ফিচার I খাবারের নব্য স্বাভাবিকতা
অতিমারিতে চালু হয়েছে রেস্তোরাঁর অনলাইন সার্ভিস। বাড়িতেই মিলছে বাইরে খাওয়ার বিনোদন
পৃথিবী নাকি আর আগের রূপে ফিরবে না, জানিয়েছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস। স্বাভাবিক হওয়ার সময় অন্তত এখনো আসেনি অনেক দেশেই। সেসব অঞ্চলে অর্থনীতির চাকা ঘুরছে না। এমনকি সচলতার চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। তা ছাড়া উত্তর গোলার্ধের শীত মৌসুম আসি আসি করছে, আশঙ্কা আছে আবারও করোনা বিস্তারের। বিশ^জুড়েই এই পরিস্থিতির শিকার হয়েছে খাদ্যশিল্প।
মার্চের শেষ থেকে এ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যাওয়া রেস্টুরেন্টের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। তারা হয় ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে, নয়তো কর্মী ছাঁটাই করেছে। বাকিরা খানিক অপেক্ষা করে দরজা খুলেছে ঈদুল আজহার পর। তবে নেই আগেকার সেই ভিড়, আড্ডা। কেবল রেস্টুরেন্ট নয়, খাদ্যশৃঙ্খলের একদম নিচের সারিতে, উৎপাদকের কাতারেও মন্দা লেগেছে। প্রথম দিকে বাড়তি শাকসবজি, ফসল কম দামে ছেড়ে দিতে হয়েছে, মধ্যবর্তী শস্য তোলার সময়ে শ্রমিকের অভাব, আর এখন চলছে বন্যার প্রকোপ- সব মিলিয়ে ভালো নেই তারাও। এতে বাড়তে শুরু করেছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে এই পরিস্থিতি প্রভাব রেখে যাচ্ছে।
রেস্টুরেন্টগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়িয়েছে বাড়িতে তৈরি খাবার। ভারতের দিল্লিতে করা এক জরিপ থেকে উঠে এসেছে, সেখানে অনলাইনে হোম কুকদের খাবারের চাহিদা বেড়েছে ৩৭ শতাংশ। আর মোট অনলাইনে খাবার অর্ডার করার প্রবণতা বেড়েছে ৪৮ শতাংশ। মূলত ঢাকায় হোম বেজড কুকদের দুটি বড় প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। তাদের ফেসবুক পেজ থেকে জানা যাচ্ছে, বিকিকিনি চলছে বেশ ভালোই। নতুন শেফ, ইউটিউব চ্যানেল, ফেসবুকের উত্থান তাই থেমে নেই। তারা যে কেবল ঘরোয়া খাবার তৈরি করছেন, তা-ই নয়, রেস্টুরেন্টের পদ আর স্ট্রিট ফুডগুলোকেও তুলে আনছেন বাড়ির রান্নাঘরে। অর্ডার যেমন বাড়ছে অনলাইনে, সেই সঙ্গে কমছে রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়ার চল। ফলে রেস্টুরেন্টগুলোও অনলাইনে যেতে শুরু করেছে। তারা নিজেদের ওয়েবসাইট, ফেসবুক, অ্যাপ আর ডেলিভারি সিস্টেম উন্নত করার পাশাপাশি থার্ড পার্টিকেও সঙ্গে নিচ্ছে সার্ভিসের জন্য।
স্বাস্থ্যকর জিনিস খাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে ধীরে ধীরে। অনলাইনে পাটায় বাটা মসলা থেকে এক্সট্রা ভার্জিন নারকেল তেল, চাঁদপুরের ইলিশ, সুন্দরবনের মধু, যশোর-সাতক্ষীরার চুই ঝাল- এসবের প্রসার প্রমাণ করে অনেকেই স্বাস্থ্যসম্মত ভালো জিনিসের দিকে ঝুঁকছেন। আগে গ্লোবাল প্রেডিকশন ছিল মানুষ শাকসবজি, কেটো ডায়েটে ঝুঁকছে। হচ্ছেও তাই। আবার এসব পণ্য ও ব্র্যান্ডিংয়ের পাশাপাশি তাতে ভ্যালু অ্যাড করার চেষ্টা চলছে, যেমন গোটা মসলা থেকে কেবল গুঁড়া নয়, পাটায় বাটা মসলা আসছে, তেমনি মাছ কেটে প্যাকেজিংয়ের মাধ্যমেও বিক্রি হচ্ছে।
রেস্টুরেন্টের খাবারের লোভ সহজে যাবে না। তাই এর হাই ফ্লেম স্টোভের ঘরোয়া রূপ দেখার সম্ভাবনা আছে। রেস্টুরেন্টগুলো অনেক বেশি তাপের স্টোভ ব্যবহার করার ফলে বেশি খাবার থেকে ফুড এনজাইম নির্গত হয়ে সুস্বাদু করে। চুলা প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো এই সুযোগ লুফে নিতে পারে।
আরেকটা আশঙ্কা রয়েছে, ইন্টারন্যাশনাল ফুড জায়ান্ট চেইন রেস্টুরেন্ট বা ফাইভ স্টার হোটেলগুলো খাবারের দাম কমিয়ে আনছে নিজেদের টিকে থাকার স্বার্থে। স্ট্রিট ফুডও চলে এসেছে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে, হোম শেফদের কল্যাণে। তাদের দাপটে প্রফেশনাল শেফরাও খুব একটা পিছিয়ে থাকছে না। তারাও ক্লাউড কিচেনে চলে আসছে।
রেস্টুরেন্টে তৈরি খাবার বাড়িতেও খাওয়া যায়। এই দুই জায়গায় খাওয়ার ক্ষেত্রে দামের যে হেরফের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে, তেমনটি বাংলাদেশে নেই; বরং ঢাকা ও অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোয় থার্ড পার্টি ডেলিভারি সার্ভিসের একটা মধ্যস্বত্বভোগী বাজার তৈরি হয়েছে। সেটা সময় ও শ্রম- দুটোই বাঁচায়। দেশের বাইরে বিশেষত ভারতে জোম্যাটো আর ফুডপান্ডার দুজন ডেলিভারি বয় করোনা পজিটিভ প্রমাণিত হওয়ায় সেখানে থার্ড পার্টি সার্ভিসে খানিকটা ভাটা দেখা গেছে। এ জন্য টাচ ফ্রি ডেলিভারি একটা ভালো বিকল্প হতে পারে, তা দেখিয়েছে ঢাকার ডমিনোজ পিৎজা ও কয়েকটি ব্র্যান্ড, যারা নিজেরাই নিজেদের ডেলিভারি সিস্টেম তৈরি করেছে।
