ফিচার I আদিবাসীদের বিবাহপোশাক
বাংলাদেশে বসবাসরত নৃগোষ্ঠীগুলোর বিয়ের পোশাকে রয়েছে বৈচিত্র্য ও স্বাতন্ত্র্য। সাংস্কৃতিক মৌলিকতাই তাতে পরিস্ফুট। লিখেছেন মিঠুন রাকসাম
প্রতিটি জনগোষ্ঠীর আলাদা রীতি-নীতি, শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে রয়েছে পোশাকের নিজস্বতা। বাংলাদেশের আদিবাসীরাও এর ব্যতিক্রম নয়। চাকমা মেয়েরা কোমর থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত নীল কাপড়ের ওপর লাল ডোরাকাটা স্কার্ট (পিনোন), ব্রেস্ট-ক্লথ (খাদি) এবং শিরস্ত্রাণ পরিধান করে। কখনো তাদের শাড়ি ও ব্লাউজ পরতেও দেখা যায়। পুরুষদের পোশাক হলো ধুতি, কোট ও সাদা পাগড়ি। মগ মেয়েরা রঙিন স্কার্ট (থানি) ও বক্ষবন্ধনী (রাঙ্গাই) পরে। আজকাল শাড়িও পরতে দেখা যায়। পুরুষেরা লুঙ্গি, কোট ও পাগড়ি (গাঙবঙ) পরে। চাকমাদের প্রভাবে মগ পুরুষেরা এখন ধুতিও পরছে। মুরং মেয়েরা নিজেদের তৈরি স্কার্ট ও ব্লাউজ পরে। অবিবাহিত মেয়েরা অবশ্য গায়ে রঙিন চাদর রাখে। পুরুষেরা মাথায় পাগড়ি এবং কোমরে এক টুকরা কাপড় ঝুলিয়ে পরে। তঞ্চঙ্গ্যাদের পোশাক অনেকটা চাকমাদের মতো। পুরুষেরা ধুতি, কোট ও পাগড়ি এবং মেয়েদের পোশাক হলো স্কার্ট, বক্ষবন্ধনী ও শিরস্ত্রাণ। টিপরা মেয়েরা স্কার্ট (রিনাই), বক্ষবাস, ব্লাউজ এবং শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করে। পুরুষেরা ধুতি, কোট ও পাগড়ি পরে থাকে।
প্রায় সব আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অলংকার ব্যবহারের চল আছে। এসবেও রয়েছে বিশেষত্ব। কখনো কখনো অলংকারও উৎসবের ধরন বুঝে বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে। গলার চওড়া হার, অনন্ত, নাকফুল, চুড়ি উল্লেখযোগ্য। এমনকি পায়েও দেখা যায় ভারী অলংকার। এসব তৈরি করতে তারা ব্যবহার করে রুপা ও অন্য ধাতু। স্বর্ণালংকারও দেখা যায় কদাচিৎ।
তবে প্রতিদিনের ব্যবহার্য পরিধেয়র বাইরে, বিশেষত বিভিন্ন পালা-পার্বণ অনুষ্ঠানে আদিবাসীরা তাদের নিজেদের তৈরি জমকালো পোশাক পরে। ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য রয়েছে আলাদা পোশাক। কিছু পরিধেয় নির্দিষ্ট দিন বা উৎসবকে কেন্দ্র করে বানানো হয়। যেমন বিয়ের পোশাক। এ জন্য আদিবাসীদের মধ্যে একটি প্রস্তুতি পর্ব থাকে। তা হচ্ছে বিয়ের বিশেষ পরিধেয় তৈরি।
একসময় চাকমা, গারো, ত্রিপুরা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিয়েকে কেন্দ্র করে উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করত। নিজস্ব তাঁতে বিশেষ যত্ন নিয়ে মেয়ে এবং ছেলের জন্য পোশাক তৈরি করা হতো। কিন্তু কালের ধারাবাহিকতায় সেই আমেজ কিংবা পরিবেশ অনেকটাই ম্লান হতে বসেছে। কেননা, এখন হাতের কাছেই পাওয়া যাচ্ছে রেডিমেড বিয়ের পোশাক। এমনকি অলংকারাদিও।
তবু এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও আদি অকৃত্রিম রীতিনীতিগুলো পালিত হতে দেখা যায় প্রায় প্রতিটি আদিবাসী সমাজে। বিশেষ করে বিয়ের রীতি-আচার অনুষ্ঠানে। ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর রয়েছে স্বতন্ত্র ও নিজস্ব বিয়ের পোশাক।
চাকমা
এই গোষ্ঠীর জনসংখ্যা বাংলাদেশের অন্যান্য আদিবাসীর চেয়ে বেশি। নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, শিল্প-সংস্কৃতিতেও এরা সমৃদ্ধ। চাকমাদের বাস তিন পার্বত্য জেলায়। পিতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থা হওয়ায় চাকমা সমাজে ছেলে বিয়ে করে বউ ঘরে নিয়ে আসে। তাদের বিয়েরও রয়েছে নিজস্ব রীতি। আছে বর-কনের বিয়ের বিশেষ পরিচ্ছদ। যেমন-
