এডিটরস কলাম I পাল্টে যাওয়া জীবন
এখন নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত রাখাই প্রাধান্য পাচ্ছে সর্বত্র। বলতে গেলে জীবনধারার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে সুস্থতা টিকিয়ে রাখার সঙ্গে ওতপ্রোত অভ্যাসগুলো। বাড়িতে, কর্মস্থলে, রেস্তোরাঁয়- সর্বত্র এসব মানতে হচ্ছে
জীবনধারা বদলে গেছে। বেঁচে থাকার চেষ্টায় নতুন এক সংযোজন এই পরিবর্তনের মূল কারণ। নিজের জন্য, পরিবারের প্রয়োজনে সংগ্রাম কমবেশি সবাই করে থাকি। তাতে জীবননির্বাহের একটা ছক তৈরি হয়ে যায়। প্রতিদিনের অভ্যাস আর বিভিন্ন চাহিদা পূরণের উপায় ও সক্ষমতা নিজ নিজ আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে। বিশ্বব্যাপী করোনার প্রকোপ এই বাস্তবতায়ও পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বাজার-সদাই, খাদ্য গ্রহণ থেকে ঘুম- বদলে গেছে সবই।
এখন নিজেকে ঝুঁকিমুক্ত রাখাই প্রাধান্য পাচ্ছে সর্বত্র। বলতে গেলে জীবনধারার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে সুস্থতা টিকিয়ে রাখার সঙ্গে ওতপ্রোত অভ্যাসগুলো। বাড়িতে, কর্মস্থলে, রেস্তোরাঁয়- সর্বত্র এসব মানতে হচ্ছে।
২
পৃথিবীতে এ রকম দুর্যোগ নতুন কিছু নয়। বিশ শতকের শুরুতে স্প্যানিশ ফ্লুর কথা সবারই জানা। একেকটি অতিমারি বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দার সূত্রপাত ঘটায়, তা মোকাবিলার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্র নতুন নতুন নীতি গ্রহণ করে এবং এর প্রভাব জনসাধারণের ওপর বর্তায়। স্প্যানিশ ফ্লুতে সৃষ্ট পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে সামলে ওঠার জন্য মানুষ প্রধান যে উপায়টি বেছে নিয়েছিল, তা হলো ব্যয় সংকোচন। আর সবকিছুর মতোই ফ্যাশন এবং রূপচর্চায়ও এর প্রভাব পড়েছিল। যে মিনিমালিস্টিক লাইফস্টাইল আধুনিক ও সমকালীন জীবনের অংশ হয়ে গেছে, তা এসেছে বিশ শতকের শুরুর দিককার সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রণোদনা থেকে।
৩
এরই মধ্যে শিখে গেছি কীভাবে নিজেকে সুস্থ রাখতে হয়, প্রয়োজনের বেশি খরচ না করে, এমনকি চাহিদার পরিধি না বাড়িয়ে। সৌন্দর্যচর্চাও এর বাইরে নয়। তবে গত কয়েক মাসে পাল্টে গেছে রূপের ধারণা। মুখের বড় একটা অংশ মাস্কে ঢেকে রাখা এখন সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। মানে সংস্কৃতির জন্ম হয় প্রয়োজন ও অভ্যাস থেকে। যাহোক, এই অতিমারি সৌন্দর্যচর্চায় যে প্রভাব ফেলেছে, তাতে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক বিউটি ইন্ডাস্ট্রিও বিপন্ন। এর সঙ্গে লাখ লাখ মানুষের জীবননির্বাহের প্রশ্নটি জড়িত। তা সামলে ওঠার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে সৌন্দর্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকান্ড চালু হয়েছে বটে; কেননা, নিজেকে সুন্দর রাখার অভিপ্রায় মানুষের সহজাত।
৪
এমনিতেই কয়েক দশক ধরে লাইফস্টাইলের ধারণায় ‘এথিক্যাল’ এবং ‘সাসটেইনেবল’- এই দুটি টার্ম বেশ প্রচলিত। পরিবেশ, পোশাক-আশাক, নৈতিকতা, মানবিক ও জীবনবান্ধব বিষয়-আশয় এর অন্তর্ভুক্ত। কোভিড-১৯ এসে এই দুটি পারিভাষিক শব্দের অর্থকে আরও জোরালো ও প্রসারিত করেছে। তাতে যুক্ত হয়েছে নিজেকে নিরাপদ রেখে অন্যকে বাঁচিয়ে রাখার নীতি। এর প্রভাবে মানুষ আগের চেয়ে সচেতন। কিন্তু কিছুই সে থামিয়ে রাখতে রাজি নয়। স্থবিরতার বিপরীতে কিছু বিকল্প সন্ধান মিলেছে। যেমন আগের মতো ফ্যাশন শো কিংবা ফুড ফেস্টিভ্যাল অনুষ্ঠিত হচ্ছে না, বিকল্প হিসেবে এই কাজে বেছে নেওয়া হয়েছে ভার্চ্যুয়াল স্পেস। তাতে বরং একদিক থেকে বিশ্ববাসীর সুবিধাই হয়েছে। বিনোদনের জন্য কিংবা প্রয়োজনে যারা বাহিরমুখো ছিলেন, তারা ঘরে বসেই এসবের অভিজ্ঞতা পাচ্ছেন। ফলে রিয়েল ও ভার্চ্যুয়াল- এই দুই জগতের মধ্যে পার্থক্য কিছু মাত্রায় কমে এসেছে। সেসব অন্য কথা।
৫
পরিবর্তনের কথা বলেছি। বলেছি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য বিকল্প সন্ধানের কথাও। শেক্সপিয়ারের সেই বিখ্যাত উক্তি- ‘লাইফ ইজ অ্যাডজাস্টমেন্ট অ্যান্ড কম্প্রোমাইজ’ আবারও তাৎপর্যপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক মনে হলো। মানে, খাপ খাওয়ানো ও মেনে নেওয়া। এই দুই প্রত্যয়ের অনুশীলন ছাড়া মানুষের টিকে থাকা কঠিন। যে যত নতুন নতুন পরিস্থিতির মধ্যে অভিযোজিত হতে পারে, সে তত টিকে যায়। কোভিড-১৯ এ এই বার্তা আরও স্বীকার্য হয়ে উঠেছে। পরিস্থিতিটির নাম আমরা দিয়েছি ‘নিউ নরমাল’। এমন একদিন আসবে, এটা হয়ে যাবে পুরোনো। কিন্তু এ স্বাভাবিকতা একসময় আমরা আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারব না। কার্যকর ভ্যাকসিন এলে অনেকেই মাস্ক সরিয়ে ফেলব মুখমন্ডল থেকে। ভুলে যাওয়া অনেক অভ্যাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতেও পারে। কিন্তু জীবন যাকে গ্রহণ করে, শেষ পর্যন্ত সেটাই স্বাভাবিকতা। একেক পরিস্থিতিতে এর রূপটাই কেবল পাল্টে যায়। মানুষকে তখন বদলে যেতে হয়।