আবার কিছু রেস্টুরেন্ট নিজেরাই পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। প্রতি ঘণ্টায় টেবিল, চেয়ার, কিচেন ইউটেনসিলস ইত্যাদি জীবাণুমুক্ত করা ছাড়াও নিয়মিত কর্মীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার মতো ঘটনাও ঘটছে। আর ডেলিভারি ব্যাগ স্যানিটাইজ করা, টেম্পার প্রুফ সিল ব্যাগের ব্যবহার তো হবেই।
রেস্টুরেন্টে যাওয়ার প্রবণতা অনেকাংশেই কমে গেছে। যদি ন্যূনতম হাতের স্পর্শে খাবার তৈরি না করে, তবে তারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। করপোরেট বিনোদন কমেছে, বিশেষত দল বেঁধে রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়ার অভ্যাসে ভাটা পড়ছে। পরিবার নিয়ে যাওয়াটাও কমে এসেছে। আরেকটি ব্যাপার হলো পঞ্চাশের বেশি বয়সীরা যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছেন। ফাস্ট ফুড শপেও অভিভাবকেরা ১০ বছরের নিচের বাচ্চাদের নিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না।
এই শতকের ট্রেন্ড হ্যাং আউট বা আমাদের ঐতিহ্যবাহী আড্ডা অন্তত আগামী বসন্তের আগমনী পর্যন্ত যে আগের মতো হবে না, তা বলা চলে নির্দ্বিধায়। কারণ, শীতকালের অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রায় করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে যায়। এ সময়ে রেস্টুরেন্টের শেয়ারিং প্ল্যাটারগুলোর বিক্রিও কমে আসবে।
কিচেন কতটা হাইজেনিক আর নিজেরাও-বা কতটা উদ্যমী করোনার ছড়িয়ে পড়া রুখতে, তা দেখাতেই রেস্টুরেন্টে ওপেন কিচেন চালু হচ্ছে।
ফিডব্যাক, রেটিং, ফুড ব্লগার আর ইনস্টাগ্রাম অনেক বেশি প্রভাব ফেলেছে ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে। করোনা-পরবর্তী হাইজিন বা সেফটি ইস্যুতে একটা নেগেটিভ রিভিউ অনেক প্রতিষ্ঠিত রেস্টুরেন্টের জন্যই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে আগেকার বিশ্বস্ততা, ব্র্যান্ড ভ্যালুও প্রভাব ফেলছে। অনেকেই সস্তা খাবারের মোহে না গিয়ে একটু বাড়তি খরচ করে ব্র্যান্ড আর অতীতের বিশ^স্ত রেস্টুরেন্টের কাছেই ফিরে যাচ্ছে।
এত ক্ষতির যে হিসাব, তা কমানোর চেষ্টা থাকবেই। তাই যেসব রেস্টুরেন্ট হয়তো কেবল লাঞ্চ আর ডিনারের জন্যই খোলা থাকত, সেটায় এখন ব্রাঞ্চ আর ব্রেকফাস্টও যোগ হতে দেখা যাওয়া বিচিত্র নয়। যুক্ত হতে পারে সান্ধ্য ও মধ্যরাত্রিকালীন মেনুও।
চায়নিজ রেস্তোরাঁগুলো সরাসরি করোনার শিকার হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে বা ভারতে চীনের মতো এক্সোটিক প্রাণী দেখা যায় না মেনুতে। তারপরও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে চায়নিজ রেস্তোরাঁ মাড়াতে দেখা যায়নি অনেককেই। ফলে এগুলোর পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানোটা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। বিশেষত যেসব প্রতিষ্ঠান অথেনটিক নয়, ইন্দো-চায়নিজ বা হাক্কা কুজিন পরিবেশন করে।
সচেতনেরা বিয়ের অনুষ্ঠান কাটছাঁট করে ফেলেছে। ইদানীং যে সাত-আট দিন ধরে বিয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের চল শুরু হয়েছিল, তাতে ভাটা পড়েছে। ওয়েডিং প্ল্যানিং তো বটেই, ক্যাটারিং আর ব্যাঙ্কোয়েটিং ব্যবসায়ও কমছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো বেশ কিছু ভ্যানিটি রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে গেছে, যেগুলো বেশ আপস্কেলের আর তারকাদের শখের ব্যবসা হিসেবেই পরিচালিত হতে শুরু করেছিল।
নিউ নরমাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া বাংলাদেশে মুশকিলই বটে। সচেতনতার অভাব, হুজুগ, আইন অমান্য করা, আতঙ্কিত হয়ে যাওয়ার স্বভাব আমাদের মজ্জাগত। মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, ব্যবহৃত পোশাক পরিষ্কারের অভ্যাসটাই এখনো অনেকের আয়ত্তে আসেনি এই ছয়-সাত মাসেও।
আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট