skip to Main Content

ফিচার I আম্রলিপি

আমের জাতের তালিকা দীর্ঘ। এগুলোর বেশির ভাগের নামকরণের ইতিহাস অজানা। হাতে গোনা কয়েকটির উৎপত্তি সম্পর্কে জানা গেছে। সেসবের কথা লিখেছেন শিবলী আহমেদ

ক্ষীরসাপাতি, হিমসাগর, দুধস্বর, কোহিতুর, মধুচুষকী- এগুলো আমের একেকটি জাত। ফলটির দেশি-বিদেশি জাত-পাতের নাম নিয়ে গবেষণা চলছে। কয়েকটির আদি উৎপত্তি সম্পর্কে জানা গেছে। কিছু আমের পরিচয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্যক্তির নাম। স্থান, কোনো বিশেষ ঘটনা বা স্বাদের ভিত্তিতেও এটি নির্ধারিত হয়েছে। যেমন ক্ষীরসাপাতি। ক্ষীরের মতো স্বাদ, তাই এমন নাম। খেয়ে রানিরা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন বলে নাম হয়েছে রানিভোগ। কয়েকটি জাত কাঁচা অবস্থাতেই মিঠা। সেগুলো কাঁচামিঠা। দুধের সঙ্গে খেতে ভালো বলে নাম হয়েছে দুধসাগর আম।

খাওয়ার পদ্ধতিভেদেও নামকরণ হয়েছে। টিপে নরম করে, মাথায় খানিকটা ছিদ্র করে চুষে খাওয়া আমের নাম চোষা। কয়েকটি তো ঘরের বিবিকে পটিয়ে ফেলতে সক্ষম। সেটি ‘বউফুসলানি’ নামে পরিচিত। যে আমের রং ও মিষ্টতা মন কেড়ে নেয়, সেটি মনোহরা। গন্ধ বিচারেও নামকরণ হয়েছে। ময়মনসিংহে একপ্রকার আম ফলে, যেটি রসুনের মতো গন্ধযুক্ত। এটি রসুনে আম। আবার একটি জাত থেকে মেলে গোলাপের সুবাস। এটি গোলাপখাস।

ফজলি আমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক প্রৌঢ় নারীর নাম। ‘ফজলি বিবি’। গৌড়ের এক কুঠিতে ছিল তার বাস। তিনি উঠানে রোপণ করেছিলেন একটি আমগাছ। তখন ১৮০০ সাল। মালদহ জেলার কালেক্টর রাজভেনশ শিবির স্থাপন করেন ওই নারীর বাসস্থানের পাশে। নিজের গাছের আম নিয়ে প্রৌঢ়া দেখা করেছিলেন কালেক্টরের সঙ্গে। সেটি খেয়ে বেশ তৃপ্ত হয়েছিলেন ভদ্রলোক। তিনি সেই আমের নাম জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ফজলি বিবি প্রশ্ন বুঝতে না পেরে নিজের নামটি বলে ফেলেন। তখন থেকেই এটি ফজলি আম। হাঁড়িভাঙ্গা আমের নামকরণের ইতিহাসও নাটকীয়। বালুয়া মাসিমপুর ইউনিয়নে অবস্থিত জমিদারবাড়িতে একটি বাগান ছিল। রাজা তাজ বাহাদুর শিং সেখানে সুগন্ধিযুক্ত ফুল ও ফলের গাছ রোপণ করেছিলেন। সেই বাগানের এক জাতের আম খোরগাছা ইউনিয়নের তেকানী গ্রামের পাইকার নফল উদ্দিনের বদৌলতে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সেগুলো প্রত্যন্ত হাটে বিক্রি করতেন। একটি আম বেশ সুমিষ্ট এবং দেখতে সুন্দর হওয়ায় সেটির কলম এনে নিজ জমিতে রোপণ করেন। তার জমি ছিল বরেন্দ্র প্রকৃতির। শুকনা মৌসুমে গাছের গোড়ায় পানি দেওয়ার সুবিধার্থে তিনি সেখানে একটি হাঁড়ি বসিয়ে জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু কে বা কারা সেই হাঁড়ি ভেঙে ফেললেও গাছটি বেঁচে ছিল। পরে তাতে আম ধরে। সেই আমের স¦াদে বিমোহিত হন স্থানীয় অনেকে। কোথা থেকে এল এই আম? তা খুঁজতে গিয়ে লোকমুখে হাঁড়ি ভেঙে ফেলার ঘটনাটি রটে যায়। এ থেকে নাম হয় হাঁড়িভাঙ্গা।

