skip to Main Content

ফিচার I পুরোনো বঙ্গের বিবাহভোজ

কেমন ছিল বিয়ের উৎসবে শতাব্দীপ্রাচীন খাবারের পদগুলো? সেসবের অন্তরালের গল্প আর উন্মোচিত বিভ্রমের রূপই-বা কেমন? লিখেছেন পাঞ্চালী দত্ত

আজকাল মধ্যবিত্তরাও ডেস্টিনেশন ওয়েডিংয়ের কথা ভাবে। সাদামাটা বিয়েবাড়ির চেয়ে নামকরা হোটেলে বা কমিউনিটি সেন্টারে ব্যবস্থা করে। গত ৪০-৪৫ বছরের মধ্যে কীভাবে পাল্টে গেল বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। বদল হলো খাওয়াদাওয়ার রকমে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা গেল
কৃষ্ণনগরের নদীয়ার কোনো এক রাজার বিয়ের সাদাকালো ছবি। সঙ্গে ছিল ভোজের মেনু। তাতে ছিল বিষ্ণুভোগ, টিকলি পোলাও, মাটন ক্রকেট পোলাও, কঙ্কা শাক ভাজা, কুমড়ার হুশেইন শা, ফুলকপির মিটি মুখ ইত্যাদি। এ ছাড়া হাঁড়ি কাবাব, রোস্ট, মাটন কোর্মা কারি, কালিয়া, চিতল রসা- এ রকম নানা পদের ছড়াছড়ি তো ছিলই।
এক শ বছর আগে কলকাতার বিত্তশালী পরিবারের অনুষ্ঠানের খাবারদাবারের কিছু নমুনা পাওয়া যায় শরৎকুমারী চৌধুরানীর লেখায়, ‘রান্না হইয়াছে পোলাও, কালিয়া, চিংড়ির মালাইকারি, মাছ দিয়া ছোলার ডাল, রোহিতের মুড়া দিয়া মুগের ডাল, আলুর দম, মাছের চপ, ছক্কা, চিংড়ির কাটলেট, ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা, পটোল ভাজা, দই মাছ, চাটনি; তারপর লুচি, কচুরি, পাঁপড় ভাজা; একখানি সরাতে খাজা, গজা, নিমকি, রাধা বল্লভি, শিঙাড়া, দরবেশ, মেঠাই; একখানা খুড়িতে আম, কামরাঙা, তালশাঁস ও বরফি সন্দেশ; আর একখানায় ক্ষীরের লাড্ডু, গুজিয়া, গোলাপজাম ও পেরাকী। ইহার উপর ক্ষীর, দধি, রাবড়ি ও ছানার পায়েস। বাবুদের জন্য মাংসের কোর্মা ছিল, কিন্তু মেয়েরা অনেকেই মাংস খান না, এ জন্য তাহা মেয়েদের মধ্যে পরিবেশন করা হইল না।’
এ তো গেল তখনকার সময়ের বড়লোকদের বিয়েবাড়ির মেনু। কিন্তু কলকাতার সাদামাটা গেরস্ত বাড়ির ভোজের পদে ছিল শুক্তো, দু-এক রকম ডাল, দু-তিন রকম ভাজা, শাকের ঘন্ট, মোচার ঘন্ট, ছ্যাঁচড়া, মাছের ঝোল, অম্বল, পায়েস, কলার বড়া ইত্যাদি। এগুলো এক শ দেড় শ বছর আগের পদ। দ্বাদশ শতাব্দীতে হিন্দু পুরাণ গ্রন্থে নৈষধকাব্যে নল রাজার বিবাহে বরযাত্রীদের কেমন ভোজ খাওয়ানো হয়েছিল, তার বর্ণনা রয়েছে। পাচকশিল্পীদের বিচিত্র খাদ্য প্রস্তুতি দেখে সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিল। ‘আকালিক বস্তু’ অর্থাৎ অন্য ঋতুর ফল, সবজির মতো মনে হয়েছিল। এমনকি নিরামিষ খাদ্যকে আমিষ ও আমিষ খাদ্যকে নিরামিষ বলে ভুল করেছিল। অবাক হওয়ার পালা এখানেই শেষ নয়, বরযাত্রীরা কন্যার সহোদর দ্বারা প্রদত্ত ‘তাম্বুল মুখে অর্পণ করিয়া, তাহাতে হঠাৎ কর্পূর কস্তুরী খদিরসার প্রভৃতি নির্মিত বৃশ্চিক দেখিয়া, ভয়ে আড়ষ্ট হইয়া, তাড়াতাড়ি তাম্বুল পরিত্যাগ করিয়াছিলেন। ইহা দেখিয়া সমস্ত লোক হো হো করিয়া হাসিয়াছিল।’ শুধু তা-ই নয়, সবুজবর্ণ পাত্রে এমনভাবে ভাত-তরকারি পরিবেশিত হয়েছিল যে বরযাত্রীরা তা বুঝতে না পেরে ভেবেছিল, সেগুলো বোধ হয় সবুজ রঙের সবজি। এখানেও তারা জব্দ। এ ছাড়া ছিল দই ও রাই সরিষায় প্রস্তুত শ্বেতবর্ণ কিন্তু ঝালযুক্ত ব্যঞ্জন। হরিণ, ছাগল এবং পাখির নানা রকম রান্না, বিভিন্ন মাছের পদ, বিবিধ সুগন্ধি ও প্রচুর মসলাযুক্ত ব্যঞ্জনাদির উল্লেখ পাওয়া যায় এই বিবাহভোজে। অনেক ধরনের সুমিষ্ট পিষ্টক, দই, পানীয় পরিবেশিত হয়েছিল কর্পূরমিশ্রিত সুগন্ধি জলে।
তখন কলকাতায় বনেদিবাড়িতে দেখনদারির জন্য অনুষ্ঠান লেগেই থাকত। বিয়ে হলে তো কথাই ছিল না। অনুষ্ঠানের কদিন আগে থেকে বসত ভিয়েন। পান্তুয়া, জিবেগজা, চিত্রকূট, প্যারকি, সন্দেশ, বোঁদে, নিমকি, লবঙ্গ লতিকা অর্থাৎ হরেক রকম মিষ্টি তৈরি করতেন হালুইকরেরা। উনিশ শতকে বিয়ের ভোজের বর্ণনা পাওয়া যায় মহেন্দ্রনাথ দত্তের লেখায়, ‘কলাপাতায় বড় বড় লুচি আর কুমড়োর ছক্কা। কলাপাতার এক কোণে একটু নুন। মাষকলাই ডালের পুরে আদা মৌরি দিয়ে কচুরি, নিমকি, খাজা, চৌকো গজা, মতিচূর- এসব সরায় থাকিত। আর চার রকম সন্দেশ থাকিত। গিন্নিরা নিজেরাই রাঁধিতেন। একদল লোক খুঁত ধরে ভোজ পন্ড করে দিত বলে মেয়েরা আর রাঁধিতেন না।’
সময় পাল্টেছে। এখন আগেকার দিনের মতো পাড়ার ছেলেদের এসে প্রতিবেশীর বিয়েবাড়িতে খাবার পরিবেশনের দায়িত্ব নিতে হয় না। পাশের বাড়ির মা-কাকিমাদের রাত জেগে সন্দেশ বানানো, পানের ডালা সাজানোর দরকার পড়ে না। আজকাল কমিউনিটি সেন্টার বা রেস্তোরাঁয় বিশাল সাজানো ঘরে সবই মেলে।

