ফুড বেনিফিট I জায়ফল
আমিষ রান্নায় মসলাটির ব্যবহার বেশি। উপকারী উপাদানে ভরপুর। নানান রোগের দাওয়াই। ত্বকচর্চায়ও কার্যকর
জায়ফলের আদিনিবাস ইন্দোনেশিয়ার বান্দা দ্বীপে। এটি মূলত একধরনের বাদাম। এর গুঁড়া সর্দিকাশি সারায়। গর্ভপাত করার ফল হিসেবেও পরিচিতি আছে। একসময় জায়ফলের সঙ্গে একটি মিথ যুক্ত হয়েছিল, এই ফল প্লেগ সারাতে সক্ষম। ফলে এর দাম হয়েছিল আকাশচুম্বী। মাত্র এক পাউন্ড জায়ফলের দামে সাতটি গরু কেনা যেত। কথিত আছে, একটি ছোট থলে ভরা এই ফল বিক্রির উপার্জিত টাকায় সারা জীবন বসে খাওয়া যেত। উপকারী উপাদানে ভরপুর, তাই প্রাচীন গ্রিস ও রোমে এটিকে বহুবিধ চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হতো। প্রতি ১০০ গ্রাম জায়ফলে আছে পানি ৬.২৩ গ্রাম, প্রোটিন ৫.৮৪ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৪৯.২৯ গ্রাম, ফ্যাট ৩৬.৩১ গ্রাম, ফাইবার ২০.৮ গ্রাম, আয়রন ৩.০৪ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮৪ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১৮৩ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ৩৫০ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২১৩ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক ২.১৫ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ১৬ মিলিগ্রাম এবং ভিটামিন সি ৩ মিলিগ্রাম। এ ছাড়া মেলে ভিটামিন এ, নিয়াসিন, রাইবোফ্লোবিন, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন বি-১২, ভিটামিন কে, ফলেট উপকারী ফ্যাটি অ্যাসিড প্রভৃতি।
এসব উপাদান আমাদের শরীরের নানাবিধ রোগ সারায়। মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে ব্যবহৃত হয়। মুখ গহ্বরে ঘা হলে জায়ফল সেদ্ধ পানি দিয়ে ধুলে আরোগ্য হয়। ফোসকাও সারে। ফলটি দিয়ে সুরমা হয়। তা চোখে লাগালে চোখের চুলকানি সারে। কাজটি করে এতে থাকা বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। তবে চোখের ভেতরে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অনিদ্রার দাওয়াই আছে জায়ফলে। শোবার আগে কপালে ফলটি ঘষলে ভালো ঘুম হয়। কাজটি করে এই বাদামের ট্রাইমিরেটিন নামের একটি রাসায়নিক। তা পেশিগুলো শিথিল করে দেয়। ফলে ঘুম আসে। গেঁটেবাত সারাতে এর তেলের ব্যবহার আছে। প্রসব-পরবর্তী কোমর ব্যথাও সারায়। সে ক্ষেত্রে সকাল ও বিকেলে কোমরে মালিশ করতে হয় ফলটি। পেটের রোগ সারাতে এর জুড়ি নেই। বিশেষ করে এটির তেল। তা বাতাসার সঙ্গে মিশিয়ে খেলে পেটের ব্যথা সারে। গ্যাসও দূর হয়। শুকনা আদাযোগেও জায়ফল ঘিয়ে ঘষে খাওয়ালে শিশুদের পেটের অসুখ সারে। ৯ মাসের কম বয়সী বাচ্চাদের ডায়রিয়া উপশমে মায়ের দুধের সঙ্গে এর গুঁড়া মিশিয়ে খাওয়ানোর চল আছে। শিশুদের সর্দিকাশি দূর করতে এই বাদামের গুঁড়ার সঙ্গে আদা মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। শিশুর ক্ষুধাও বাড়াবে এটি।
দাঁতের ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে জায়ফলের তেলে ভেজানো তুলা আক্রান্ত স্থানে দু-তিন ঘণ্টা চেপে ধরে রাখতে হবে। ক্যাভিটি থেকে বাঁচতে জায়ফলের গুঁড়া দিয়ে নিয়মিত দাঁত মাজলে উপকার পাওয়া যায়। যৌনশক্তি বাড়াতে পারে এই ফল। বীর্য পাতলা ও শুক্রাণু কম উৎপন্ন হলে খাওয়া যেতে পারে। এটি উদ্দীপনা দ্রুত বাড়ায়। পাশাপাশি ক্লান্তি ও চাপ কমায়। মাথাব্যথাও দূর করে। এ জন্য পানি কিংবা কাঁচা দুধের সঙ্গে ফলটি মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করে কপালে মাখলে আরাম পাওয়া যায়।
