ফিচার I হামাস
নাম শুনে চমকে ওঠার কিছু নেই, মধ্যপ্রাচ্যের সশস্ত্র রাজনৈতিক দলের কথা বলা হচ্ছে না, এটা হচ্ছে আরব্য খাবার- হামাস! তবে কালের বিবর্তনে উপনিবেশ, বাণিজ্য, অভিবাসী আর আকাশ-সংস্কৃতির বদৌলতে এই খাবার কেবল আরব দেশগুলোতেই আটকে নেই, বিশ্বব্যাপী ঘটেছে এর প্রসার। বলা হয়, এই খাবার ল্যাভেন্টাইন অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরের পুব দিকের এলাকার। আর প্রাচীনত্বের দিক থেকে প্রায় ৪ হাজার বছরের ঐতিহ্য ধরে আছে হামাস- প্লেটো আর সক্রেটিসের লেখায়ও হামাসের গুণের কথা এসেছে। আর সবচেয়ে প্রাচীন লিখিত রেসিপি রয়েছে ত্রয়োদশ শতকের মিসরীয় ‘কাঞ্জ আল-ফাওয়া’ইদি ফি তানভি আল-মাওয়া’ইদ’ বইয়ে।
হামাসকে ইদানীং খাদ্যবোদ্ধারা বলছেন যুদ্ধ আর শান্তির খাবার। ইসরায়েল আর লেবাননের মধ্যে এর ভৌগোলিক স্বত্ব নিয়ে তীব্র লড়াই চলছে একদিকে, অন্যদিকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সীমান্তের এক ছোট্ট রেস্টোর্যান্ট শান্তির ডাক দিয়েছে এই হামাসের মাধ্যমেই। কোনো মুসলিম আর ইহুদি যদি একসঙ্গে এক টেবিলে বসে খাবার খায়, তাহলে পুরো ৫০ শতাংশ ছাড় দিচ্ছে খাবারের দামে। যে কাজ জাতিসংঘ, আমেরিকা বা রাশিয়া করতে পারেনি, সেটা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এক হাজার বর্গফুটের এক রেস্টোর্যান্ট।
হামাস মূলত চিকপি বা আমাদের চেনা কাবুলি দানার আরবি খাবার। তবে আরব আর আরবের সংস্পর্শে আসা দেশগুলোতে বিভিন্ন ধরনের বিন্স ও ডাল দিয়েও হামাস তৈরির নিদর্শন রয়েছে। এই খাবারকে বলা যেতে পারে চিকপি বা বিন পেস্ট। সেদ্ধ ছোলার সঙ্গে জলপাই তেল, লবণ, রসুন, লেবুর রস, আর তাহিনা (কালো তিল বাটা) একসঙ্গে বাটলে বা ফুড প্রসেসরে মিহি করে ব্লেন্ড করলেই তৈরি হয়ে যায় সহজ ও বেসিক হামাস- হামাস মাসাব্বাহ। এই সহজ-সময়বান্ধব রন্ধনপ্রণালির জন্যই পৃথিবীজুড়ে এর জনপ্রিয়তা। সাধারণত আরব্য নান-খাবুজের সঙ্গে এটা খাওয়া হয়। তবে বিভিন্ন দেশে হামাসের একটা আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়ে গেছে- রেসিপি আর পরিবেশনের ভিন্নতায়। মূলত অ্যাপাটাইজার হিসেবে খাবুজের সঙ্গে খাওয়া রীতি হলেও ফালাফেল (ডালের বড়া), গ্রিলড চিকেন, মাছ আর বাবাগানুশের (ঝালহীন আরবি কেতার বেগুনভর্তা) পাশে ডিপ হিসেবেও এটি পরিবেশিত হয় খোদ আরবসহ পারস্য, তুরস্ক, গ্রিস, সাইবেরিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়াসহ দূরপ্রাচ্য, বলকান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোয়।
হামাসের টপিং হতে পারে অনেক রকমের- টমেটো, শসা, ধনেপাতা, পার্সলে, পেঁয়াজ বেরেস্তা, সঁতে করা মাশরুম, আস্ত সেদ্ধ কাবুলি ছোলা, অলিভ অয়েল, সেদ্ধ ডিম, পাপরিকা, সুমাক, ফাভা বিন, পাইন নাট ইত্যাদি। ইউরোপ-আমেরিকায় আবার টর্টিলা চিপস বা ক্র্যাকার্সের সঙ্গেও দেখা যায় একে। মিসরে হামাসে জিরার ব্যবহার হয়। ফিলিস্তিন ও জর্ডানে এই খাবার মেইন কোর্স হিসেবে খাওয়া হয় রুটির সঙ্গে। তবে ফিলিস্তিনি হামাসে প্রচুর পুদিনাপাতা ব্যবহার করা হয়। এই দুই দেশে লাবান মা’হামাসও বেশ জনপ্রিয়। এখানে তাহিনির পরিবর্তে টকদই, অলিভ অয়েলের বদলে ব্যবহার করা হয় মাখন; আর পরিবেশিত হয় টোস্ট করা পাউরুটির সঙ্গে। ইউরোপ-আমেরিকায় প্রবাসী হওয়া আরবেরা কিব্বেহ (কোফ্তা), ফালাফেল, তাবোল্লেহ (টমেটো, পার্সলে, পুদিনা, গম, পেঁয়াজ, অলিভ অয়েল, লবণ, রসুনের স্যালাড)-এর সঙ্গে এটা খায়। সাইপ্রাসে আবার পাস্ত্রিমা (পাস্তারামি) বা শুকনো মাংসের সঙ্গে হামাসকে ওভেন-ড্রাই করে খাওয়া হয়, যেটা প্রচলিত রীতির থেকে অনেকটাই আলাদা।
মধ্যপ্রাচ্যে অনেক রেস্টোর্যান্ট রয়েছে, হামাস ছাড়া আর কোনো খাবার সেগুলোর মেন্যুতে রাখার চেষ্টাও করেনি। ঢাকায় অথেনটিক হামাস পাওয়া যায় ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের আল-আমার লেবানিজ রেস্টোর্যান্টে। বনানী মাঠের পাশের আত-ত্বীন ক্যাফেও মন্দ নয়। আর আফ্রিকান ঘরানার হামাস পাওয়া যায় নান্দোসে। টার্কিশ অথেনটিক হামাসের কারবার করে গুলশান অ্যাভিনিউর ইস্তানবুল রেস্টোর্যান্ট। নজর রাখতে পারেন পাঁচ তারকা হোটেলের রেস্টোর্যান্টগুলোর দিকে- প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেলিব্রিটি শেফদের এনে অ্যারাবিয়ান ফুড ফেস্ট করে তারা। ঢাকার সেরা হামাস খাওয়া যায় সম্ভবত ওয়েস্টিন, ঢাকায়- সিরিয়ান সেলিব্রিটি শেফ রেমন এমদাদ ওবাইদের। আর দ্বিতীয় সেরা নির্দ্বিধায় বলা যায় ধানমন্ডি ২৭-এর আল আমার।
আল মারুফ রাসেল
ছবি: লেখক