ফিচার I ভক্ষণের নৃশংসতা
খাবার তৈরির কিছু কৌশল জানলে গা শিউরে উঠতে পারে। উদরস্থ করতে গিয়ে মানুষ প্রাণীর প্রতি যে নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে, সেটাই হয়ে উঠেছে কোনো কোনো দেশের খাদ্যসংস্কৃতির অংশ। লিখেছেন শিবলী আহমেদ
মুর্শিদাবাদের নবাবদের পছন্দের খাবার ছিল মুর্গ ইয়াখনি। কথিত আছে, পদটি তৈরি করতে মাসখানেক সময় লেগে যেত। কারণ, তা প্রস্তুত করতে ‘ক্রম হত্যা’র মধ্য দিয়ে যেতে হতো রসুইকরদের। প্রথমে আটার সঙ্গে বিষ মিশিয়ে ছোট ছোট ডো তৈরি করতেন তারা। তা খাওয়ানো হতো সদ্য যুবক মোরগকে। বিষক্রিয়ায় মারা যেত সেটি। এরপর এটির মাংস কেটে তা আটায় মিশিয়ে খাওয়ানো হতো আরেকটি মোরগকে। সেটিও ধীর প্রক্রিয়ায় মারা যেত। দ্বিতীয় মোরগের মাংস আটায় মেখে খাওয়ানো হতো তৃতীয়টিকে। সেটির মৃত্যু হতো আরেকটু ধীরগতিতে। এভাবে চলতে চলতে একপর্যায়ে মৃত মোরগের মাংসে বিষের পরিমাণ কমে আসত। ফলে সর্বশেষ মোরগটি মারা না গিয়ে কেবল সেটির পালকগুলো ঝরে পড়ত। শেষ মোরগ দিয়েই তৈরি হতো মুর্গ ইয়াখনি। মানুষের খাবারের জোগান দিতে প্রাণীদের এভাবে মেরে ফেলার দৃষ্টান্ত নতুন কিছু নয়। সেটির শুরু নবাবি আমলে নয়, পশুপালনের যুগ থেকে।
যাযাবরদের পশুপালনযুগে বেয়াড়া ভেড়াদের বেঁচে থাকা অনিশ্চিত ছিল। সেগুলোকে মেরে ফেলা হতো সবার আগে। রুগ্্ণ ও ভগ্নস্বাস্থ্যের ভেড়ীদের বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখা হতো না। পালিত এই প্রাণীর টিকে থাকা নির্ভর করত বংশবিস্তারের ক্ষমতার ওপর। মানুষের কাছে পশুর সুখ বা যন্ত্রণার কোনো গুরুত্ব ছিল না। ষাঁড়, ঘোড়া কিংবা গাধাদের খাটিয়ে নিতে নির্যাতনই ছিল মানুষের একমাত্র আচরণ। কাজে লাগানোর জন্য প্রাণীগুলোর বন্য স্বভাব দূর করা আবশ্যিক ছিল। দড়ি দিয়ে বেঁধে লোহা তাতিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া ছিল পশু বশীকরণের একটি পদ্ধতি। নপুংসককরণ ছিল খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। নিউগিনির রাখালেরা শূকরের নাক কেটে দিত। ফলে প্রাণীটি কিছু শুঁকতে গেলে আঘাত পেত। শূকর না শুঁকে খাবার খুঁজে পায় না; পথের হদিসও মেলাতে পারে না। এভাবে প্রাণীটিকে বাধ্য হয়েই রাখালের বশ্যতা মানতে হয়েছে। এমনকি শূকরের চোখ উপড়ে ফেলাও ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। এসবই করা হতো মানুষের খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে।
দুধের খামারগুলো আরও এক ধাপ এগিয়ে। মানুষের চাহিদা মেটাতে গাভি, ছাগী ও ভেড়ীর দুধ শাবকেরা যেন পান করতে না পারে, সে জন্য জন্মের পরই সেগুলো মেরে ফেলা হতো। তবে এই বর্বরতা এড়ানোর চেষ্টাও করেছে মানুষ। এ উদ্দেশ্যে শাবককে কিছুক্ষণ দুধ খাইয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়। অবশিষ্ট দুধ মানুষ মজুত করে নিজেদের খাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই পদ্ধতি টেকেনি। এতে গরু ও বাছুর উভয়েই দুধ সংগ্রহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে মানুষ আগের পদ্ধতিতেই ফিরে যায়।
