skip to Main Content

আলাপন I মানুষের ভালোবাসাতেই আমি তিমির নন্দী

বেতার ও টেলিভিশনে ১৯৬৯ সাল থেকে গাইছেন শিল্পী তিমির নন্দী। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কণ্ঠসৈনিক। আধুনিক গানের পাশাপাশি নজরুলসংগীত, উচ্চাঙ্গসংগীত এবং বিদেশি ভাষায়ও গান করেন এই শিল্পী। বিভিন্ন বিষয়ে ক্যানভাসের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। আলাপসঙ্গী মিঠু হালদার

ক্যানভাস: আপনার সংগীতজীবনের শুরুটা কীভাবে হলো?
তিমির নন্দী: আমার মা রানু নন্দী এসরাজ বাজাতেন, গান গাইতেন। বাবা দেবেন্দ্র নাথ নন্দী ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী। বড় বোনেরা গান গাইতেন, নৃত্য চর্চা করতেন। ফলে সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলেই আমার বেড়ে ওঠা। সাড়ে তিন বছর বয়সে না শিখেই তবলা বাজানো শুরু করি। তখন তবলা এবং বাঁয়া অনেক উঁচু মনে হতো, ঠিকমতো নাগাল পেতাম না। এ কারণে কারও কোলে বা জলচৌকিতে বসে বাজাতাম। ওইভাবে শুরু হলো বোনদের সঙ্গে মঞ্চে বাজানো। তখন কোনো অনুষ্ঠানে কারও গান, নাচ, বাজনা ভালো লাগলে সংগীতানুরাগীরা সোনার মেডেল, কাপ উপহার দিতেন। সেই ছোট বয়সেই সেসব পাওয়া শুরু করি।
তখন থেকেই বোনদের গানে ভুল ধরিয়ে দিয়ে হারমোনিয়াম বাজাতাম। নিজেও সেভাবে গান করতাম। ছোটবেলায় মায়ের উৎসাহেই শিখেছি- রবীন্দ্র, নজরুল, আধুনিক, পল্লিগীতি, ভাটিয়ালি, মুর্শিদী, মারফতি, ভজন, কীর্তন, শ্যামাসংগীত ইত্যাদি। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় বেঞ্জো বাজানো শিখলাম। তখন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম।
ক্যানভাস: শৈশবের কিছু সময় খুলনা-বাগেরহাটে কাটিয়েছেন…
তিমির নন্দী: ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর বাবা অবসর নেওয়ার আগের বছর তার শেষ পোস্টিং হলো খুলনার ফকিরহাটে। ভালো স্কুলে পড়ার জন্য আমরা প্রায় দুই বছর বাগেরহাটে ছিলাম। ওখানে ওস্তাদ দুলাল কৃষ্ণ দেবনাথ আমার গানবাজনা শুনে মাকে বললেন, আমি যেন যেকোনো একটি বিষয় বেছে নিই- হয় গান, নয় তবলা। গাওয়াটাই বেছে নিলাম। শুরু হলো শাস্ত্রীয় সংগীতে তার কাছে তালিম নেওয়া। দাম বাবু নামের একজন ব্যবসায়ীর বাসায় সপ্তাহে এক দিন সারা রাত শাস্ত্রীয় সংগীত পরিবেশন করতেন স্থানীয় গুণী শিল্পীরা। প্রথম দিকে শুনতাম, পরে ওস্তাদজির কথায় মাঝেমধ্যে গাইতামও।
একবার বাগেরহাটের সিনেমা হলে ইভনিং শোর বদলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হবে। তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। ওস্তাদজি আমাকে তৈরি করলেন। ঢাকা থেকে সংগীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদ, গণসংগীত ও নজরুলসংগীতশিল্পী শেখ লুৎফর রহমান এলেন, সঙ্গে ছিলেন শিল্পী শবনম মুস্তারী। আমি অনুষ্ঠানে খেয়াল-রাগ ইমন এবং নজরুলসংগীত ‘কাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা’ গাইলাম। সামনের সারিতে বসে থাকা আলতাফ মাহমুদ এবং শেখ লুৎফর রহমান ছুটে এলেন মঞ্চে।
আলতাফ মাহমুদ আমাকে একঝটকায় শূন্যে তুলে চুমু খেয়ে বললেন: ‘তুমি ঢাকা চলো।’ পেছনে দাঁড়িয়ে শেখ লুৎফর রহমান সায় দিয়ে একই কথা বললেন। তবে ঢাকায় যাওয়া হলো না। সিতলাই (রাজশাহী) যেতে হলো এবং ওখানে ওস্তাদ হরিপদ দাসের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিতে লাগলাম।
ক্যানভাস: এরপরই আপনি ঢাকায় চলে এলেন…
তিমির নন্দী: সেটা ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে। পরের বছর মেজ ভাই তরুণ কুমার নন্দী (প্রয়াত) জানালেন, ‘ইস্ট পাকিস্তান মিউজিক অ্যান্ড ড্যান্স কম্পিটিশন’-এ নাম দিয়ে এসেছেন, আমাকে গাইতে হবে। ভয় পেলাম! তবে প্রতিযোগিতায় আধুনিক গানে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক এবং পল্লিগীতিতে দ্বিতীয় হয়ে রৌপ্য পদক পেলাম।
পরদিন জাতীয় দৈনিকের প্রথম পাতায় আমার ছবি, স্কুলের নামসহ নিউজ ছাপা হলো। তখন লালমাটিয়া হাউজিং সোসাইটি বয়েজ হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমার কৃতিত্বের জন্য স্কুল এক দিনের ছুটি ঘোষণা করল! আমি হেড স্যার আব্দুল হাই এবং বাংলার দৌলত স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ!
