skip to Main Content

কভারস্টোরি I মায়াবী মহামায়া

‘দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন’- এই ব্রত দেবী দুর্গাকে যত মহিমান্বিত করুক না কেন, তার বিশেষ একটি রূপ অগোচরেই থেকে যায়। সেটি তার মানসিক সৌন্দর্য। কালপরম্পরায় তার বদল ঘটেছে। এতেও রয়েছে বৈচিত্র্য। বাংলার পূজারিরা তাকে মনের মাধুরী দিয়ে নানাভাবে সাজিয়ে এসেছেন। লিখেছেন অরিন্দম পাল ঝিনুক

আজ রণ-রঙ্গিণী জগৎমাতার দেখ্ মহারণ,
দশদিকে তাঁর দশ হাতে বাজে দশ প্রহরণ!
পদতলে লুটে মহিষাসুর,
মহামাতা ঐ সিংহ-বাহিনী জানায় আজিকে বিশ্ববাসীকে-
শাশ্বত নহে দানব-শক্তি, পায়ে পিষে যায় শির পশুর!’
‘আগমনী’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম এভাবেই স্বদেশের বুকে রণরঙ্গিণী দশভুজার আবাহন করেছিলেন। সর্বশক্তি স্বরূপিণী আদ্যাশক্তি এই মহামায়া দুর্গা, যার আরেক নাম মহিষাসুরমর্দিনী। অশুভ, অন্যায়, পাপ, পঙ্কিলতার বিরুদ্ধে ন্যায়, পূর্ণ, সত্য, শুভ ও সুন্দরের প্রতীক। আদ্যাশক্তি মহামায়ার কৃপালাভের জন্য দুর্গাদেবীর আরাধনা। শত্রু বিনাশে যেমন ভয়ংকর আবার ভক্তের কাছে তেমনি স্নেহময়ী জননী, কল্যাণ প্রদায়িনী। তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও লিখে গেছেন-
‘ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।’
প্রকৃতির সাজেও তখন যেন এই কল্যাণের বার্তা ছড়িয়ে থাকে। আকাশে নানা বর্ণের রাশি রাশি মেঘ। এই রোদ, এই বৃষ্টি। বাতাসেও তার স্নিগ্ধতা অনুভব করা যায়। তার প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনেও।
মার্কণ্ডেয় পুরাণের কাহিনির সঙ্গে সংগতি রেখে দেবী দুর্গার অসুরনাশিনী রূপে প্রতিমা গড়ে পূজার আয়োজন করা হয়। বাঙালি ভক্ত জানেন, আসলে ওই পূজা আর কিছু নয়, এক বছর উমা স্বামীগৃহ কৈলাস ছেড়ে কন্যা রূপে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে মা-বাবার বাড়িতে এসেছেন। তারপর আবার ফিরে যাবেন স্বামী শিবের কাছে।
দুর্গাপূজা কবে, কখন, কোথায় প্রথম শুরু হয়েছিল, তা নিয়ে নানা মতভেদ রয়েছে। ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃতান্ত্রিক এই জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন। আর্য সভ্যতায় প্রাধান্য ছিল দেবতাদের। অনার্য সভ্যতায় দেবীদের- তারা পূজিত হতেন আদ্যাশক্তির প্রতীক রূপে। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের গঠন, দায়িত্ববোধ ও উর্বরতাশক্তির সমন্বয়ের কথা বিবেচনা করে অনার্য সমাজে গড়ে উঠে মাতৃপ্রধান দেবী সংস্কৃতির ধারণা। ভারতে অবশ্য এই ধারণা অতি প্রাচীন। প্রায় ২২ হাজার বছর আগে এই অঞ্চলের প্যালিওলিথিক জনগোষ্ঠী থেকেই দেবী পূজা প্রচলিত। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো তথা সিন্ধু সভ্যতায় এসে তা আরও গ্রহণযোগ্য ও বিস্তৃত হয়। মাতৃতান্ত্রিক পরিবারের মা-ই প্রধান, তার নেতৃত্বে সংসার পরিচালিত হয়। এই মত অনুসারে দেবী হলেন শক্তির রূপ, তিনি পরব্রহ্ম। শাক্ত মতে, কালী বিশ্ব সৃষ্টির আদি কারণ। অন্যান্য দেব-দেবী মানুষের মঙ্গলার্থে তাদের বিভিন্ন রূপের প্রকাশমাত্র। মহাভারত অনুসারে, দুর্গা বিবেচিত হন কালীশক্তির আরেক রূপে। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে, দুর্গাপূজার প্রথম প্রবর্তক কৃষ্ণ, দ্বিতীয়বার এটি করেন স্বয়ং ব্রহ্মা আর তৃতীয়বার আয়োজন করেন মহাদেব। আবার দেবী ভাগবত পুরাণ অনুসারে জানা যায়, ব্রহ্মার মানসপুত্র মনু ক্ষীরোধ সাগরের তীরে দুর্গার আরাধনা করে বর লাভে সফল হন।
কালিকা পুরাণ ও বৃহদ্ধর্ম পুরাণ অনুসারে রাম ও রাবণের যুদ্ধের সময় শরৎকালে দুর্গাকে পূজা করা হয়েছিল। হিন্দুশাস্ত্র মতে এই ঋতুতে দেবতারা ঘুমিয়ে থাকেন। তাই সময়টি তাদের পূজার জন্য উপযুক্ত নয়। অকালের পূজা বলে এর আরেক নাম অকালবোধন। উক্ত দুই পুরাণ অনুসারে রামকে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মা দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন। মূল বাল্মীকির রামায়ণে, এই পূজার কোনো অস্তিত নেই। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে তা আছে। সেখানে রাম স্বয়ং দুর্গার বোধন ও পূজা করেছিলেন।
দুর্গাপূজা হলো বাঙালির অধ্যাত্ম শিল্পকলা। এই উৎসবের প্রধান প্রেরণা আধ্যাত্মিক হলেও একাধারে তা পরিণত হয়েছে মিথলজি, দর্শন, ভাস্কর্য, চিত্রকলা, আলোকশিল্প, সংগীত, নৃত্য, বাদ্য ও আবৃত্তির এক সুন্দর সমন্বয়ে। পৃথিবীর আর কোনো উৎসবে এভাবে শিল্পের সঙ্গে আনন্দের একত্র সমাবেশ ঘটেনি। এটি মাটির পৃথিবীতে সত্য ও সুন্দরের পরশ বুলিয়ে দেয়। পৃথিবীকে বাঙালিই প্রথম এই বাঙ্ময় উৎসবের সন্ধান দিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বাংলাদেশ ও আসাম নিয়ে প্রাচীন বঙ্গদেশ গঠিত। বাংলা হাজার হাজার বছরের শক্তি-উপাসনার পীঠস্থান। বঙ্গদেশে এই উপাসনায় অন্যতম প্রধান আরাধ্য দেবী হলেন মহিষাসুরমর্দিনী। তার বার্ষিক পূজানুষ্ঠান বাংলার হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব এবং ধ্রুপদি বাঙালি সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য উপাদানও বটে। দুর্গোৎসব ঘিরে এই অঞ্চলের মৃৎশিল্প বিকশিত হয়েছে। সেই সঙ্গে এখানে প্রতিমা নির্মাণ ও সাজসজ্জার ঐতিহাসিক একটি প্রেক্ষাপটও রয়েছে। দুর্গা প্রতিমা তৈরির প্রাচীন রীতিকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। একটি হলো ‘বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা’, অন্যটি ‘কংসনারায়ণ রীতির প্রতিমা।’ বার্ষিক শারদীয়া পূজার সময় পাথরের পরিবর্তে কাদামাটি দিয়ে প্রতিমা নির্মাণের রীতি আজ থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে সূচনা হয়েছে। প্রতিমাশিল্পে কাদামাটির ব্যবহারের পথিকৃৎ ছিলেন বাংলার দুই রাজা। একজন হলেন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মল্লরাজা জগৎমল, অপরজন পূর্ববঙ্গের (বর্তমানে বাংলাদেশ) রাজশাহীর তাহেরপুরের কংসনারায়ণ। তারা দুজন দুটি পৃথক ধ্রুপদি বাংলারীতির মৃৎপ্রতিমা নির্মাণ শুরু করেন। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে এই দুটি রীতির প্রতিমাশিল্পের প্রচলন রয়েছে। সময়ের ধারাবাহিকতায় নানান বিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রতিমার গড়ন, নির্মাণ, সাজসজ্জা ও উপস্থাপনায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। কালের ধারায় প্রতিমা নির্মাণ ও সাজে পড়েছে একেক সময়ের ছাপ। অঞ্চলভেদে নানান ইতিহাস-ঐতিহ্য, জীবন-আচার, মূল্যবোধ ও রুচির প্রকাশ ঘটেছে প্রতিমাশিল্পের উপস্থাপনায়।
