বিশেষ ফিচার I হনুজ, দিল্লি দূর অস্ত
পুরোনো এই শহরের পথে পথে ইতিহাসের আমন্ত্রণ। তা এখানকার খাদ্যসংস্কৃতিতেও ছড়িয়ে আছে। বর্ণনা করেছেন আল মারুফ রাসেল
১৩২৪ সালের শীতকাল। বাংলা অভিযান শেষ করে দিল্লি অভিমুখে রওনা দিয়েছেন দিল্লি ও গৌড়-বাংলার সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলক। ফরমানও জারি করেছেন, সেখানে পৌঁছে যেন তিনি নিজামউদ্দিন আউলিয়াকে আর দেখতে না পান। শুনে মুচকি হেসে এই সুফি দরবেশ বলেছিলেন, হনুজ, দিল্লি দূর অস্ত। মানে, দিল্লি এখনো দূরে। এক শ বছর পরের শীতকাল। হাওড়া থেকে সন্ধেবেলায় ট্রেনে উঠেছি, সতেরো ঘণ্টার যাত্রা। গন্তব্য দিল্লি। পরদিন বিকেলে পৌঁছে মনে হলো, নিজামউদ্দিন আউলিয়ার কথা এলে এ যুগেও ফেলে দেওয়ার নয়।
প্রথমেই গুরুদুয়ারার শীষগঞ্জ। সেখানেই রাত কাটানোর পরিকল্পনা। এখানে থাকতে বা খেতে টাকাপয়সার প্রয়োজন নেই, কেবল গুরুদুয়ারার কোনো না কোনো কাজে সহযোগিতা করতে হবে। ট্রেনে খাবারের বৈচিত্র্যে ঘাটতি নেই, পরিমাণেও যথেষ্ট। তবে স্বাদহীন। আধা সেদ্ধ চাল এবং প্রায় তাওয়াবঞ্চিত রুটি দিয়ে খাওয়া সারতে হয়। তবে এসবের মধ্যে সেরা জিনিস ছিল কাপ আইসক্রিম, কাপ দই আর কফি।
গুরুদুয়ারায় মাথায় কাপড় বেঁধে লঙ্গরখানার সেবা গ্রহণ করতে হয়। লঙ্গরখানাও এক আজব ব্যাপার। এখানে এর সেবা চলে আসছে গুরু নানক দেবজীর সময় থেকে। এই প্রথার পেছনের চিন্তা হলো, সবাই যেন মিলেমিশে একসঙ্গে খাবার গ্রহণ করে। কোনো ধর্মের মানুষই এখানে ঢুকে খালি মুখে বেরোতে পারে না। ছোলার ডাল, রুটি আর সবজি দিয়ে ভরপেট খেয়েই বেরোলাম দিল্লি দেখতে। গন্তব্য হুমায়ুনের সমাধি।
বিকেলের আলো ঠিকরে পড়ছে হুমায়ুনের কবরে। এ দৃশ্য দেখতে পুরো পৃথিবী থেকে আগত মানুষ ভিড় করে। এই সমাধি ভারতীয় স্থাপত্যে মোগল ঘরানার প্রথম স্মারক। ৩২টা কক্ষ। মাঝের চেম্বারটা প্ল্যাটফর্মের ওপরে। পুরো এলাকার নকশা করা হয়েছে পারস্যের চারবাগ ঘরানায়। বাগানের মাঝখানে অবস্থিত সৌধটি। এখানে শায়িত আছেন আরও অন্তত দেড় শ মোগল পুরুষ, যাদের ভেতরে হতভাগ্য দারাশুকোও আছেন। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা বিদ্রোহের পর এখান থেকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছিল শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে।
সন্ধ্যায় নিজামউদ্দিন আউলিয়ার দরগা ভ্রমণের পালা। মির্জা গালিবের সমাধি ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। মানুষের ভিড়ে পা রাখা দায়। এখানে আরও আছেন আমীর খসরু। সেতার ও তবলার আবিষ্কারক, কাওয়ালি জনক এবং নিজামউদ্দিন আউলিয়ার একনিষ্ঠ ভক্ত। সম্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহানারা, সম্রাট মুহাম্মদ শাহ এবং দ্বিতীয় আকবরের সন্তান মির্জা জাহাঙ্গীরও শায়িত এখানে। তবে নিজামউদ্দিন আউলিয়া ও আমীর খসরুর দ্যুতিতে তাদের খুঁজে নিতে বেগ পেতে হয়।
