skip to Main Content

বিশেষ ফিচার I লৈঙ্গিক সীমানা পেরিয়ে

ফ্যাশনে নারী ও পুরুষের বিভেদ ঘুচে যাচ্ছে। সম্প্রতি ছেলেরাও পরছে মেয়েদের পোশাক। লিখেছেন সারাহ্ দীনা

চিরায়ত সাজ কিংবা হালের বেবি শাওয়ার- সবকিছুতেই রঙের মাধ্যমে জানানো হয় ছেলে বা মেয়ের পরিচিতি। সাইজ জিরো শপিংয়ের ক্ষেত্রেও একই উদাহরণ আনা যায়। সেই গোলাপি আর আকাশিতেই যেন পরিচয়। পোশাক নয় শুধু। ব্র্যান্ডেড চকলেটের প্যাকেজিংয়েও এক গল্প। ছেলের জন্য আকাশি আভা, আর মেয়ে হলে গোলাপি রঙের ছোঁয়া। ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসছে। বদল হচ্ছে রঙের ধারা।
আকাশি, গোলাপি- এই দুই দলেরই সমাজে আছে নানান প্রথা। এতে মেয়েদের জন্য তৈরি করা বিধিনিষেধের অনেক কথা জানা যায়। কিন্তু ছেলেরা কি এর বাইরে?
প্রথাগত জীবনযাপনে অভ্যস্ত বেশির ভাগ পুরুষ। এর ব্যতিক্রমও আছে। চলচ্চিত্র পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ নিজস্ব লাইফস্টাইল নিয়ে ভেবেছেন। নিজের জীবনে পরিবর্তন সম্পর্কে তিনি ছিলেন মনোযোগী। পুরুষ মানুষ কাঁদে না, সাজে না, আবেগে ভাসে না- এই ‘না’-এর জগতে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। নিজের জীবনবোধ ও বিশ্বাসকে তিনি শুধু মনেই ধারণ করেননি, সিগনেচার স্টাইলে সবার সামনে হাজির হয়েছেন স্বতঃস্ফূর্তভাবে।
হালের রণবীর সিং বেশ সাড়া ফেলেছেন ফ্যাশন-সচেতনদের দুনিয়ায়। পোশাক, অ্যাকসেসরিজসহ নানান লাইফস্টাইল পণ্যে তার রয়েছে তাক লাগানো চমক। কখনো পোশাকের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন, কখনো রঙ, কখনো অ্যাকসেসরিজ বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে। নিয়মকানুনের বাইরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন এই বলিউড তারকা।
ভারতের হিমাংশু ভার্মার ওয়্যারড্রোব স্টোরি মানেই শাড়ি। ১৪ বছর ধরে এটি তার প্রতিদিনের পোশাক। শাড়ির বিশাল কালেকশনও রয়েছে। ব্যক্তিগত রঙিন শাড়িতে দারুণ সাবলীল এই শাড়ি-ম্যান।
হিল, মেয়েদের জুতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হাইহিল শু-তে ফ্যাশনিস্তার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায় কয়েক গুণ। ছেলেদের জুতায় হিল দেখা যায় না। এরও আছে জেন্ডার স্পেসিফিকেশন। দৈহিক উচ্চতাকে যথেষ্ট মনে না হলে পুরুষ সোলের উচ্চতায় কখনো কখনো নজর দেয় বটে। জানা যায় লার্নিং স্পেশালিস্ট সিদ্ধান্ত কোড়েলকরের হিল-সম্পর্কিত আকর্ষণের কথা। তার রয়েছে নিজস্ব কালেকশন। ৯ ইঞ্চি হিলের দেখাও মেলে। এত বৈচিত্র্যে সিদ্ধান্তের ফেভারিট স্টিলেটো।
জেন্ডার নিউট্রাল ফ্যাশন নতুন ধারণা নয়। আঠারো শতকের মধ্যবর্তী সময়ে নারী অধিকারবিষয়ক অ্যাকটিভিস্ট অ্যামেলিয়া ব্লোমার এসব নিয়ে ভাবতে শুরু করেন। তখন মেয়েরা দেহের উপরের অংশে আঁটসাঁট ক্লজেট পরতেন আর স্কার্টের নিচের অংশে অনেক কুঁচির সমন্বয়ে তৈরি করা পেটিকোট। এ রকম ভারী ইনারের বিকল্প হিসেবে হাঁটু অবধি প্যান্ট পরে নেওয়া শুরু করেন তিনি। এই ইনারের নামটাও ছিল তার নামে, ‘ব্লোমার’। তখন শুধু ছেলেরাই ট্রাউজার পরত। ১৮৫০ সালে ব্লোমার নিজস্ব অবস্থান তৈরি করে। সুশান বি অ্যান্থনি, এলিজাবেথ ক্যাডি স্ট্যানটোনদের মতো ফ্যামিনিস্টদের স্টাইলে জায়গা করে নেয়।
এরপরের ফ্যাশন রেভল্যুশন ১৯২০ সালে। তখন পৃথিবীতে বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত। নারীদের ভোটের অধিকারের আন্দোলনও চলছে। মেয়েদের নিত্যদিনের ফ্যাশনে তখনো স্কার্টই সই। কিন্তু ডিজাইনে এসেছে পরিবর্তন। বাহুল্যকে সরিয়ে রেখে গঠনে এসেছে চমক। স্পোর্টি আর ম্যাসকুলিনের ছোঁয়া স্পষ্ট। তখনকার ফ্যাশনে ছিল কোকো শ্যানেলের প্রভাব। তিনি নিয়ম ভেঙেছেন। নারী ফ্যাশনের ধারার বাইরে শ্যানেল নিজস্ব স্টাইলে উজ্জ্বল ছিলেন। তার ডিজাইনের প্রেরণায় মেনস ওয়্যারের জায়গা গুরুত্বপূর্ণ। এলিগ্যান্ট স্যুট ডিজাইন করেছেন। টুইড ব্লেজার এবং মেয়েদের প্রতিদিনের পরিধেয় তার সিগনেচার প্রডাক্ট। স্ট্রাইপ ছিল শ্যানেলের পছন্দের তালিকার উপরের দিকে। লুজ ফিটিং ট্রাউজারের সঙ্গে নটিক্যাল স্ট্রাইপ আর চাংকি নিট সোয়েটারে তিনি স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল।
১৯৩০-এ আসে মেনস ওয়্যারে অনুপ্রাণিত ফ্যাশন। অভিনেত্রী মারলিন ডিট্রিচ, অড্রে হেপবার্ন এবং ক্যাথেরিন হেপবার্নের মতো আইকনরা এই নতুনকে প্রতিষ্ঠা করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্যে তারা হাজির হয়েছেন স্পোর্টিং স্যুট এবং বো টাই পরে। ট্রাউজার তখন শতভাগ পুরুষের পোশাক। তাই মেয়েরা শুধু পুরুষালি কাজের সময়ে ট্রাউজার বেছে নেওয়ার সুযোগ পেত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় খেলা, যুদ্ধ, ফার্ম হাউস এবং ফ্যাক্টরির কাজ। পুরুষের নিত্যদিনের কাজের তালিকায় তখন ছিল ফার্ম হাউসের কৃষি এবং ফ্যাক্টরির শ্রম। এরা যখন যুদ্ধে যেতেন, তখন এই কাজগুলো সম্পন্ন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হতো না। আবার দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ রাখাও সম্ভব ছিল না। তাই তখন নারীরা কাজ করতে শুরু করেন। কিন্তু তাদের লুজ ফিটিং বাহুল্যে ভরপুর পোশাক পরে এ ধরনের কাজ সম্পন্ন করা দুঃসাধ্য ছিল। শ্রমসাধ্য কাজ সম্পাদন করার উদ্দেশ্যে তারা জীবনসঙ্গীর পোশাক পরে কাজ করতে শুরু করেন।
ফ্যাশন ম্যাগাজিন ‘ভোগ’ ১৯৩৯ সালের মে ইস্যুতে তাদের কভারে ঘটান বৈপ্লবিক পরিবর্তন। উজ্জ্বল অলিভ কালার ট্রাউজার আর টপসে উদাস নয়না মডেল ঝড় তোলে। এ বিষয়ে এডিটর লিখেছিলেন, ‘ফ্যাশনের এ লাইনটি একদমই পুরুষের জন্য, কিন্তু আমাদের নারীরা পোশাকের রঙ নিজেদের মতো করে বেছে নিয়ে দারুণভাবে সেজে উঠেছেন। আর সঙ্গে তাদের টপ টু টয় অ্যাকসেসরিজ এই লুককে করেছে সম্পূর্ণ।’
লন্ডনে ১৯৫০ সালে একটি গার্লস গ্যাং ভিন্নভাবে ভাবতে শুরু করে। তারা বিদায় জানান ট্র্যাডিশনাল ফেমিনিন ড্রেস লাইনকে। বরং জ্যাকেট, রোলড আপ জিনস আর স্লিপার হয়ে ওঠে জুতসই। এই মেয়েদের ডাকা হতো টেডি গার্লস নামে। তাদের সিগনেচার স্টাইলে সফল হয়েছিল। পরবর্তীকালে তা-ই পরিণত হয় ফ্যাশনে। ১৯৬১-তে অড্রে হেপবার্নকে ‘ব্রেকফাস্ট অ্যাট টিফানিস’ চলচ্চিত্রে আমরা দেখতে পাই কালো ক্যাপ্রিতে। এখানেও নতুন জাগরণের গান। এরপর আর ভাবতে হয়নি আলাদা করে; বরং তালিকায় যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন পোশাক। মেনস ওয়্যার অনুপ্রাণিত ফ্যাশন নিয়ে কাজ শুরু করে পুরুষালি টক্সিডোকে জেন্ডার নিউট্রাল পোশাক হিসেবে সামনে নিয়ে আসেন জুভেস সেইন্ট লরেন্ট। কেন এই নতুন ভাবনা, জানতে চাইলে প্রশ্নের উত্তরে এই পুরুষ বলেছিলেন, ‘টক্সিডো এমন একটি পোশাক, যা নারীকে কমফোর্ট দেয়। ফলে নারী নিজের মতো করে চলতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে। তাই এই পোশাক তাদের জন্য উপযোগী বলে আমি মনে করি। এটা একটা স্টাইল। ফ্যাশন নয়। ফ্যাশনের স্থায়িত্ব নেই, স্টাইলের আছে।’ এত যুগ পরেও তাই টক্সিডো ইন ফ্যাশন। ফেইড হয়ে যায়নি। বরং এই ইউনিসেক্স লাইনটিতে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন আইটেম। আশির দশকে আসে পাওয়ার স্যুট। যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার সব সময় স্যুট পরতেন। এ বিষয়ে শোনা যায়- তিনি পুরুষের রাজত্বে রয়েছেন এবং এখানে সবার সঙ্গে একই রকম লুক নিয়ে আছেন।
শেষ দুই দশকে ফ্যাশনে লৈঙ্গিক পক্ষপাত কমেছে। ওমেন্স ওয়্যার লাইনে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন আইটেম। একই সঙ্গে ইউনিসেক্স কালেকশনের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। ডিজাইনের গঠনগত দিকে নতুনত্ব চোখে পড়ার মতো। যোগ হয়েছে স্ক্যাল্পচারাল শোল্ডার, প্লেইড প্যাটার্নস, ক্ল্যাসিক ফেডোরা হ্যাট, ট্রেঞ্চ কোট, বয়ফ্রেন্ড জিনস এবং স্যুট সেট। গঠনগত নকশার বাইরে অলংকরণেও সৃজনশীলতা দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে বেল্ট, বাটন, রিবন আর কালার বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে।
শেষ পাঁচ বছরে ‘মেনস ওয়্যার ইন্সপায়ারড’ ফ্যাশনের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে সরাসরি মেনস ফ্যাশন ওয়্যার বেছে নেওয়ার চল। অফিশিয়াল কলার শার্ট, ফরমাল ট্রাউজার, স্যুট, জাম্পার, হ্যাট জেন্ডারের হিসাব ছাড়িয়েছে। প্রাধান্য পাচ্ছে রুচি ও ইচ্ছা। আউট অব দ্য বক্স এই স্টাইল ধীরে ধীরে ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে। ওভার সাইজড শার্ট আর টি-শার্ট বেশ আগে থেকেই সবার প্রিয় হয়ে ক্লজেটে জায়গা করে নিয়েছিল। এখন তার সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুনেরা। নারীরা পোশাকের জেন্ডার নিয়ে কম ভেবেছেন পুরুষের থেকে। ফ্যাশনে আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য, সাবলীলতাকে প্রাধান্য দিয়ে বাহুল্য বর্জনের ক্ষেত্রে নারীর পদচারণ প্রথমে।
প্রতিদিনের কাপড়চোপড় এবং ফ্যাশন অনুষঙ্গের রীতিরেওয়াজ আর আগের অবস্থায় নেই। এখন ইচ্ছেমতো নিজেকে সাজিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। মেকআপ লাইনের ক্ষেত্রেও আসছে কিছু পরিবর্তন। পুরুষ ইদানীং বেশ সচেতন। ছেলেদের প্রসাধন বলতে পারফিউম, শেভিং ফোম আর আফটার শেভ লোশন ছিল লম্বা সময় ধরে। তালিকায় এসেছে নতুন পণ্য। ছেলেদের জন্য আলাদা করে প্রসাধন তৈরি করছে বেশ কিছু ব্র্যান্ড। এর পেছনে অবশ্যই আছে মার্কেট রিসার্চ। পুরুষ এখন নিজেকে প্রেজেন্টেবল করায় মনোযাগী। কলকাতার মেকআপ আর্টিস্ট অমিত কর্মকারের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। তিনি মানুষকে সাজিয়ে তোলার পাশাপাশি নিজেও সাজতে পছন্দ করেন। মেকআপ মূলত মুখের আকৃতি এবং সাজের জন্য তৈরি প্রসাধন। জেন্ডার তাই কোনোভাবেই এখানে বিভেদ সৃষ্টির কারণ নয়। অ্যাকসেসরিজও এখন যে যার মতো বেছে নিচ্ছে। পিয়ারসিং এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ হিসেবে কাজ করেছে। এর বাইরে ব্যান্ডানা, ব্রেসলেট, আংটি, চুড়িও পেয়েছে জনপ্রিয়তা।
নতুনত্ব মানেই নিয়ম ভাঙার গল্প। মেনস ইন্সপায়ারড বলি কিংবা ওমেন্স ইন্সপায়ারড- সব ক্ষেত্রেই নতুনত্বের স্বাদ নিতে চেষ্টা করছে মানুষ। কখনো সেটা কমফোর্ট, কখনো ডিজাইন, কখনো রঙ। ফ্যাশন নিয়মের বেড়াজালে আটকে থাকেনি। নারী-পুরুষ বৈষম্য তো কোনোভাবেই নয়। রুচি ও সহজতা মেনে তৈরি হচ্ছে ফ্যাশন স্টেটমেন্ট।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top