ল্যাংড়া আমের নামকরণের পেছনে আছে এক ফকিরের গল্প। তার পায়ে সমস্যা ছিল। প্রথমে মোগল আমলে দ্বারভাঙা অঞ্চলে এই আম চাষ হতো। ১৮ শতকে সেই ফকির এটির চাষ করেন। তার মাধ্যমেই ফলটি বিস্তার লাভ করে। ফলে নাম হয় ল্যাংড়া আম। আরও দুটি সুপরিচিত আম হলো লক্ষ্মণভোগ ও গোপালভোগ। ইংরেজ বাজারের চ-ীপুরের বাসিন্দা লক্ষ্মণ ও নরহাট্টার গোপাল ছিলেন আমচাষি। তাদের নামেই আম দুটির পরিচয়।

আকারে ছোট এক প্রকার আম খেয়ে নিজের বাগানে আঁটি রোপণ করেছিলেন মালদহের একজন কৃষক। এটিকে অনেকের কাছে গুটি বলে পরিচিত। এ থেকে জন্মানো জাতটিই গুটি আম নামে প্রসিদ্ধ। এটি আশ্বিনে পাকে বলে একে অনেকে আশ্বিনা নামে চেনে। সাম্প্রতিক কালে আবিষ্কৃত এক জাতের আমের নাম ‘ডায়াবেটিক’। এতে গ্লুকোজের মাত্রা কম হওয়ার ফলেই এমন পরিচিতি। এই আমের আঞ্চলিক নাম আম্রপালি। তবে এটি নিয়ে লোককথা প্রচলিত আছে। ভারতের বহুল পরিচিত নর্তকীর স্মরণে ‘আম্রপালি’র নাম রাখা হয়েছে। জেনে রাখা প্রয়োজন, পালি ভাষায় আম্রকে ‘অম্ব’ বলা হয়। প্রাচীনকালে ভারতের বিহারের বৃজি নামে একটি রাজ্য ছিল। সেটির রাজধানী বৈশালী। সেখানকার রাজোদ্যানে আমগাছের নিচে জন্মেছিল এক কন্যাশিশু। উদ্যানের পালক বাচ্চাটির ভরণপোষণের ভার নেন। পালকের মেয়ে বলে শিশুটির নাম হয়ে যায় অম্বপালি তথা আম্রপালি। তার গড়নে কোনো খুঁত ছিল না। বড় হয়ে সে সভানর্তকী হয়। তিনি গৌতম বুদ্ধের বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে ভিক্ষুসঙ্ঘে যোগ দেন এবং আমবাগান সঙ্ঘকে দান করেন। তাকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৭৮ সালে বিজ্ঞানীরা নীলম জাতের পুংমুকুলের সঙ্গে দুসেহরী আমের স্ত্রীমুকুলের পরাগায়ন ঘটিয়ে যে সংকর আম উদ্ভাবন করেন, সেটির নাম রাখা হয় আম্রপালি।

নাবি জাতের আমের মধ্যে উৎকৃষ্টটির নাম আড়াজাম। আড়া অর্থ বনবাদাড়। বন্য বলে এটির এমন নাম হয়েছে। তবে নামের শেষে ‘জাম’ কীভাবে যুক্ত হলো, তা অজানা। বাবুইঝাঁকি আমের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। এই পাখিগুলোর মতো এ জাতের আমও গাছের ডালে ঝাঁকে ঝাঁকে ঝুলে থাকে। ‘আনোয়ার রাতাউল’ নামের এক প্রকারের আমের আদি নিবাস ভারত। সেখানকার উত্তর প্রদেশে মিরাট অঞ্চলের একটি গ্রাম রাতাউল। জনৈক আনোয়ার বাস করতেন সেখানে। তার বাড়িতেই জন্মেছিল আমের এই জাত।

পাশ্চাত্যের কিছু আমের জাতÑ ইরউইন, কেইট ও কেন্ট। তিনটির উৎপত্তিই ফ্লোরিডায়। ইরউইন নামের ব্যক্তির প্রচেষ্টায় জাতটি আবিষ্কৃত হয়। সেখানকার আরেক বাসিন্দা কেইটের বাড়ি থেকে পাওয়া আমের নাম কেইট ম্যাংগো। এ ছাড়া কেন্ট নামের এক ব্যক্তির বাড়ির গাছের আমের নাম দেওয়া হয় কেন্ট ম্যাংগো। এসব ছাড়া আরও প্রায় ১০ হাজার জাতের আম আছে। সেগুলোর নামকরণের ইতিহাস অজানা।

(এই লেখার তথ্যগুলো মাহবুব সিদ্দিকী রচিত ‘আম’ বই এবং অন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত। আম নিয়ে তিন পর্বের লেখার এটি দ্বিতীয় কিস্তি।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top