স্বাদশেকড় I শষ্কুলী
হাজার বছর পেরিয়ে এর নাম এখন লুচি। হতে হয় ধবধবে সাদা। আছে ‘আড়াই টানে’ বেলার রীতি। আরও জানাচ্ছেন শিবলী আহমেদ
খাই, কিন্তু জানি কি, আহার্য পদটির আঁতুড়ঘর কোথায়? পূজা-পার্বণে বিচিত্র খাবারের মধ্যে লুচির উপস্থিতি চোখে পড়ে। দেবতাদের ভোগে খাদ্যটি দেওয়া হয়। লুচি খাওয়ার চল লাবড়া ও আলুর দম দিয়েই। পূজা-পার্বণ ছাড়াও বাঙালির পাতে কারণে-অকারণে থাকে ময়দার তৈরি এই খাবার। ভাদ্র মাসে জন্মাষ্টমীর সময় বাঙালি হিন্দুবাড়িতে তালের বিভিন্ন পদ তৈরি হয়। সেখানে তালের লুচিও থাকে। সনাতন ধর্মের যেসব উপাচারে ভাত খাওয়া নিষেধ, লুচিই সেখানে ভরসা। জামাইষষ্ঠীতে শাশুড়িরা তা দিয়ে জামাই আপ্যায়ন করেন। কিন্তু এই লুচি এল কোত্থেকে? কী এর আদিকথা?
লুচির উৎপত্তির উল্লেখ প্রথম মেলে একটি চিকিৎসাগ্রন্থে। একাদশ শতকে। তখন পালযুগ। রাজ্যসেরা চিকিৎসক ছিলেন চক্রপাণি দত্ত। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে দক্ষতা ছিল তার। স্বাস্থ্য নিয়ে তিনটি বই লিখেছিলেন তিনি। চিকিৎসাসংগ্রহ, দ্রব্যগুণ এবং সর্বসারসংগ্রহ। লুচির বয়ান মেলে দ্বিতীয় গ্রন্থে। সংস্কৃতে লুচিকে বলে ‘শষ্কুলী’। চক্রপাণি লিখেছেন:
‘সুমিতায়া ঘৃতাক্তায়া লোপ্ত্রীং কৃত্বা চ বেল্লয়েৎ। আজ্যে তাং ভর্জয়েৎ সিদ্ধাং শষ্কুলী ফেনিকা গুণাঃ।’
এ কথার মানে, গমচূর্ণকে ঘি দিয়ে মেখে লেচি করে বেলে গরম ঘিয়ে ভেজে শষ্কুলী তৈরি হয়। এর গুণ ফেনিকার মতো। ফেনিকা মানে খাজা। পাল আমলে তিন রকমের শষ্কুলী ছিল। খাস্তা, সাপ্তা ও পুরি। ময়ান ময়দার লেচি বেলে ঘিয়ে ভাজলে হয় খাস্তা। ময়ান না দিলে সাপ্তা। ময়দার জায়গায় আটা হলে হবে পুরি। পানিযোগে ময়দা মাখার সময় তাতে ভালোভাবে ঘি যুক্ত করাকে ময়ান দেওয়া বলে।
লুচি কীভাবে বেলতে হবে, সেই তরিকা বর্ণনা করেছেন দেবাশিস মুখোপাধ্যায়। তার রচিত ‘খাই, কিন্তু জানি কি’ বইতে। জানিয়েছেন, লুচির ব্যাস তিন-চার ইঞ্চির বেশি হবে না। বলেছেন, ‘লুচি হবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো গোল ধবধবে সাদা আর নিখুঁত। লুচিতে দাগ থাকা আর চরিত্রে দাগ সেকালে একই রকম দোষের মানা হতো।’ ভারতের সুপরিচিত শেফ অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ও এ ধরনের মতামত দিয়েছেন। জানিয়েছেন, লুচির একটা দৃষ্টিগত পরিচয় আছে। এ খাবারের রঙ লালচে হলে ভোজনরসিক বাঙালি তা গ্রহণ করে না।
তবে লুচি তৈরির তিন-চার ইঞ্চি ব্যাসের বিধান সব অঞ্চলে যে মানা হতো, তা নয়। মুর্শিদাবাদ ও তৎকালীন বাংলাদেশের দিনাজপুরের অদূরে কান্তনগরের লুচি আকারে বেশ বড় হতো। দিনাজপুরের এক রাজবাড়িতে ‘বগি’ থালার মতো বড় করে এটি তৈরি হতো বলে জানা যায়। সেই লুচি যতক্ষণ পর্যন্ত না ভাঙা হয়, ততক্ষণ ফোলা থাকত। খাওয়া হতো ডাল কিংবা ক্ষীর দিয়ে। বড় আকারের ছাড়া ছোট লুচির নজিরও মেলে। পশ্চিম মেদেনীপুরে তামার পয়সার আকারে তা বেলা হতো। সাহিত্যিক