এই প্রসঙ্গে সাভারের প্রবীণ প্রতিমা নির্মাণশিল্পী বাবুল পাল বলেন, ‘গত তিরিশ বছরে প্রতিমা নির্মাণে অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রথমে আশির দশকে মাটির ওপর নকশা করা মূর্তির প্রচলনই ছিল বেশি। কেননা সেই সময়ের খদ্দেররা হাতের নকশায় তৈরি নিখুঁত কাজের প্রতিমা বেশি পছন্দ করতেন। হাতের নকশার মাধমেই মূর্তির মুখ, শরীর, পোশাক, গয়নাসহ সবকিছুই নান্দনিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হতো। তখন শিল্পীরা প্রতিমার গড়ন ও অবয়বকে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। এ নিয়ে প্রতিযোগিতাই ছিল শিল্পীদের মধ্যে। সেই সময়ের মূর্তির বৈশিষ্ট্য ছিল মাত্র একটি কাঠামোর ওপর সব মূর্তি নির্মাণ করা। আকৃতির দিক থেকেও হতো বলিষ্ঠ ও বড়। তাই মূর্তির ওজনও অনেক বেশি ছিল। মূর্তিতে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার খুব বেশি দেখা যেত। নির্মাণের উপকরণ হিসেবে তখন ব্যবহৃত হতো কাঠ, রশি, খড়, পাঠখড়ি, মাটি। মন্ডপের প্যান্ডেল সাজানোর জন্য থাকত রঙিন শাড়ি। নব্বই দশকে এসে আলাদা কাঠামোর মূর্তি তৈরির প্রচলন শুরু হলো। পাতলা গড়নের মূর্তির ওপর যোগ হলো গরদ শাড়ি, চিকন পাড়ের ধুতি, গয়না, কৃত্রিম কোঁকড়া চুল, পাতলা টিনের তৈরি অস্ত্রসহ নানান রকমের উপকরণ। এ সময় শুরু হলো ডাক ও শোলার কাজের প্রচলন, মন্ডপের প্যান্ডেলে হাতের কাজ করা কাপড়ের ব্যবহার। বাড়ল আলোকসজ্জা। নব্বই দশকের পর মূর্তি নির্মাণে এলো অনেক পরিবর্তন। বিভিন্ন থিমের ওপর ভিত্তি করে এর প্রচলন হয়। সমসাময়িক চিন্তা ও প্রযুক্তিকেও কাজে লাগানো হলো। মানুষের সমান আকৃতির স্লিম ফিগারের মূর্তিতে লাগল সমকালীনতার ছোঁয়া। ম্যাট ও আন্ডারটোন রঙের প্রয়োগ ঘটানো হলো। মূর্তির অঙ্গসজ্জায় যুক্ত হলো কাতান-বেনারসি-সিল্ক শাড়ি, মোটা পাড়ের ধুতি, জড়োয়া ও ভারী গয়না, কৃত্রিম সিল্কি চুল, মোটা টিনের তৈরি অস্ত্রসহ নানান রকমের উপকরণ। আর মন্ডপের প্যান্ডেলে ব্যবহার শুরু হলো কাঠ ও কর্কশিটের ডিজাইন করা নকশা। সৌন্দর্য বাড়াতে আরও যুক্ত হলো অত্যাধুনিক আলোকসজ্জা।’
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রভাষক ও ভাস্কর্যশিল্পী লাকি ওসমান বলেন, ‘দুর্গাপূজার পুরো প্রতিমা একটি যুদ্ধের ভাস্কর্য। এই প্রতিমায় সরস্বতী আর লক্ষ্মী ছাড়া সবার হাতেই অস্ত্র। যদিও নিরস্ত্র এই দুই দেবী এমন দুটি বিষয়ের অধিষ্ঠাত্রী, যা না থাকলে অন্য সব অস্ত্রই নিরর্থক হয়ে যায়। এর একটি হলো ‘সম্পদ’ আর অন্যটি ‘জ্ঞান’। প্রাচীন পুরাণের পৃথিবীতে যেমন জ্ঞান আর সম্পদ না হলে