এরপর রেডিও পাকিস্তান ও পাকিস্তান টেলিভিশন করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে প্রখ্যাত বংশীবাদক ও সংগীত পরিচালক ধীর আলী মিঞা ও বেলাল বেগ আমাকে নিয়মিত উভয় মিডিয়াতে গাওয়ার জন্য নিয়ে যান। তখন থেকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গান করি।
পাশাপাশি ধানমন্ডিতে পাকিস্তান কালচারাল একাডেমির ওস্তাদ আমিনুল ইসলামের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীতে এবং ওস্তাদ সুধীন দাশের কাছে নজরুলসংগীতে তালিম নিতে থাকি।
১৯৬৯ সাল থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক সুজেয় শ্যাম এবং ওস্তাদ ওমর ফারুকের সুরে রেডিও পাকিস্তানে গান গাইতাম। তখন সংগীত পরিচালক অজিত রায় আমার বোনদের রবীন্দ্রসংগীত শেখাতে বাসায় আসতেন। টিভিতে বিভিন্ন ধরনের গান ছাড়াও বিদেশি ভাষায় আমাদেরকে গান শেখাতেন মুস্তাফা মনোয়ার।
ক্যানভাস: কৈশোরের কথা শুনতে চাই…
তিমির নন্দী: ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার তাগিদ অনুভব করি। আমি তখন মেজ ভাইয়ের শ্বশুরালয় কুড়িগ্রামে। স্থানীয় শিল্পীদের সমন্বয়ে বেয়াই দেবব্রত বক্সী বুলবুল আমাদেরকে গণসংগীত শেখাতেন। কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট অঞ্চলের হাটে-ঘাটে-মাঠে আমরা গান করে মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করতাম। একসময় কুড়িগ্রামের কাছাকাছি পাকিস্তান আর্মি এলে বাগুয়া গ্রামে চলে যাই। সেখানে প্রতি রাতে লাঠি হাতে গ্রাম পাহারা দিতাম। তখন মাকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কথা বলি।
ক্যানভাস: পরে তো আপনি কলকাতায় চলে যান…
তিমির নন্দী: মায়ের কথামতো কলকাতায় অবস্থিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিই। এ ছাড়া সাবেক মন্ত্রী এম এ মান্নানের তত্ত্বাবধানে ‘শরণার্থী শিল্পীগোষ্ঠী’তে যোগ দিই। সেখানে নাট্যকার মামুনুর রশীদ, কণ্ঠশিল্পী অনুপ ভট্টাচার্য, মো. রফিকুল আলম, ফকির আলমগীর, মিতালী মুখার্জি, চিত্রনাট্যকার বিপ্লব দাস, নৃত্যশিল্পী কমল সরকার, শুক্লা দে, রেখা দাস, দীপা দাস (খন্দকার) প্রমুখ ছিলেন।
আমরা গীতিনাট্য প্রস্তুত করে কলকাতার বিভিন্ন স্থানে, সীমান্ত অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করার জন্য অনুষ্ঠান করতাম। প্রাপ্ত পারিশ্রমিক মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করতাম। একবার দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আকাশবাণী কলকাতায় ‘সংবাদ প্রবাহ’তে শরণার্থী শিল্পীগোষ্ঠীর একটি অনুষ্ঠানে আমার গাওয়া ‘ধ্বংসের পরোয়ানা শোনো কি’ বাজানোর আগে বলেন, ‘ওপার বাংলার শিল্পী তিমির নন্দী।’ এটি আমার জন্য বিশাল পাওয়া। এভাবে ১৬ ডিসেম্বর, বিজয়ের দিন পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গান করি।
ক্যানভাস: সংগীতশিক্ষক হিসেবে কাদের পেয়েছেন?
তিমির নন্দী: ১৯৭২ সালে ওস্তাদ মুন্সী রইসউদ্দিন এবং ওস্তাদ আমিনুল ইসলামের কাছে শাস্ত্রীয় সংগীত, শেখ লুৎফর রহমানের কাছে নজরুলসংগীত, গণসংগীত আর সুখেন্দু চক্রবর্তীর কাছে গণসংগীতে তালিম নিই। এ ছাড়া সান্নিধ্য পেয়েছি সুধীন দাশের। তিনি পাকিস্তান আমলে কলাবাগানে আমাদের ওপর তলায় থাকতেন। আমার বোনেরা তাঁর কাছে নজরুলসংগীত শিখতেন। আমিও শিখেছি। ১৯৬৯ সাল থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সুজেয় শ্যাম এবং ওস্তাদ ওমর ফারুকের সুরে রেডিও পাকিস্তানে গান গাইতাম।
ক্যানভাস: সোভিয়েত ইউনিয়নের স্কলারশিপ বিষয়ে বলুন।
তিমির নন্দী: ১৯৭৩ সালে সংগীত বিষয়ে পড়াশোনার জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্কলারশিপ পাই। প্রথমে ভারোনেঝ শহরে, পরে রাস্তোভ-অন-ডন এবং সবশেষে সেন্ট পিটার্সবুর্গে পড়াশোনা করি। দ্রুত রাশান ভাষা আয়ত্ত করি এবং বাংলা, রাশান, ইংরেজি, স্প্যানিশ গান গেয়ে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করি। মাঝেমধ্যে স্থানীয় টেলিভিশনেও গান করতাম।
প্রতিটি প্রতিযোগিতায় প্রথম হই। ১৯৭৬ সালে আন্তর্জাতিক সংগীত প্রতিযোগিতায় রাস্তোভ-অন-ডন শহরের একটি ইনডোর স্টেডিয়ামে ১৫ হাজার দর্শকের সামনে প্রথম সিমফোনি অর্কেস্ট্রার সঙ্গে ‘গড ফাদার’ ছবির ‘স্পিক সফ্টলি ল্যভ’ গান গেয়ে বাংলাদেশের ছাত্র হিসেবে সুনাম অর্জন করি।
ক্যানভাস: টেলিভিশন ও বেতারে নিয়মিত গাইতে শুরু করেন কবে থেকে?
তিমির নন্দী: ১৯৮৩ সালের শেষ থেকে। শিল্পী তালাত মাহমুদের ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’ গানটি ১৯৮৪ সালে বিটিভিতে গাইলে রাতারাতি পরিচিতি পাই। তখন থেকে সংগীত পরিচালক হিসেবেও নিয়মিত হই।
খ. ম. হারুন ও আবদুল্লাহ আল-মামুনের কিছু নাটকে সংগীত পরিচালনা করি। তার মধ্যে ১৯৯২/৯৩ সালের দিকে খ. ম. হারুন প্রযোজিত ‘শঙ্কিত পদযাত্রা’ ধারাবাহিকে আমার সুর করা ও গাওয়া সূচনাসংগীত ‘বাঁধন খুলে দিলাম’ দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। তখন কয়েকটি সলো এবং মিক্সড অ্যালবাম বের হয়।
ক্যানভাস: আপনি তো ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকের জন্য আমাদের জাতীয় সংগীতের ‘স্টাফ নোটেশন’ করে দিয়েছেন…
তিমির নন্দী: হ্যাঁ। একই বছর ইতালির রোমে শহীদ মিনার উদ্বোধনের জন্য তিনটি ভাষার গান, ‘মোদের গরব মোদের আশা’, ‘ওরা আমার মুখের কথা কাইড়া নিতে চায়’ এবং ‘ভাষার জন্য যারা দিয়ে গেছে প্রাণ’ স্টাফ নোটেশন করি।
ক্যানভাস: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্মৃতি এখন আপনার মধ্যে কেমন অনুভূতির সৃষ্টি করে?
তিমির নন্দী: মনে হয়, এই তো সেদিন! কত কষ্ট, ত্যাগ, তিতিক্ষা। সেসব গান শুনলে এখনো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়।
ক্যানভাস: স্বাধীন বাংলার শিল্পীদের বছরের নির্দিষ্ট একটা সময়ে গণমাধ্যমে দেখা যায়। বছরের অন্য সময়ে নয় কেন?
তিমির নন্দী: দেশপ্রেম সবার মধ্যেই আছে। বিশেষ মাসকে ঘিরে আসলে এমনটা হয়। তবে তাদের এই বীরগাথা শোনার জন্য হলেও সারা বছরই মিডিয়াতে ডাকা উচিত।
ক্যানভাস: ২০১৯ সালে ক্যারিয়ারের ৫০ বছর পূর্ণ করেছেন। জীবন সম্পর্কে আপনার অভিমত?
তিমির নন্দী: আমি অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছি। এখনো অনেক পরিশ্রম করি। গ্রামে বা শহরে, কোথাও আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। পৈতৃক বাড়ি নেই। ভাড়া বাড়িতে থাকি, সেটা আমার জন্য কষ্টের। না পাওয়াটা এখানেই। তবে মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা অতুলনীয় এবং এটাই আমাকে আজকের তিমির নন্দী করেছে।
ছবি: মো. রাকিবুল হাসান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top