নিজামউদ্দিনের পুরো গলিটাই যেন খাবারের আড়ত। বেছে খেলেও এক সপ্তাহ লেগে যাবে সেরা খাবারগুলো চেখে দেখতে। মির্জা গালিব ইনস্টিটিউটের উল্টো দিকে হালিম খেতে খেতে শায়েরি শোনা যায়। যদিও শায়েরের দাবি ছিল লাইনগুলো তার লেখা, কিন্তু সেগুলো প্রায় দুই শ বছর আগে মির্জা গালিব সাহেব লিখে গেছেন বলে কথিত আছে। এখানে ক্রিমি টেক্সচারের হালিম বেশ মজাদার। নামগোত্রহীন দোকানের একমাত্র বিক্রেতা-পরিবেশনকারী এই টেক্সচারের রহস্য সম্পর্কে জানায় ‘ঢের সারা মহব্বত!’ এটিতে তিনি রুহ আফজাকেই নির্দেশ করেছেন। পাশেই কাবাব আর কুলচার পসরা সাজিয়ে বসে ছিল অনেকগুলো দোকান। এসবের স্বাদও অসাধারণ।
এখান থেকে বাসযোগে যাওয়া যায় চাঁদনী চক এলাকায়। এখানকার চোর বাজার বেশ বিখ্যাত। এটি আসলে চুরি করা মালপত্র নয়, সস্তায় জিনিসপাতি কেনার জায়গা। এর জনপ্রিয়তা এতটাই যে ট্যুরিস্টদের লোনলি প্ল্যানেটেও এখানে কেনাকাটা করাটাকে বাজেট ট্রাভেলারদের জন্য অনেকটা বাধ্যতামূলক বলা হয়েছে।
পুনরায় গুরুদুয়ারার কথায় আসি। এখানে রাতের খাবারও মেলে। এটি বিখ্যাত মূলত গুরু তেগ বাহাদুরের প্রয়াণস্থলের জন্য। ১৭৮৩ সালে গুরুদুয়ারা তৈরি হলেও এর ইতিহাস আরেকটু পুরোনো। ১৬৭৫ সালে কট্টরবাদী মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব শিখ নবম গুরু তেগ বাহাদুরকে এখানেই মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন। কথিত আছে, তিনি ঢাকার সঙ্গতটোলা এবং সুজাতপুর মৌজার (এখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা) গুরুদুয়ারা নানকশাহিতেও কিছুদিন ধর্মপ্রচার করেছেন। রাতের খাবার বিতরণে সেখানে সাহায্য করার পর বিশুদ্ধ ঘি এর তড়কা দেওয়া ডাল, সবজি আর রুটি মিলল। রাতটা প্রার্থনাকক্ষের কোনায় বসে কাটিয়ে দিলাম, যদিও শোবার জন্য আলাদা একটা ঘর ছিল। সকালের নাশতা বানানোয় সাহায্যও করলাম। বিনিময়ে কিছুক্ষণ পরপর মিলল চা। সকালে একই খাবার, তবে নাশতায় যোগ হয় সুজির হালুয়া।
শাহজাহানাবাদ শহর গড়ে ওঠার সময় এখানে জামে মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। মসজিদের নাম অনুসারে এলাকার নামকরণ। ১৬৫০ সালেই নাকি এর নির্মাণ ব্যয় ছিল ১০ লাখ রুপি! মসজিদটি ঘিরেই জাহান আরার চাঁদনী চক, মীনা বাজার এবং পুরোনো দিল্লি বা দিল্লি সিক্স। মসজিদের মিনারে চড়ে দিল্লির দূষিত আকাশ, নগরায়ণ দেখা যায়।
দিল্লিতে বিরিয়ানি বিক্রি হয় ওজন দরে। তিন-চার টুকরো মাংস আর চাল মিলে ২৫০ গ্রাম একজনের জন্য যথেষ্ট। রাস্তা থেকে রেস্টুরেন্ট ভেদে এর দাম ৩৫ থেকে ৫০ রুপি। জামে মসজিদ থেকে মেট্রো স্টেশনের দিকে খানিকটা এগোলে হাতের ডানে একটা ছোট্ট দোকান, যেটাকে আপাতদৃষ্টে মনে হতে পারে পুরোনো লোহালক্কড়ের ভাঙারি। কিন্তু এখানেই মিলবে ‘সাবসে বাড়িয়া আউর উমদা বিরিয়ানি’।
