ফিচার I অলটারনেটিভ লাইফস্টাইল
কফি হাউসের আড্ডাটি সত্যিকার অর্থেই আজ আর নেই। তবে একধরনের পারিবারিক ও সামাজিক মিথস্ক্রিয়া তো ঘটছেই। করোনাভাইরাসের কবলে পড়া মানুষের নতুন এক জীবনধারার বদৌলতে। লিখেছেন মনীষা উজ্জ্বয়িনী
করোনাভাইরাসের বিস্তার বদলে দিয়েছে আমাদের জীবনধারা। প্রতিদিনের রুটিনমাফিক কাজের ধরন পাল্টেছে। পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যেও এসেছে আন্তরিকতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ শেয়ারিং। এতে মানুষের ছকে বাঁধা জীবনের চিরায়ত ধারায় পরিবর্তন ঘটেছে।
জীবনযাপনে পরিবর্তনের একটি বড় সূচক হলো নারী ও পুরুষের প্রতিদিনের কাজের ধরনে। বহু শতাব্দী ধরে পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতি মনে করে এসেছে, পুরুষের জন্য বাইরের পৃথিবী, আর নারী ঘরের অলংকার। গৃহকর্মে নারীর অংশগ্রহণই মুখ্য- চিরাচরিত এই ধারণা করোনা পরিস্থিতির কারণে পাল্টে গেছে।
নারী একাই গৃহের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করবে, এতে পুরুষের সহযোগিতা থাকবে না- এ কেমন করে হয়? এই উপলব্ধি থেকে দিনমান আলস্যে না কাটিয়ে পুরুষ গৃহকর্মে অংশগ্রহণ করছে। যেহেতু অনেক বাসাবাড়িতেই গৃহসহকর্মীকে ছুটি দিতে হয়েছে, এ কারণে পরিবারের পুরুষ সদস্য রান্নায় সহযোগিতা, নিজের কাপড়চোপড় ধোয়া, বাথরুম পরিষ্কার, বারান্দা বা ছাদবাগানে গাছের পরিচর্যা, এমনকি ঘর ঝাড়– দেওয়া ও মোছার কাজটিও করছে। নারীর জন্য ‘নির্দিষ্ট কাজগুলো’ যে পুরুষেরও, অনেকেরই সেই বোধোদয় হয়েছে। এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পারিবারিক এসব কাজে অংশগ্রহণের ফলে তাদের জীবনযাপনে পরিবর্তন এসেছে। মানুষের মনোজগতের এই রূপান্তর কেবল পরিবার নয়, সমাজেও গভীর প্রভাব ফেলছে। এতে সৃষ্টি হয়েছে পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব, সহমর্মিতা, অন্যকে শ্রদ্ধা ও মমতার সংস্কৃতি।
কিছুদিন আগেও কর্মব্যস্ত জীবনে বাড়তি সময় বের করা ছিল কঠিন একটা ব্যাপার। অবসরপ্রাপ্ত বয়স্কদের কথা অবশ্য আলাদা। তবু তাদের পারিবারিক কিছু দায়িত্ব পালন করতে হতো। যেমন বাজার করা, নাতি-নাতনিদের স্কুলে আনা-নেওয়া, নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে যাওয়া ইত্যাদি। এর বাইরে প্রায় সব বয়সের মানুষ নিয়ম করে কাজের ফাঁকে প্রতিদিন বা সপ্তাহের নির্দিষ্ট কিছু সময় ব্যয় করত শরীরচর্চায়। সকালে বা বিকেলে হাঁটতে বের হওয়া, জগিং একটি অভ্যাস। এটি শহরের অত্যন্ত পরিচিত দৃশ্য।
কেউ কেউ জিমেও যেত। কিন্তু এখন লকডাউনের ফলে এই দৃশ্য এখন আর নেই। মানুষ বাইরের মুক্ত বাতাসে হাঁটতে যাওয়ার কাজটি সেরে নিচ্ছে ঘরে বা বাড়ির ছাদে। সামর্থ্যবানেরা ব্যবহার করছে ট্রেডমিল। আবার হাঁটার উপযুক্ত স্থানের অভাবে অনেকেই এটি বাদ দিয়ে হালকা শরীরচর্চা, ব্রিদিং, প্রাণায়াম করে বাড়িয়ে নিচ্ছে ইমিউনিটি। অনেকে আলস্য বা সময়ের অভাবে শরীরচর্চা করত না, তারাও এখন এটি করছে বিভিন্ন শারীরবিদ বা চিকিৎসকের অনলাইন টিউটোরিয়াল দেখে। যাদের নিয়মিত ধূমপানের অভ্যাস ছিল, বাইরে যাওয়ার বিধিনিষেধ এবং দোকান বন্ধ থাকায় তাদের অনেকেই এটি বাদ দিয়েছেন। এসবই লাইফস্টাইলে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।
