ফুড বেনিফিটস I চিরচেনা চিনি
স্বাদেন্দ্রিয় তৃপ্ত করার জন্য যেসব উৎসদ্রব্য রয়েছে, চিনি সেগুলোর একটি। শরীরের জন্য যেমন, তেমনই রূপচর্চায়ও এর গুণপনা তুলনারহিত
দুধ, ঘি, দই, মধু ও চিনি মিলে পঞ্চামৃত। মিষ্টিরসিকদের কাছে শেষেরটিই সেরা। ডায়াবেটিসের রোগী ছাড়া প্রায় কেউই এটি থেকে বিমুখ নন। সামান্য হলেও খান। অল্প চিনিকেও হেলা করার জো নেই। মধ্যযুগের ইউরোপীয় ধনাঢ্যরাই এই খাদ্য বছরে মাত্র এক চা-চামচ পরিমাণ কেনার সামর্থ্য রাখতেন। মূল্য এতই উচ্চ ছিল যে রানি ইসাবেলা এক ক্রিসমাসে তার মেয়ের জন্য দামি উপহার হিসেবে এক বাক্স চিনি দিয়েছিলেন। ষোলো শতকের শুরুতে মেক্সিকোতে বসানো হয় প্রথম চিনিকল। তখন রানি এলিজাবেথের চিনিপ্রীতি নিয়ে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। তার নাকি এই মিষ্টান্ন ছাড়া চলতই না। ফলে এটি হয়ে ওঠে রাজখাদ্য। এ কারণেই ইউরোপে এই ‘মিষ্টি লবণ’ ছিল সম্পদশালীদের বিলাসিতার আহার্য। মিষ্টি লবণ! মধ্যযুগের আরব বণিকেরা এ নামেই চিনত উপমহাদেশে উৎপাদিত এই খাদ্যকে। ভারতবর্ষে চিনি ছিল র সুগার, ব্রাউন সুগার ও গুড় রূপে। আখ মাড়িয়ে তা তৈরি হতো এখানে। পরিশোধনের পর চীনা সাদামাটির মতো দেখাত বলে হয়তো নাম হয়েছে চিনি। এমন ধারণা অনেকেরই। তবে ইংরেজি ‘সুগার’ নামটি এসেছে সংস্কৃত ‘শকর্রা’ শব্দটি বিকৃত হয়ে। ‘শক্কর’, তারপর সুগার। এখন ১১ পদের চিনি মেলে। উচ্চমাত্রায় পরিশোধিতটিই হচ্ছে সাদা চিনি, যা আমরা প্রতিদিনই খাচ্ছি। এর চেয়ে বেশি শোধিত হলে তাকে বলে সাসটার। এটি সিরাপ ও ড্রিংকসে দেয়। চিনির কেলাস গুঁড়া করে নিলে হয় কনফেকশনারস সুগার। তা বেকড পণ্যে লাগে। কিছু চিনির তাপ সহনীয় ক্ষমতা বেশি। মানে, সহজে গলে না। নাম পার্ল সুগার। তা অন্যান্য চিনির চেয়ে শক্ত। কুকিজ বানাতে ব্যবহৃত হয়। তাপ সইতে পারে স্যানডিং সুগারও। এর দানা আকারে অন্যান্য চিনির চেয়ে বড়। এগুলো বিস্কুটের ওপর ছিটিয়ে দেওয়া হয়। সবচেয়ে কম পরিশোধন করা হয় আখের চিনি। মানবদেহ তা সহজেই শোষণ করতে পারে। কম প্রক্রিয়াজাত আরেকটি চিনি হচ্ছে ডিমেরারা। স্যানডিংয়ের মতো এর দানাও বড়। এটি চা-কফির জন্য ভালো। আখ থেকে পাওয়া কিছুটা বড় দানা ও সামান্য খয়েরি চিনির নাম টারবিনেডো। এটি ক্যারামেল ফ্লেভারের। কোমল পানীয়তে মেশানো হয়। কখনো কখনো আখ প্রক্রিয়াজাত না করে একটু ভেজা ও আঠালো ধরনের চিনি উৎপাদন করা হয়। এর গন্ধ বেশ কড়া। এই চিনির নাম মাসকোভাডো। পরিশোধিত হোয়াইট সুগারের মধ্যে সামান্য মোলাসেস যোগ করা তৈরি চিনিকে বলে লাইট ব্রাউন সুগার। এটিও ক্যারামেল ফ্লেভারের। বেশি পরিমাণে মোলাসেস মেশালে তা আর লাইট ব্রাউন থাকে না, হয়ে যায় ডার্ক ব্রাউন সুগার।
আমাদের দেশে সাধারণত সাদা ও লাল চিনির চল বেশি। উভয় প্রকার থেকেই কিছু উপকারী রাসায়নিক মেলে। যেমন প্রতি ১০০ গ্রাম লাল চিনিতে আছে: শক্তি ১৫৭৬ কিলোজুল, শকর্রা ৯৭.৩৩ গ্রাম, চিনি ৯৬.২১ গ্রাম, থায়ামিন ০.০০৮ মিলিগ্রাম, রিবোফ্লাভিন ০.০০৭ মিলিগ্রাম, নিয়েসিন ০.০৮২ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি৬ ০.০৮৬ মিলিগ্রাম, ফোলেট বি৯ ১ মাইক্রোগ্রাম, ক্যালসিয়াম ৮৫ মিলিগ্রাম, লোহা ১.