দোকানের সামনে স্ট্যান্ডে রাখা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি। একটা টেবিলে বাটখারা আর দাঁড়িপাল্লা। কয়েকটা চেয়ার রাস্তার ওপরে। পেছনে প্যানাফ্লেক্সের ব্যানার। হাজি আবদুল ওয়াহিদ। সকালবেলায় তার প্রথম কাস্টমার আমি। ভিড় নেই। মন খুলে বলে গেলেন দিল্লিওয়ালা বিরিয়ানির গোপন সব তথ্য। স্বাদ অসাধারণ। প্রথমত দিল্লির পোলাও আর বিরিয়ানি তৈরি হয় গোল্ডেন রাইস বা সেলা নামের একধরনের চাল থেকে, যার স্বাদ বাসমতীর চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে কখনো কাচ্চি হয় না, চাল এবং মাংস আলাদা রান্না করে লেয়ারে লেয়ারে মিশিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর গন্তব্য কুতুব এলাকা। কুতুব-মেহরাউলি দিল্লির প্রথম শহর (পৌরাণিক শহর ইন্দ্রপ্রস্থ বাদে)। দ্বাদশ শতকে গড়ে ওঠে। কুতুব মিনার, আলা’ই দারওয়াজা, আলা’ই মিনার, কু’ওয়াতুল ইসলাম মসজিদ, আ’লা উদ্দিন খলজির কবর এখানে অবস্থিত। এসব স্থাপনার বাইরে তৃষ্ণা নিবারণে পাওয়া যায় সোডা লেমনেড। দিল্লি ভ্রমণে এই পানীয় এবং বিভিন্ন রকমের ফল ছিল যখন-তখন খাওয়ার জিনিস।
মেহরাউলি এলাকায় আকবরের দুধ-ভাই আদম খানের সমাধি, সুফি দরবেশ বখতিয়ারের দরগা, শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের শেষ দিনগুলো কাটানো জাফর মহল এবং জাহাজ মহল। মেহরাউলির প্রত্নতাত্ত্বিক উদ্যানও এখানে। শহরের মধ্যখানে প্রায় দুই শ একর জায়গাজুড়ে এর অবস্থান। সেই দিল্লি সালতানাত থেকে মোগল আমলের নানা স্থাপনা ছড়িয়ে রয়েছে। এখানেই সমাধিস্থ বগুড়া শহরের প্রতিষ্ঠাতা নাসিরুদ্দিন বুঘরা খানের পিতা দিল্লির সুলতান গিয়াস উদ্দিন বলবন।
পুরো এলাকা ঘুরে গান্ধাক কি বাওলির কাছে এসে চা মিলল। রীতিমতো আড্ডাখানা। পরিত্যক্ত সোফা, সেন্টার টেবিল- এতে বসেই এলাকার মুরব্বিরা চা খাচ্ছেন। একটু দূরে কাঠের চেয়ারে ছেলে-ছোকরারা নিরাপদ দূরত্ব ও আড়াল বজায় রেখে চা আর ধূমপানে ব্যস্ত। স্পেশাল মালাই চা, দশ রুপির বিনিময়ে খেতে খেতেই এক মুরব্বি জানালেন তার বাংলাদেশ ভ্রমণের কথা। শেখ মুজিব ক্ষমতায় থাকতে ইজতেমায় এসেছিলেন তিনি।
হোটেলটির দক্ষিণ দিকের বারান্দা দিয়ে চাঁদনী চক জামে মসজিদ দেখা যায়। নিচে অলিগলিতে ব্যস্ত পুরোনো দিল্লি চোখে পড়ে। হোটেলে ঢোকার সরু গলির অর্ধেকটা দখল করে রেখেছে এক কাবাবচি। তাদের পরিবেশনের ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। কয়লার আগুনে পোড়া মাংসের টুকরাগুলো প্রথমে রাখা হয় একটা বাটিতে। তাতে ঢালে গলানো মাখন। তারপর সেটা পরিবেশন করে প্লেটে সাজিয়ে। পরিমাণেও নেহাত কম নয়। এক প্লেট মাটন বটি কাবাব চল্লিশ রুপি। গলিতে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে তা খাওয়া যায়।
(চলবে…)
ছবি: লেখক