সেখানে বিয়ের সব ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য মঞ্চসজ্জা থেকে অতিথি আপ্যায়নের যাবতীয় ব্যবস্থা থাকে। রাত জেগে বন্ধুবান্ধব মিলে আর সাজাতে হয় না কুঞ্জ, বাসরঘর কিংবা বসার ঘর। অতিথিরা আসে, আশীর্বাদ করে উপহার দিয়ে প্লেট তুলে নেয় হাতে। সেলফ সার্ভিস। ফুচকা থেকে ফিরনি- কী নেই মেনুতে! বুফে কথাটার সঙ্গে আমরা এখন খুব পরিচিত। বিয়ের ভোজে বাঙালি খাবারের পাশাপাশি সাউথ ইন্ডিয়ান, মোগলাই, আওয়াধি, গুজরাতি, নর্থ ইন্ডিয়ান, চায়নিজ, ইতালিয়ান, ইউরোপিয়ান, কন্টিনেন্টাল- কী নেই! স্যালাড যে কত রকম! দই, মিষ্টি, কেক, পায়েস, আইসক্রিম, কোমল পানীয় ইত্যাদির দেখা মেলে। ফুচকার স্টল এখন এড়িয়ে যায় অনেকেই। কেননা, ওখানে পা পড়লে বিরিয়ানি অব্দি আর পৌঁছানো যাবে না। মানে, বিরিয়ানি খেতেই হবে! গ্রিলড আইটেমগুলোও লা-জবাব। একটু একটু কামড়, সঙ্গে ঠান্ডা পানীয়।
কিন্তু এত এত খাবার চারপাশে থাকা সত্ত্বেও এখনকার মেনুতে একটা জিনিসের বড় অভাব! বুফে টেবিলে তার স্থান নেই বললেই চলে। খাবারটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আন্তরিকতার ছোঁয়া আর গল্পের মৌতাত। তা হলো কাকিমা, জেঠিমাদের পানের বাটা। এটির সঙ্গে কত কত খোসগল্প, হাসিঠাট্টায় মুখরিত হয়ে থাকত বিয়েবাড়ি। আজকালকার ঠোঁটের কোণে সাজানো মুচকি হাসি, আলোর রোশনাই, ম-ম করা ফুলের গন্ধ, ভেসে আসা বিরিয়ানি, কষা মাংস, থাই গ্রেভি, লাইভ কিচেনের হল্লা ইত্যাদির আমেজকে এক নিমেষে হারিয়ে দিতে পারে ফেলে আসা বিয়েবাড়ির সেই কাঁসার হাতার গরম গরম ঝোল, পানের বাটার আড্ডা।

লেখক : ফুড জার্নালিস্ট, কালিনারি আর্টিস্ট, কলকাতা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top