকে সরিয়ে পরিপূর্ণ যত্ন নেওয়া যাবে। চেহারায় ফিরবে স্বাভাবিক সৌন্দর্য।
 দরকার খানিকটা ব্যক্তিগত সময়। শুধু নিজের জন্য। প্রতি মাসে নিয়ম করে। ম্যানিকিওর-পেডিকিওর, ফেশিয়াল এবং খানিকটা সময় স্পাতে কাটানো। এগুলো মনের অসুখের কার্যকর দাওয়াই। সঙ্গে নিজের সৌন্দর্য শাণিয়ে নেওয়ারও চমৎকার উপায়।
মডেল: আয়শা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top