যথার্থ শক্তির অধিকারী হওয়া যেত না, এই একুশ শতকের পৃথিবীতে তা অধিকতর সত্য হয়ে উঠেছে। জ্ঞান আর সম্পদই এখন শক্তির প্রধান উৎস। এত যে যুদ্ধের প্রদর্শনী, কিন্তু কী আশ্চর্য, এই পূজার কোথাও যুদ্ধবন্দনা নেই। প্রতিমায় যতই শক্তির সব প্রতীক ফুটে উঠুক, বাঙালি হিন্দুর কাছে এ এক স্নিগ্ধ মাতৃবন্দনা। আর এই অঞ্চলের প্রতিমা নির্মাণ ও সাজে আমাদের নিজস্বতা আছে। এখানে মূর্তির গড়ন ও অবয়বে যেমন ফোক আর্ট ফর্মের অনেক মোটিফ পাওয়া যায়, তেমনি পাশ্চাত্য শিল্পের ছোঁয়াও লেগেছে কখনো কখনো।’
একই প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার চন্দ্র শেখর সাহা বলেন, ‘বিগত দিনে দুর্গা প্রতিমার সাজসজ্জা ও ভাস্কর্য নির্মাণে পটুয়াদের যেমন শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল, আজও তা সমানভাবে উজ্জ্বল। যদিও সাবেকি ধারার প্রতিমা তৈরির নিপুণতা, দক্ষতা, সৃজনশীলতা ও পরম্পরাকে স্মৃতিতে ধারণ করে আজও কাজ করে চলেছেন, তেমন কারুশিল্পীর সন্ধান পাওয়া সহজ নয়। চলচ্চিত্র, গ্লামার জগৎ ও সমকালীন ট্রেন্ডের প্রভাবে দুর্গা প্রতিমার নতুন নতুন মুখভঙ্গির উপস্থাপন, অসুরের নাটকীয় আগমন ইত্যাদি পরিলক্ষিত হচ্ছে এপার বাংলা পূজা কমিটির উদ্ভাবনী চিন্তার কারণে।’
নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মা পূজার একাল-সেকাল নিয়ে বলতে গিয়ে এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘মধ্যবিত্তদের বারোয়ারি পূজা চাঁদা তুলে সম্পন্ন হতো। কিন্তু আজকের করপোরেট পূজা মানে অনেক বড় মাপের অনুষ্ঠান। তাতে অর্থ জোগান দেয় বড় বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। আড়ম্বরতা অনেক বেশি থাকে। এতে যুক্ত হয় নানা শ্রমজীবী মানুষ, বড় বড় শিল্পী এবং ভাস্কররাও। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিমার আদল এতটাই বদলে ফেলা হয়েছে যে আমাদের কিশোরকালের দুর্গা প্রতিমাকে চিনতেও পারি না। আর মন্ডপগুলো হয় রাজকীয়। বিভিন্ন থিমনির্ভর তাতে থাকে ইতিহাস, বিপ্লব, প্রকৃতি ও পরিবেশ- দূরদেশের গ্রাম ইত্যাদি প্রসঙ্গ। শারদ উৎসব দুর্গাপূজার এই রূপান্তর রীতিমতো এখন গবেষণার বিষয়।’
একালও একদিন আগামী সময়ে সেকালেই পরিচিত হবে। আনন্দ উৎসব ও উদযাপন রইবে তার আপন মহিমায় কালের প্রেক্ষাপটে, প্রতিদিন নতুন ভঙ্গিমায় থাকবে চলমান। সর্বজনীন দুর্গাপূজা সবার জন্য, সবার কল্যাণে এক মহামিলনের ধর্মনিরপেক্ষ সংগীতের সমাহার। কিন্তু কিছু ঐতিহ্য সব সময়ই অমলিন থেকে যায়, থেকে যাবে। যেমন পূজার মেলা, নাগরদোলা, গজা-মুরালি-সন্দেশের দোকান, আলোঝলমলে মন্ডপগুলো, মাইকে গান- এসব এখনো চোখে পড়ে। সারা দিন ঢাকিদের সমাগম, ভক্তদের ভিড়, পুরোহিতদের হাতে ভক্তের প্রসাদ গ্রহণ, সন্ধ্যায় আরতি, গান ও নৃত্য- সব মিলিয়ে উৎসবের ছোঁয়ার কমতি নেই কোথাও। দিন পাল্টেছে, হয়তো নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। কিন্তু উৎসবের এই চিরাচরিত রূপ বদলায়নি এতটুকু। পূজার সাজপোশাকেও সেকেলে ভাবটা থেকে গেছে। পূজা মানেই পাড়ার