তবে প্রতিটি পরিবারের কোনো না কোনো সদস্যকে ঘরের বাইরে যেতে হচ্ছে বাজার করা, ওষুধ কেনা ইত্যাদি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজে। আগে অনেকেই নিজের কাজটি দ্রুত সেরে নেওয়াকে প্রাধান্য দিতেন। অন্যের ব্যস্ততা বা প্রয়োজন গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এখন মানুষের জীবনে নতুন শৃঙ্খলার চর্চা চলছে। শপিং মলে, ব্যাংকে, ফার্মেসিতে অথবা পাড়া-মহল্লার মুদিদোকানগুলোতেও সবাই দূরত্ব বজায় রেখে ধারাক্রম বা লাইন মেনে চলতে চেষ্টা করছে।
পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ছুটিতে অথবা কারও জন্মদিন বা অন্য কোনো উপলক্ষে বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়াটা ছিল শহরের মানুষের বিশেষ ট্রেন্ড। তা ছাড়া অনেকে সাহিত্য-আড্ডা, সিনেমা, মঞ্চনাটক বা কোনো সংগীতানুষ্ঠান শেষেও রাতের খাবারটা বাইরে থেকে সেরে নিতেন। এতে প্রতিদিনের একঘেয়ে জীবনে ও খাবারের স্বাদে আসত বৈচিত্র্য। কিন্তু মান্নাদের কফি হাউসের গানের মতো সেই আড্ডাটা আজ আর নেই। তাই বলে জীবনের গতি, আড্ডা, রসনার ভিন্নতা কমে যায়নি। তবে রূপ পাল্টেছে।
এখন ঘরে বসে সবই চলছে। এখন দেখে নেওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি অনলাইন খাবারের রেসিপি। রেস্টুরেন্টের আবহ তৈরি হচ্ছে নিজেদের ডাইনিং স্পেসে অথবা ছাদের খোলা হাওয়ায়। নক্ষত্র ফোটা আকাশের নিচে। কিন্তু এসব আয়োজনের মধ্যে লাইফস্টাইলের পরিবর্তনটি লক্ষ করার মতো। কেননা, রান্নাঘর সামলানোর দায়িত্ব ছিল নারীর, এখন সেখানে পুরুষ ও পরিবারের কনিষ্ঠ সদস্যরাও ভূমিকা রাখছে।
নেটফ্লিক্স, ইউটিউব, হইচইসহ অনেক অনলাইন চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে বিখ্যাত সব সিনেমা। ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, স্কাইপি, জুম ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মে চলছে আড্ডা। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সংগীত, চিত্রকলা, আবৃত্তি- এসবের চর্চা এখন স্থান ও সময়ের দূরত্ব অতিক্রম করে জীবনযাত্রাকে গতিশীল করছে। এখন নিয়ম করে প্রায় প্রত্যেকে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নিজের আগ্রহের বিষয়ে পরস্পর মতবিনিময়, আড্ডা দিচ্ছে। এমনকি, সাহিত্যপ্রেমীদের বইয়ের খোঁজখবরই কেবল নয়, প্রয়োজনীয় বইয়ের পিডিএফ সরবরাহ করছে অনেকেই। এটির জন্য ফেসবুকে আমন্ত্রণ জানালে যিনি বন্ধুতালিকায় নেই এমন অচেনা ব্যক্তিও বইয়ের পিডিএফ লিঙ্ক দিয়ে সহযোগিতা করছেন। ফলে বইপাড়ায় না গিয়েও আড্ডা এবং দরকারি কাজটি সেরে নেওয়া যাচ্ছে সহজেই। এতে রাস্তার যানজটে যে দীর্ঘ সময় অপচয় হতো, সেটি এখন অপঠিত ও গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো পড়া, ছবি আঁকা, গান যা বাদ্যযন্ত্র বাজানো, নাচ কিংবা আবৃত্তির মতো সৃষ্টিশীল কাজে ব্যবহার করার ফলে মানুষের চেতনা ও মননের উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে। মানুষ যত বেশি শিল্প-সাহিত্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের সঙ্গে যুক্ত হবে, তত মানবিক হয়ে উঠবে।
লেখক : কবি
ছবি: ইন্টারনেট