মণিশঙ্কর মুখার্জির মত, কলকাতা থেকে দূরের জেলাগুলোয় লুচির আকৃতি তুলনামূলক বড়। যতই কলকাতার কাছাকাছি আসা যায়, ততই তা ছোট হতে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের ইংরাজ বাজারের অদূরে সাদুল্লাহপুর শ্মশান অঞ্চলে হাতিপায়া নামে একধরনের লুচি পাওয়া যায়। সেটি হাতির পায়ের মতোই বড়সড়। মকরসংক্রান্তিতে পুণ্যার্থীরা ভাগীরথী নদীতে স্নানের পর সেই লুচি খেয়ে থাকেন। তা কেজি দরে বিক্রি হয়।
তাহলে দেবাশিস মুখোপাধ্যায় যে তিন-চার ইঞ্চি ব্যাসের লুচির কথা বললেন, সেটি কারা তৈরি করত? এর উত্তর মেলে মিলন দত্ত রচিত ‘বাঙালির খাদ্যকোষ’ বইয়ে। লিখেছেন, ‘উত্তর কলকাতার বনেদি বাড়ির লুচির ব্যাস চার ইঞ্চির বেশি হবে না।’ বইটিতে আরও লেখা হয়েছে, ‘লুচি হলো বাঙালির সবচেয়ে প্রিয় নোনা খাবার।’ ওপরে পালযুগের যেই খাস্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটিই বর্তমান বাংলার নোনতা লুচি।
বাঙালিরা নাকি লুচি তৈরি করতে শিখেছে মুসলমানরা এই অঞ্চলে আসার পর; এমন কথা বলেন কেউ কেউ। ‘আইন-ই-আকবরী’তেও খাবারটির নাম আছে। দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীর বউ কিরণলেখা রায় ‘জলখাবার’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩১ সনে। সেখানে দুই ধরনের লুচির উল্লেখ পাওয়া যায়। ময়দার সঙ্গে সুজি মিশিয়ে ‘টগবা’ ও ‘কচমচিয়া লুচি’।
মানিকলাল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ধর্মমঙ্গলেও আছে লুচির কথা। সেখানে এটিকে জনপ্রিয় খাবার বলা হয়েছে। ১৮৫৪ সালে রামনারায়ণ তর্করত্ন ‘কুলীনকুল সর্বস্ব’ নামে যে গ্রন্থ প্রকাশ করেন, তাতে লুচিকে উত্তম ফলারের সর্বপ্রথম খাদ্য হিসেবে লেখা হয়েছে। তবে তা হতে হবে ঘিয়ে ভাজা। ভাত ছাড়া অন্যান্য নিরামিষ পদযুক্ত আহারকেই ফলার বলে।
বর্তমানে লুচি তৈরির মূল উপকরণ ময়দা, পানি, লবণ ও ঘি। ফোলার জন্য তাতে কোথাও কোথাও সুজি মেশানো হয়। অল্প চিনি যোগ করলেও ফোলে। ঘিয়ের বেশি দামের জন্য এখন সরিষার তেল দিয়ে ভাজা হয়। কোথাও আবার ডালডা দিয়ে কাজ সারে। তবে ভালো মানের লুচিতে ময়ান দেওয়া লাগবেই। ১৬ ভাগ ময়দায় ১ ভাগ ঘি দিলেই ময়ান হয়। ময়দা যত বেশি মাখা হবে, লুচি হবে ততই মোলায়েম। কোথাও কোথাও এর লেচি আড়াই টানে বেলার প্রথা আছে। ফুলকো লুচি বেগুনভাজা, আলুর দম কিংবা মাংসযোগে খাওয়ার চল। একসময় বিয়ের পাকাকথার দিনে পাত্রপক্ষকে লুচি ও আলুর দম দিয়ে আপ্যায়নের রীতি ছিল। বিয়ের খাবারের প্রথমেই দেওয়া হতো এই পদ। সঙ্গে বোঁটাসমেত লম্বা করে কাটা বেগুনভাজা। ১৯৬০ সালে এ ধরনের আপ্যায়ন প্রচলিত ছিল বিয়েতে। কোথাও কোথাও লুচির সঙ্গে বাদাম কিংবা শাক দেওয়া হতো। জানা যায়, ১৯৭০ সাল থেকে এর সঙ্গে কাশ্মীরি আলুর দম খাওয়া শুরু হয়। এখন অবশ্য আমিষ কিংবা নিরামিষ- উভয় সহপদযোগেই খাওয়া হয় লুচি। তবে তৈরির প্রক্রিয়া ও পুষ্টিগত মৌলিকতা এখন আর নেই।
ছবি: ইন্টারনেট