দিদি-বউদিদের এক প্যাঁচে পরা গরদের শাড়ি। লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরে আলতা রাঙা পায়ে নূপুর পরে পূজামন্ডপে আসবেন তারা। ধুতি, সাদা পাঞ্জাবি উঠে যায়নি, বরং পরনের কেতায় এসেছে নানা বৈচিত্র্য। পূজার নৈবেদ্যও পুরোনো ধারা বজায় রেখেছে ভক্তরা। মৌসুমি ফলের ভোগের পাশাপাশি খিচুড়ি, প্রসাদ, মিষ্টান্ন কি বাঙালি সহজে ভুলতে পারে! তারপর রয়েছে মন্ডা-মিঠাই, মুড়ি-মুড়কি।
দুর্গাপূজা একই সঙ্গে সনাতনী ও সাম্প্রতিক। পৃথিবীর কোনো উপাসনায় পুরাণ এমন বাস্তব হয়ে ওঠেনি। কোনো পৌরাণিক উপাখ্যান এভাবে প্রতিবছর উৎসবে পরিণত হয় না। বস্তুত পুরাণ হলো মৃত পৃথিবীর এক প্রতীকী প্রচ্ছদ, সব পুরাণ তাই এখন চিরস্থায়ী ঘুমে মগ্ন। পুরাণকে এভাবে একুশ শতকের এই পৃথিবীতে টেনে এনে কে পারে জননী-ঈশ্বরের উপাসনা করতে? পারে বাঙালি হিন্দু; অধ্যাত্ম চর্চা ও উপাসনায়ও সে শিল্পীর মতো সৃজনশীল। এ জন্য মার্কন্ডেয় পুরাণের মহামায়া তার ঘরে এসে পরিণত হয় কন্যা ও জননীতে। দুর্গা অর্চনার এই উৎসব পৃথিবীকে এখনো শিখিয়ে যাচ্ছে : ঈশ্বর শুধু প্রভু নয়, পিতা নয়, ঈশ্বর মানুষের মাতাও হয়ে উঠতে পারে। বাংলার এই ভক্ত মানুষের কারণেই তো স্রষ্টাকে এখনো মা বলে ডাকা যায়!
প্রতিমা হলো মানব মননে সৃষ্টি হওয়া ঈশ্বরমূর্তি। সব মানুষই তাই প্রতিমা গড়ে। কারও মাটির, আবার কারও প্রতিমা মনের। মাটির পুতুল পূজার পরে বিসর্জন দেওয়া হয়, মনেরটার কখনো হয় না। বাইরের প্রতিমাগৃহ দেখে যে হেলা করে, অন্তরে তারও রয়েছে অন্য রকম আরেকটি প্রতিমাগৃহ। মাটির প্রতিমার নাম যদি হয় পৌত্তলিকতা, কল্পনায়ও তাই। এটি সর্বাংশে মানবীয় ও প্রতিভাদীপ্ত। পৌত্তলিকতাহীন মানুষ হলো শিল্পকলাশূন্য। দৃশ্যত দুর্গাপূজা হয়ে উঠেছে শিল্পকলা এবং পুরাণের আনন্দিত উপস্থাপনা; আর তত্ত্বের বিচারে তা মহাবিশ্বের আদিশক্তি ও অনাদি অস্তিত্বের সামনে মানুষের সামান্যতার নতজানু সমর্পণ। ধর্মীয় উৎসবও যে কতখানি সৌন্দর্যমন্ডিত ও সর্বজনীন হওয়ার সামর্থ্য রাখে, দুর্গাপূজা সে কথাই আমাদের জানিয়ে দেয়।
সংকটাপন্ন করোনাকালে তাই দেবীর চরণে ভক্তদের কাতর মিনতি অসুররূপী জীবাণুর সঙ্গে এই লড়াইয়ে যেন আমরা বিজয়ী হতে পারি। এবারের দুর্গোৎসব যেন আমাদের সামাজিক বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করে। সৌহার্দ্য, হিংসা, বিদ্বেষ, কলুষতামুক্ত ভালোবাসার স্পন্দনে মথিত ও গৌরবান্বিত করে তোলে সবাইকে। পরিশেষে আবারও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই গানের কথাটাই মনে পড়ে গেল-
‘শস্যখেতের সোনার গানে
যোগ দে রে আজ সমান তানে,
ভাসিয়ে দে সুর ভরা নদীর
অমল জলধারে।
যে এসেছে তাহার মুখে
দেখ্ রে চেয়ে গভীর সুখে,
দুয়ার খুলে তাহার সাথে
বাহির হয়ে যা রে।
শরতে আজ কোন্ অতিথি
এল প্রাণের দ্বারে।
আনন্দগান গা রে হৃদয়,
আনন্দগান গা রে।’

কভার: শিলা
ওয়্যারড্রোব: সামা সিল্ক
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ফারাবী তমাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top