skip to Main Content

ফিচার I শোলাশিল্প

বাংলার লোকজ শিল্পে শুভ্র এই বস্তুর কদর রয়েছে। তবে তা বেড়ে যায় শরৎ নিকটবর্তী হলে

শোলা এক প্রকার উদ্ভিদ; যা ধানখেত ও জলাভূমিতে জন্মে। এটি দিয়ে কারুকার্যময় হরেক রকম জিনিস তৈরি করা হয়। প্রতিমা নির্মাণে ও বর-কনের টোপর তৈরিতে শোলা ব্যবহৃত হয়। টোপরে কদম ফুলের ঝালর থাকে। শিশুতোষ খেলনা ও ঘরের শৌখিন সাজ শোলাশিল্পে বৈচিত্র্য এনেছে। বৃত্তিজীবী মালাকারেরা এ শিল্পের রূপকার। এটি বাংলার উল্লেখযোগ্য লোকজ শিল্প।
তারা শোলা, সুতা, কাগজ, আঠা ও রঙের সাহায্যে পাখি, হাতি, ফুল, পুতুল, নৌকা, চাঁদমালা, ঝালর ইত্যাদি তৈরি করে মেলা ও হাটবাজারে বিক্রি করে। শোলার বৈজ্ঞানিক নাম Aeschymene aspera।
বৈষ্ণবেরা শোলানির্মিত রাধাকৃষ্ণের মূর্তি রাসমঞ্চে প্রতিষ্ঠা করেন পূজার জন্য। তিন সারির কদম ফুল ও পাতার মাঙ্গলিক নামের এই শিল্পকর্ম একটি শৌখিন দ্রব্য; ঘরে ঝুলিয়ে রাখা হয়। ব্রিটিশ আমলে শোলার হ্যাট জনপ্রিয় ছিল। ধারালো ছুরি ও কাঁচি এ শিল্পের প্রধান যন্ত্র। শুকনো শোলার ছাল খুলে এর সাদা অংশ ব্যবহার করা হয়। ছুরি দিয়ে প্রয়োজনমতো কেটে মালাকার হাতের কৌশলে এসব শিল্পকর্ম তৈরি করেন।
বাংলাপিডিয়া থেকে জানা গেছে, শিব হিমালয়কন্যা পার্বতীকে বিবাহ করার সময় শ্বেত মুকুট পরার ইচ্ছা পোষণ করেন। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা তখন মুকুট তৈরির উপাদানের কথা ভাবতেই শিবের ইচ্ছায় জলাশয়ে একধরনের উদ্ভিদ জন্মে, সেটাই শোলাগাছ।
কিন্তু বিশ্বকর্মা শুধু পাথর বা কাঠের মতো শক্ত দ্রব্যে কাজ করতে পারদর্শী, শোলার মতো নরম জিনিসে নয়। তখন শিবের ইচ্ছায় জলাশয়ে এক সুকুমার যুবকের আবির্ভাব ঘটে, যাকে বলা হয় মালাকার। শোলাশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা এখন এই নামেই পরিচিত এবং হিন্দু সমাজভুক্ত।
মালাকারেরা বংশানুক্রমে শোলা দিয়ে বৈচিত্র্যময় টোপর, দেবদেবীর অলংকার, চালচিত্র, পূজামন্ডপের অঙ্গসজ্জার দ্রব্যাদি, মালা, গয়না, খেলনা ও গৃহসজ্জার নানা উপকরণ তৈরি করে।
সূত্রধর ও কর্মকারেরা বিশ্বকর্মার এবং মালাকারেরা শিবের উপাসক। এদের ধারণা, শিবের ইচ্ছায় তাদের আবির্ভাব ঘটেছে, তাই তিনিই তাদের উপাস্য।
শোলা একটি কান্ডসর্বস্ব গাছ। কান্ডের বাইরের আবরণটা মেটে রঙের, ভেতরটা সাদা। গাছ সাধারণত ৫-৬ ফুট লম্বা হয়, কান্ডের ব্যাস দুই থেকে তিন ইঞ্চি। বাংলাদেশে দুই প্রকার শোলা জন্মে: কাঠশোলা ও ভাটশোলা। কাঠশোলা অপেক্ষাকৃত শক্ত, ভাটশোলা হালকা ও নরম।
বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা), মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, জামালপুর, শেরপুর, যশোর, রংপুর, দিনাজপুর ও বরিশাল অঞ্চল শোলাশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। একসময় পুরান ঢাকার মালিটোলা এলাকায় এর কারিগর মালাকারদের বসবাস ছিল বলে ওই এলাকার নাম হয়েছে মালিটোলা। অবশ্য এখন সেখানে শোলার কাজ তেমন হয় না; বরং শাঁখারীবাজার এলাকায় এখনো অনেকে শোলার কাজ করেন। তাঁরা হলেন প্রকাশ সুর, অভি সুর, তপন নন্দী প্রমুখ।
তপন নন্দী দেবদেবীর গয়না, তাদের চালচিত্র ও পোশাক তৈরিতে অত্যন্ত দক্ষ। শাঁখারীবাজারের বেশির ভাগ পূজামন্ডপের পশ্চাৎপট ও সজ্জার কাজ তিনিই করে থাকেন।
ঢাকার বাইরে মাগুরা জেলার শতপাড়ার হাজরাহাটি গ্রামের মহাদেব মালাকার ও শঙ্কর মালাকারের শোলার তৈরি টোপর ও বিয়ের মালা সূক্ষ্মতা আর নিপুণতায় অপূর্ব। তারা বংশপরম্পরায় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত। কুষ্টিয়ার আড়পাড়া গ্রামের গোপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীও একজন দক্ষ শিল্পী।
শোলার শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে তেমন কোনো যন্ত্রপাতির প্রয়োজন হয় না। একটি ধারালো ছুরি আর একখন্ড পাথর কিংবা কাঠই যথেষ্ট। প্রথমে ধারালো ছুরির সাহায্যে শোলাকে প্রয়োজনমতো টুকরো করা হয়। পরে ছুরির মাধ্যমে পাতলা করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একটি লম্বা পাতের মতো করা হয়। যেটিকে জড়িয়ে জড়িয়ে পুনরায় কান্ডের মতো করে দড়ি বেঁধে ছুরির সাহায্যে নানা আকারের পাপড়ি কেটে বেলি, কদম ইত্যাদি ফুল তৈরি হয়।
টোপর, পশুপাখি, অলংকার, পশ্চাৎপট, পটচিত্র প্রভৃতি তৈরিতে পাতলা করে কাটা শোলাকে আঠার সাহায্যে যুক্ত করা হয়। পরে প্রয়োজন অনুসারে তাকে বিভিন্ন আকার দেওয়া হয়। শোলাকে যুক্ত করতে সাধারণত নিজেরাই তেঁতুলবিচির আঠা তৈরি করে নেয়। এখন অবশ্য কৃত্রিম আঠা ব্যবহার করা হচ্ছে।
শোলার শিল্পকর্ম আকর্ষণীয় করতে মালাকারেরা রং, জরির সুতা, চুমকি ইত্যাদি ব্যবহার করেন। শাঁখারীবাজারে সম্পূর্ণ শোলা দিয়ে তৈরি একটি বিয়ের টোপর চার শ থেকে পাঁচ শ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া এর তৈরি কুঁচিমালাও হিন্দু বিয়েতে প্রয়োজন পড়ে। ধর্মীয় উৎসবে এটি দিয়ে ক্যানভাসের মতো তৈরি করে তাতে বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্র অঙ্কন করা হয়। এগুলো ঘটচিত্র, করন্ডিচিত্র, মুখচিত্র ইত্যাদি নামে পরিচিত। অনেক সময় গণেশ, শীতলা, মনসা, কার্তিক ও চামুন্ডার চিত্রও আঁকা হয়ে থাকে।
এখন মালাকারেরা বিয়ের টোপর, মালা ছাড়াও চাহিদা অনুযায়ী নানা ধরনের খেলনা, পাখি, ফুল, পুতুল ইত্যাদিও তৈরি করে। শোলাশিল্প সংরক্ষণ করা কষ্টকর; কারণ, এর স্থায়িত্ব কম।
এ শৌখিন শিল্প আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। এটি হারিয়ে যাওয়ার আগে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশের ক্ষুদ্র শোলাশিল্প খাত।
গত বছর নববর্ষ সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কারিগরেরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে নববর্ষের অনুষ্ঠান হয়নি। তাই শোলার থোকা থোকা ফুল তৈরি করলেও ক্রেতা ছিল না।
সারা বছর টুকটাক শোলার কাজ থাকলেও মৌসুম হচ্ছে অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ।
লেখক: মিঠু হালদার
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top