প্যারালাইজডও সারিয়ে তুলতে পারে জায়ফল। খাঁটি ঘি দিয়ে এটি ভেজে, তা গুঁড়া করে নিতে হয়। এই চূর্ণের সঙ্গে শিলাজুত যোগ করে মধুতে জ্বাল দিলে এক প্রকার আচার তৈরি হবে। তা দৈনিক তিনবার করে খাওয়ালে প্যারালাইজড, প্যারাপেলেজি ও হেমিপ্যারাপেলেজি আরোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জায়ফলের তেলের সঙ্গে লবঙ্গের ও তিলের তেল মেশালে তা অনুভূতিহীনতা নাশক হিসেবে কার্যকর। এই বাদামের তেলে ইগুয়ানল ও এলেমিসিন উপাদান আছে, যা শরীরে সেরোটোনিন ও ডোপামাইন হরমোনের ক্ষরণ বাড়ায়। ফলে মস্তিষ্কের হিপোক্যাম্পাস অংশের ক্ষমতা বেড়ে স্মৃতিশক্তির উন্নতি ঘটে। আলঝেইমারস এবং পারকিনসনের মতো রোগের প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে এটি। এ ক্ষেত্রে রাতে এক গ্লাস গরম দুধে অল্প জায়ফলগুঁড়া মিশিয়ে খেতে হবে। সঙ্গে কিছু এলাচি থাকলে ভালো। লিভারের ক্ষমতাও বাড়ায় এই ফলের তেল। খাবারে নিয়মিত ফলটি খেলে শরীর থেকে ক্ষতিকর টক্সিক বেরিয়ে যেতে শুরু করে। এতে লিভারের কর্মক্ষমতা বাড়ে। ফলে অঙ্গটির রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণেও এর ভূমিকা আছে। সারায় ক্যানসারের মতো জটিল রোগও। জায়ফলে থাকা কিছু উপাদান ক্যানসার কোষ ধ্বংস করতে সক্ষম। ফলটি নিয়মিত খেলে লিউকেমিয়ার আশঙ্কা একেবারেই থাকে না। কোলেস্টেরলও কমায়। ফলে হার্ট সুস্থ থাকে। এ উদ্দেশ্যে এর গুঁড়া খাওয়া যেতে পারে নিয়মিত। অবসাদ দূর করতেও এই বাদামের ব্যবহার আছে। ফলটির গুঁড়ার সঙ্গে আমলকীর গুঁড়া মিশিয়ে পানিতে গুলে খেলে শরীরে সেরাটোনিন ও ডোপামাইন হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে। এতে স্ট্রেস এবং অ্যাংজাইটির প্রকোপ কমে। এসব ছাড়াও এই ফল স্তনে দুধ বাড়ায়, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং হেঁচকি ও বমিভাব দূর করে।
ত্বকচর্চায়ও কাজে লাগে জায়ফল। এর অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান ব্রণ প্রতিরোধ করে। এটি ত্বকের যেকোনো দাগ দূর করতে সহায়তা করে। এই ফলে মেইস নামের উপাদান থাকে, যা ফাংগাস ও ব্যাকটেরিয়ারোধী। ব্রণের মূল কারণই হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাস। জায়ফলের গুঁড়া, মধু ও দুধ মিশিয়ে তৈরি পেস্ট রাতে ঘুমানোর আগে ব্রণে আক্রান্ত স্থানে ভালোভাবে মেখে পরদিন সকালে ধুয়ে ফেলতে হবে। প্রতিদিন ব্যবহারে খুব শিগগির ব্রণ দূর হবে।
এত গুণ থাকলেও জায়ফল গ্রহণে কিছু সতর্কতা মানতে হয়। মধ্যযুগে ইতালির সালের্নো মেডিকেল স্কুলে এ সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত ছিল। তা হচ্ছে, একটি জায়ফল উপকার করবে, দুটি জায়ফল ক্ষতি করবে, আর তিনটি জায়ফল মেরে ফেলবে। এ ফল অতিরিক্ত খাওয়া অনুচিত। জ্বর হলে তা খাওয়া ও ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হয়। এটি বেশি পরিমাণে খেলে বমিভাব, ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এমনকি মূর্ছা যাওয়া এবং মস্তিষ্কের জন্য উপদ্রব হয়ে দাঁড়ায়। তবে জায়ফল খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা বিরল।
❙ ফুড ডেস্ক