আবার বাছুর হত্যা শুরু করে। তবে গাভিকে ধোঁকা দেওয়ার উদ্দেশে শাবকের চামড়া ছাড়িয়ে সেটি দিয়ে ‘বাছুর পুতুল’ তৈরি করা হয়। এতে মা পশুটি সন্তান বেঁচে আছে মনে করে বেশি দুধ দেয়। পদ্ধতিটি কাজে লেগেছে। সুদানের নয়ার আদিবাসী অবশ্য পশুশাবক মেরে ফেলত না। তারা বাছুরের মুখে কাঁটাওয়ালা আংটা পরিয়ে দিত। ফলে দুধ পান করতে গেলে গাভির স্তনে আঘাত লাগত। এতে মা দুধ না দিয়ে সরে যেত। সাহারার তুয়ারেগ অঞ্চলের মানুষও কিছুটা এই ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করে। তারা উটশাবকের নাকের বাইরে এবং ঠোঁটের উপরের অংশ কেটে দেয়। ফলে বাচ্চাটি দুধ চুষে পান করতে পারে না। কেবল দুধ সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই পশুদের সঙ্গে মানুষের এসব আচরণ।
সমকালীন মাংসের কারখানার চিত্রগুলোও প্রায় এমন। জন্মের পরই শাবককে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করে খুব ছোট মাপের একটি খোপে আটকে রাখা হয়। সেখানে বাছুর খুব বেশি নড়াচড়া করতে পারে না। এমনকি মাঝেমধ্যে হাঁটাহাঁটিও করতে দেওয়া হয় না। যাতে বাছুরের পেশি শক্ত হয়ে না যায়। কেননা, নরম মাংস খেতে সুস্বাদু। সেই খোপেই শাবকের চার মাসের জীবন কাটাতে হতো। গো-শাবকটিকে বের করে কসাইখানায় নেওয়ার সময়টিই তার প্রথম এবং শেষ হাঁটা। শুধু যে স্থলবাসী প্রাণীদের সঙ্গে মানুষ এমন আচরণ করে, তা নয়। জলজ প্রাণীরও রেহাই নেই। এমনকি হিংস্র হাঙরও মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার।
প্রাচীন চৈনিক সম্রাটেরা হাঙরের ডানা দিয়ে তৈরি স্যুপ খেতেন। শক্তিবর্ধক হিসেবে। এখনো খাবারটি খাওয়া হয়। এ উদ্দেশ্যে প্রতিবছর কয়েক কোটি হাঙর শিকার করে চোরাকারবারিরা। সেগুলোর ডানা কেটে রেখে জীবন্ত অবস্থাতেই ফেরত পাঠানো হয় সাগরে। অতঃপর খাবারের অভাবে, অন্য প্রাণীর আক্রমণ এবং ক্ষতের যন্ত্রণায় ধীরে ধীরে প্রাণীটি মারা যায়।
সমকালীন সভ্যজগতে কিছু খাবার বেশ জনপ্রিয়। যেমন মাতাল চিংড়ি। এটি চৈনিক খাবার। বাইজু নামের অ্যালকোহলে ডুবিয়ে রাখা হয় জলজ এই প্রাণীকে। এরপর থালায় তুলে দেওয়া হয় জীবন্ত ও মাতাল চিংড়িগুলো। সেই অবস্থাতেই খাওয়া হয়। জ্যান্ত গোখরা চিরে হৃদপি- বের করে খায় ভিয়েতনামের বাসিন্দারা। খাওয়া হয় ওই সাপের রক্ত দিয়েই। চীনের সান ঝি অঞ্চলে ইঁদুরকে খুব দ্রুত ছুরি দিয়ে আঘাত করে সঙ্গে সঙ্গে তেলে ডুবানো হয়। পুরো প্রক্রিয়ায় প্রাণীটি তিনটি চিৎকার দেয়।
প্রথমটি ছুরি দিয়ে আঘাতের সময়, দ্বিতীয়টি তেলে ফেলার সময় এবং শেষেরটি ইঁদুরের গায়ে কামড় বসানোর সময়। জাপানে ‘ইকিজুকুরি’ নামের এক প্রকার খাবার আছে। শব্দটির অর্থ ‘জীবন্ত প্রস্তুত’। অক্টোপাস কিংবা চিংড়ি দিয়ে তা তৈরি হয়। এগুলো সরাসরি তুলে দেওয়া হয় পাতে। খাওয়ার সময় নড়াচড়া করে প্রাণীগুলো। কখনো কখনো জীবন্ত মাছও খাওয়া হয়। এমনকি কামড় বসানোর সময় প্রাণীটি মুখ খোলা ও বন্ধ করে। তার হৃৎস্পন্দনও পাওয়া যায়। চীনে জীবন্ত ভেজে দেওয়া মাছের একটি পদ আছে। ইং ইয়াং ফিশ। এমন পদ্ধতিতে রান্না হয় যাতে ভাজার পরও মাছটি প্রায় ৩০ মিনিট জীবিত থাকে। ভাবা যায়!