৯১ গ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ২৯ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ২২ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ১৩৩ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ৩৯ মিলিগ্রাম, দস্তা ০.১৮ মিলিগ্রাম এবং পানি ১.৭৭ গ্রাম। প্রতি ১০০ গ্রাম সাদা চিনিতে আছে: শক্তি ১৬১৯ কিলোজুল, শকর্রা ৯৯.৯৮ গ্রাম, রিবোফ্লাভিন ০.০১৯ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১ মিলিগ্রাম, লোহা ০.০১ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২ মিলিগ্রাম, পানি ০.০৩ গ্রাম। এসব উপাদান থাকায় চিনি শরীরের বিভিন্ন বালাই সারাইয়ের পাশাপাশি ত্বকচর্চা ও গৃহস্থালির টুকিটাকি কাজে লাগে।
চিনির ঘাটতিতে শরীরের শক্তি কমে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে বল ফিরিয়ে আনতে এই মিষ্টিদ্রব্য কিছুটা খেয়ে নেওয়া যেতে পারে। খাওয়ার স্যালাইন তৈরিতেও এটি ব্যবহৃত হয়। রক্তচাপ কমে গেলে এর শরবত পানে উপকার পাওয়া যায়। অ্যান্টিবায়োটিক গুণসম্পন্ন হওয়ায় এই দ্রব্য কাটা স্থানের ক্ষত শুকাতে সক্ষম। চিনি খেলে বিষণ্নতাও কাটে। মেদও হটায়। বিশেষ করে লিভার, প্যানক্রিয়াস ও ইন্টেস্টাইনকে ঘিরে চর্বির যে বলয় তৈরি হয়, তা কমাতে সহায়তা করে।
ত্বকচর্চায়ও কাজে লাগে চিনি। এর গ্লাইকোলিক অ্যাসিড ত্বকের টোন ঠিক রাখে, তৈলাক্তভাব দূর করে এবং দাগ ওঠায়। প্রাকৃতিক স্ক্রাব হিসেবে এর জুড়ি নেই। উজ্জ্বলতা বাড়াতে চিনি ও লেবুর রস মিশিয়ে ত্বকে ম্যাসাজ করা যেতে পারে। এতে মরা চামড়া দূর হয়।
ঘরোয়া কিছু কাজেও চিনির ব্যবহার আছে। খাওয়ার পর অনেক সময় হাত থেকে খাবারের গন্ধ দূর হয় না। এমনকি সাবান দিয়ে ধুলেও না। সে ক্ষেত্রে তরল সাবানের সঙ্গে চিনি ও অলিভ অয়েল মিশিয়ে হাত ধোয়া যেতে পারে। পাশাপাশি হাতের ত্বক হবে নরম ও মসৃণ। এতে শকর্রা থাকে বলে এটি গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা ফুলও অনেকক্ষণ তাজা রাখতে পারে। তিন টেবিল চামচ চিনি এবং দুই টেবিল চামচ ভিনেগার পানিতে মিশিয়ে পাপড়িতে স্প্রে করলে তা সতেজ থাকবে।
কফি ও জুস মেকারের দাগ দূর করা যাবে এই দ্রব্য দিয়ে। এ ক্ষেত্রে এক কাপ চিনি ব্লেন্ডারে নিয়ে পানি ছাড়া ব্লেন্ড করতে হয়। তারপর ধুয়ে ফেললে সব দাগ দূর হয়ে যাবে। চায়ের ফ্লাস্কও পরিষ্কার করা যেতে পারে এটি দিয়ে। ফ্লাস্কে দ্রব্যটির এক চা-চামচ দিয়ে পানিতে গুলে নিতে হবে। কয়েক ঘণ্টা পর ভালোভাবে ঝাঁকিয়ে নিলে চায়ের পাত্রটি বেশ ঝকঝকে দেখাবে।
বিস্কুট, কেকসহ অন্যান্য বেকড ফুড মুচমুচে রাখতে বয়ামের ভেতর চিনির কিউব রাখা যেতে পারে। এটি করলে রুটি এবং চিজও ভালো থাকবে। কাপড় থেকে কালির দাগ ওঠাতেও ব্যবহার করা যেতে পারে। এ জন্য চিনি পানিতে গুলিয়ে দাগের ওপর এক ঘণ্টা রেখে দিতে হয়। রসুইঘরে কিংবা গাড়ির কাজ করতে গেলে অনেক সময় হাতে কালির দাগ লাগে। সাবানে তা পুরোপুরি না উঠলে হ্যান্ডওয়াশের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে ভালো করে ঘষার পর ধুয়ে ফেললে হাতের কালি চলে যায়।
চিনির নানা গুণ এবং ব্যবহার থাকার পরও এটি খাওয়ার ক্ষেত্রে পরিমিতিবোধ প্রয়োজন। কথায় আছে, অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। চিনির ক্ষেত্রেও এটা খাটে।
ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট