ফিচার I আদি আংরাখার নতুনত্ব
রাজঘরানার পোশাক। ছোট পরিসরের ঘনিষ্ঠতায় হতে পারে বিয়ের বিশেষ আকর্ষণ। কীভাবে? জানাচ্ছেন জাহেরা শিরীন
ষোড়শ শতাব্দী। মোগল সম্রাট আকবরের রাজদরবারে প্রচলন হয় নতুন পোশাকের। দুটি স্তরে তৈরি। গায়ে গলিয়ে একটি পরতের ওপর অন্যটি জড়িয়ে বেঁধে নিতে হয় বুকের বাম বা ডান পাশে। দেখতে লম্বা ফ্রকের মতো। তখন থেকেই জনপ্রিয় এই আংরাখার প্রথা ছড়িয়ে পড়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। উচ্চপদস্থ রাজকর্মকর্তাদের দাপ্তরিক পোশাক হিসেবে প্রচলিত থাকলেও রাজপুত রাজকুমাররা ভাঙেন সে ঐতিহ্য। তাদের হাত ধরেই এই পোশাকে যুক্ত হয় বিশেষ আড়ম্বর। কেননা পোশাকটি উৎসবের পরিধেয়ও হয়ে ওঠে। তবে ভেতরে আচকান পরা ছিল বাধ্যতামূলক।
প্রথমে পুরুষদের পরিধেয় ছিল। ক্রমেই নারীদের প্রিয় পরিচ্ছদের তালিকায় যুক্ত হয়। ইতিহাস বলে, অভিজাত নারীরা আংরাখা তো পরতেনই, সঙ্গে মাথায় জড়াতেন পাগড়ি, যা পরিচিত ছিল ‘পাটকা’ নামে। তবে রাজপাঠ চুকিয়ে সাধারণের হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় নেয়নি পোশাকটি। অঞ্চলভেদে প্রতিদিনের পরিধেয় হিসেবে তো বটেই, উৎসবেও এর আবেদন এখন এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। আংরাখা নিয়ে নিরীক্ষাও হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ডিজাইনারদের ডেরায় কাট, প্যাটার্ন ও শিলুয়েটে চিরন্তন ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মিলমিশ করে তৈরি হচ্ছে কনটেম্পরারি এই এথনিক ওয়্যার। নামীদামি তারকারা রেড কার্পেট থেকে ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে গায়ে জড়াচ্ছেন সেগুলো, শখের বশে। করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আংরাখাকে বলা হচ্ছে ‘দ্য নিউ শিলুয়েট ফর ইন্টিমেট ওয়েডিং’।
করোনাজনিত নতুন সময়ে পাল্টে গেছে অনেক রীতি। বাদ পড়েনি বিয়ের আয়োজনও। যার স্পষ্ট ছাপ চোখে পড়ে কনের সাজপোশাক থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি সবকিছুতেই। আগে ভারী, জমকালো সজ্জায় নজর কাড়তেন কনেরা। প্রাধান্য পেত শাড়ি, লেহেঙ্গার মতো প্রচলিত আউটফিটগুলো। করোনাকালীন বাস্তবতায় বাড়ির ছোট পরিসরের আয়োজনে স্বাচ্ছন্দ্যটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে অনেকের কাছে। সে ক্ষেত্রে ব্রাইডাল আউটফিট হিসেবে দারুণ অপশন হতে পারে আংরাখা। আরামদায়ক, তবে আভিজাত্যের এতটুকু কমতি নেই এই এথনিক ওয়্যারে। দেখানেপনার বালাই থেকেও মুক্ত। সব ধরনের দেহাবয়বের কনেদের চমৎকার মানিয়ে যায়। ব্রাইডাল ওয়্যার হিসেবে এর চল এখনো শুরু না হলেও ভিন্ন স্টাইল স্টেটমেন্ট তৈরি করতে চাইলে আংরাখা বেছে নেওয়া যেতে পারে অনায়াসে। ট্রেন্ড সেটার হয়ে ওঠার ভালো সুযোগও!
আংরাখা মূলত লম্বা ফ্রক বা স্যুট স্টাইলের পোশাক। চওড়া বর্ডার যুক্ত। দুটো ফ্ল্যাপ এই আউটফিটের বৈশিষ্ট্য। দুই স্তরবিশিষ্ট এ পরিধেয়র একটি ফ্ল্যাপের উপর অন্যটি ওভারল্যাপ করে একসঙ্গে বেঁধে নিতে হয় স্ট্রিং বা ডোরি দিয়ে। বাঁধনটা বুকে, গলায়, কোমরে বা আন্ডারআর্ম অব্দি চলে যেতে পারে ডিজাইনভেদে। একটা সাইড বর্ডার এটিকে অন্য আউটফিটগুলোর চেয়ে আলাদা করে। যেটা নেকলাইন থেকে নেমে যায় পোশাকের নিচ অব্দি। ট্র্যাডিশনাল আংরাখা দুই ধরনের। প্রথমটি কামারি। কোমরের কাছে এসে বাঁধা পড়ে এর ফ্ল্যাপ দুটো। বাকিটার দৈর্ঘ্য বাড়ে-কমে পরিধানকারীর পছন্দ অনুসারে। সেটা খাটো ফ্রকের মতো হতে পারে। আধুনিক পেপলাম টপের সঙ্গে খানিকটা সাদৃশ্য চোখে পড়ে। দৈর্ঘ্য যেমনই হোক, এর কুঁচি বা ফ্লেয়ারগুলো হয় আউটওয়ার্ড। ফলে নিজস্ব একটা মুভমেন্ট তৈরি হয় পোশাকটিতে। সাধারণত ধুতি স্টাইল বটমের সঙ্গে এর জোড় জম্পেশ। আরেকটু ফরমাল ফেস্টিভ লুকের জন্য ফ্লেয়ারড শারারা অথবা ঘারারা স্টাইল বটমের সঙ্গে চমৎকার দেখাবে। চলতে পারে ঘেরওয়ালা স্কার্টও।
দ্বিতীয়টি হাঁটু ছোঁয়া আংরাখা। এতে কোমরে আলাদা কোনো বর্ডার থাকে না। অনেক কুঁচি দেওয়া এই পোশাকগুলোর সঙ্গে বটম হিসেবে চুড়িদার, প্লিটেড প্যান্ট, পাজামা এমনকি স্কার্টের যুগলবন্দী হতে পারে অনায়াসে।
তবে আংরাখার দৈর্ঘ্য নিয়ে এখন বাঁধাধরা নিয়ম নেই। পছন্দ এবং স্বাচ্ছন্দ্য অনুসারে তা মিড থাই লেন্থ, ওয়েস্ট লেন্থ, হাঁটুর উপর কিংবা নিচ, এমনকি ফ্লোর টাচও হতে পারে। অ্যাসিমেট্রিক শিলুয়েটের ভার্সাটাইল এ আউটফিটের নেকলাইন নিয়েও করা যায় নানান নিরীক্ষা। ব্যাকলেস, লো নেক- হতে পারে সবই। স্প্যাগেটি, স্লিভলেস বা করসেট টপের আদলে আংরাখার আপার পার্ট ডিজাইন করে নিলেও মন্দ দেখাবে না।
ব্রাইডাল আংরাখাগুলোর ফ্যাব্রিক সিলেকশনের জন্য কৌশলী হওয়া দরকার। সিল্ক, ভেলভেট, শিফন, জর্জেট, অরগ্যাঞ্জা, মসলিন এমনকি জামদানি দিয়েও তৈরি হতে পারে। নজর দিতে হবে এমবেলিশমেন্টের দিকেও। ভারী এমব্রয়ডারি, রিবন, পার্ল, বিড, দপকা, স্টোন, সিকুইন, জরি বা নিখুঁত সুই-সুচের ফোঁড়ে আয়োজনের আমেজ আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে আউটফিটে।
এখন শুধু বিয়ের উপযোগী রঙের আংরাখা বেছে নেওয়ার পালা। সে ক্ষেত্রে কনের পছন্দ প্রাধান্য পাবে ষোলো আনা।
মডেল: তানিয়া
জুয়েলারি: কা-ঐস
ওয়্যারড্রোব: রত্না গুলজার
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ফারাবী তমাল