skip to Main Content

ফিচার I সামাজিক দূরত্বেও নিবিড় নৈকট্য

সামাজিক দূরত্বজনিত শূন্যতার চাপ অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। এটি হয়ে উঠেছে অনেক সমস্যা সমাধানের মাধ্যম। লিখেছেন আবু হেনা মোস্তফা এনাম

এ বছরের শুরুতে বিশ্বজুড়ে নভেল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এর উৎস চীনের উহান প্রদেশ। স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এটির বিস্তার রোধের জন্য সোশ্যাল ডিসট্যান্স বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। একদল জাপানি ভাইরোলজিস্টের গবেষণায় দেখা গেছে, সংক্রমিত ব্যক্তির হাঁচি বা কাশিতে মুখ থেকে কয়েক লাখ অতিসূক্ষ্ম ড্রপলেট বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোয় ভাইরাস ঠাসা থাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য, যা কাছাকাছি থাকা ব্যক্তিকে দ্রুত সংক্রমিত করে। এসব কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিকল্প নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, সংক্রমিত ব্যক্তিকে আইসোলেশনে রেখে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে। হাসপাতাল অথবা নিজের বাড়িতেও আক্রান্ত ব্যক্তিকে আলাদা রাখা জরুরি। অনুমিত আক্রান্তদের জন্য ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যেহেতু এখনো এই ভাইরাসজনিত রোগ নিরাময়ের কোনো ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি, তাই এটির সংক্রমণ কমাতে কিংবা প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্বই সবচেয়ে ভালো উপায়। কেননা, এভাবেই পরস্পর স্পর্শ বাঁচিয়ে চলা সম্ভব। তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং-ওয়েন করমর্দনের বদলে হাত ও মুঠোর মাধ্যমে অভিবাদন জানিয়ে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছেন।
কিন্তু মানুষের জীবন ও সমাজ চলমান একটি প্রক্রিয়া। সামাজিক দূরত্ব মেনে সবাই ঘরে বন্দি থাকলেও মূলত সোশ্যাল মিডিয়ার ফলে পাস্পরিক দূরত্ব ঘুচেছে। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জার, স্কাইপি, জুম, ইউটিউবসহ নানান মাধ্যমে যোগাযোগের ক্ষেত্রে আরও নিবিড়তা সৃষ্টি হয়েছে। কিছুদিন আগেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো সম্পর্কে অনেকের নেতিবাচক ধারণা ছিল। সময় এবং মেধার অপচয় মনে করা হতো। এমনকি বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসনে দেশীয় ঐতিহ্য ভুলতে বসেছে বলে প্রশ্ন তুলতেও দেখা গেছে। কিন্তু এখন লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ফলে এসবের ইতিবাচক দিকটি সহজেই অনুভব করা যায়। বিশেষ করে, বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছিল, তা দূর করা সম্ভব হয়েছে। এটি মানুষকে নিঃসঙ্গ হতে দেয়নি, মুক্তি দিয়েছে একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে।
নাগরিক জীবনের কর্মব্যস্ততা, যানজট ইত্যাদি কারণে যে বন্ধু বা প্রিয়জনের সঙ্গে দীর্ঘদিন দেখা করা সম্ভব হয়নি, এখন ঘরবন্দি সময়ে তাদের সঙ্গে সহজেই আড্ডা দেওয়া যাচ্ছে। পারস্পরিক খোঁজখবর নেওয়া, কুশল বিনিময়, এমনকি দীর্ঘদিন দেখা না হওয়া প্রিয়জনের চেহারা এবং ঘরের সব সজ্জা দেখে আনন্দিত হচ্ছে সবাই। গ্রুপ আড্ডা ও লাইভ প্রোগ্রামে সাহিত্য, রাজনীতি, রূপসজ্জা, সিনেমা, চিত্রকলা, পোশাক, রন্ধনশৈলী ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান, মতামত দেওয়ার কাজটিও সহজ হয়েছে। বিভিন্ন দেশের চেনা-জানা শিল্পী-সাহিত্যিক-সংস্কৃতিকর্মী-অ্যাকটিভিস্টদের নিয়ে একত্রে এমন লাইভ আড্ডা এখন বেশ সাড়া ফেলেছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের ও বিদেশের করোনা পরিস্থিতি ও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। অনেকেই চর্চা ছেড়ে দেওয়ার দীর্ঘদিন পর ছবি এঁকে বা গান গেয়ে নিজেদের প্রতিভার নতুন করে বিকাশ ঘটাচ্ছেন। এতে ব্যক্তি নিঃসঙ্গতা কাটিয়ে আত্মোপলব্ধির জগৎ বিস্তৃত করতে পারছে। সমৃদ্ধ হচ্ছে মানুষের মানসিক পুষ্টি। এটি সামাজিক দূরত্ব কাটিয়ে আড্ডাবাজ শিল্প-সাহিত্যসেবীদের পারস্পরিক যোগাযোগে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে।
করোনা পরিস্থিতি এবং এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সংবাদ সহজেই জানা সম্ভব হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এসব খবর মানুষের মধ্যে আতঙ্ক রোধ করে সতর্কতার বোধ জাগিয়ে তুলছে। এমনকি লকডাউনের ফলে দেশজুড়ে দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত মানুষের চলমান খাদ্যসংকট দূর করার জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় সহযোগিতার আহ্বান জানানো হচ্ছে। বাংলাদেশে ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় এভাবে গড়ে উঠেছে অনেক সংগঠন। যারা স্বেচ্ছা শ্রমের ভিত্তিতে রান্না করা এবং শুকনা খাবার সরবরাহ করছে। এই মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টি ও কল্যাণমূলক কাজে আত্মনিবেদিত মানুষের সামাজিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে।
অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় শিশুদের লেখাপড়ায় যে সাময়িক বাধা তৈরি হয়েছিল, তা কাটিয়ে উঠতে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছে শ্রেণিকক্ষের কাজ। এতে সহজেই তারা স্কুলের রুটিন অনুসরণ করতে পারছে। চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরা অনলাইনে সেরে নিচ্ছেন অফিস বা ব্যবসাসংক্রান্ত কাজ। ঘরে বসে এসব কাজের সহজ সমাধান হওয়ায় মানুষের অনেক অবসর মিলেছে। কেননা, এখন আর রাস্তার যানজটে দীর্ঘ সময় অপচয় হচ্ছে না। ফলে সময়টা পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে এখন উপভোগ্য হয়ে উঠছে। চিকিৎসাসেবাও শুরু হয়েছে। বাজার, দরকারি ওষুধ, সৌন্দর্যপণ্য, শরীরচর্চার উপকরণ, পোশাক- সবই এখন ঘরে বসে পাওয়া সম্ভব। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ, বিনোদন বা শিক্ষণীয় প্রসঙ্গ প্রচার করে অর্থনৈতিকভাবেও সমৃদ্ধ হচ্ছেন অনেকেই।
দীর্ঘদিন লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার প্রভাব পড়তে শুরু করেছিল মানুষের মনোজগৎ, দৈনন্দিন জীবন, অর্থনীতি, শিক্ষা ও উন্নয়নমূলক কাজের ওপর। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া এসব দূরত্ব ঘুচিয়ে সমস্যার অনেকটাই সমাধান করেছে। এই প্রক্রিয়ায় মানুষ দ্রুতই পারস্পরিক যোগাযোগহীনতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। সামলে নিয়েছে ভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকের নিঃসঙ্গতার চাপ। নানা উদ্বেগ ও আশঙ্কা সত্ত্বেও জীবন ক্রমশ হয়ে উঠছে গতিশীল ও আনন্দময়।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top