ছেলেদের ধুতি ও পাঞ্জাবি (জুয়ের সিলুম-এর ডিজাইন) ও মাথায় হাবং (একধরনের পাগড়ি)। মেয়েদের পিনোন-হাদি (থামি)। এগুলো একসময় নিজেরাই প্রস্তুত করত। এখনো তৈরি করতে দেখা যায়। তবে সহজে পাওয়া যায় বলে বিভিন্ন টেক্সটাইল থেকে এসব পোশাক অনেকে সংগ্রহ করছে। আবার কেউ কেউ বিবাহের প্রস্তুতিস্বরূপ নিজেরাই তৈরি করার চল ধরে রেখেছে।
বিয়ের এসব পোশাক বেশির ভাগ রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির টেক্সটাইল দোকানে পাওয়া যায়। চাকমাদের চিরাচরিত নকশার সঙ্গে এসবে এখন আধুনিকতার ছোঁয়াও লেগেছে। তবে বিয়ের পোশাকের স্বাতন্ত্র্য থেকে তারা সরে আসেনি।
গারো
সমতলের আদিবাসী। এদেরও রয়েছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। গারোদের মাতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থা হওয়ায় এ গোত্রে ছেলেদের জামাই যাবার প্রথা পালন করা হয়। মেয়ে বিয়ে করে ছেলেকে ঘরে নিয়ে আসে। তাদের বিয়েও হয় নিজস্ব রীতিতে। এদেরও রয়েছে নিজস্ব পোশাক ও অলংকার। এসব তারা নিজেরাই তৈরি করে। অলংকার বানানো হয় সাধারণত রুপা দিয়ে। মাঝে মাঝে স্বর্ণ বা অন্য ধাতুও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। মাতৃকেন্দ্রিক গারো সম্প্রদায়ের বিয়ের পোশাকেও রয়েছে বৈচিত্র্য।
মেয়েরা সাধারণত নিজেদের তাঁতে বোনা দকমান্দা পরে, মাথায় দেয় কুপিং (পাগড়ি) এবং পেছনে দমি (এক গুচ্ছ মোরগের পাখা)। ছেলেদের হাঁটু পর্যন্ত গান্না চংতব (ধুতি-বিশেষ) এবং মাথায় থাকে কুটিপ (পাগড়ি)। কুটিপের সামনের দিকে দমি গোঁজে। মেয়েরা হাতে নিজেদের তৈরি চাকসিল, পায়ে জাসিল, কানে দুল পরে। ছেলেদেরও হাতে থাকে চাকসিল, পায়ে জাসিল। আদি সাংসারেক গারো-বিয়েতে মহিলারা দকমান্দা পরত আর পুরুষেরা গান্না চংতব। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই পোশাকে পরিবর্তন এসেছে। এখন মেয়েরাও দকমান্দার পাশাপাশি সামর্থ্য অনুযায়ী দামি শাড়ি কিংবা গাউন পরে বিয়েতে। ছেলেদের মাঝেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। তারা স্যুট-কোট, প্যান্ট, আবার কেউ কেউ পাজামা-পাঞ্জাবিও পরে।
গারোদের বিয়ের পোশাকগুলো ঢাকা, টাঙ্গাইল, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা জেলার আদিবাসী দোকানগুলোতে পাওয়া যায়।
ত্রিপুরা
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত এই আদিবাসীরা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। পিতৃপ্রধান সমাজব্যবস্থা বলে ত্রিপুরা সমাজে ছেলে বিয়ে করে বউ ঘরে নিয়ে আসে। তাদের বিয়ের রয়েছে নিজস্ব রীতি ও বিশেষ পোশাক।
ত্রিপুরা মেয়েরা বিয়েতে সাধারণত নিজেদের হাতের তৈরি রিনাই, রিসা পরিধান করে। রিনাই রিসা মানে থামি এবং হাতে তৈরি একপ্রকার ওড়না। ছেলেরা পরে ধুতি ও পাঞ্জাবি। তাঁতে তৈরি রিসা দিয়েও পাঞ্জাবি বানানো হয়। এ ছাড়া এখন অনেকে নিজেদের নকশায় বোনা কাপড়ে শার্ট বানিয়ে বিয়ের আসরে বসে। এসব কাপড় নিজস্ব তাঁতে তৈরি হলেও উদ্যোক্তাদের কাছে কিনতে পাওয়া যায়।
সাধারণত খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটির পাহাড়ি অঞ্চলের দোকানগুলোতে এসব কাপড় ও পোশাক থাকে। এ ছাড়া খাগড়াছড়ি জেলার খাগড়াপুর মহিলা উদ্যোক্তাদের কাছেও রঙবেরঙের রিনাই রিসা পাওয়া যায়।
মারমা
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী। তিন পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসী হলেও বান্দরবানে এদের বেশি দেখা যায়। তাদের বিয়ের রীতি আলাদা। রয়েছে বর-কনের বিশেষ পোশাক।
বিয়ের সময় মারমা মেয়েরা পরে থঃবুইং ও মঃমা রাংজি (একধরনের লুঙ্গি ও টপ)। দুপায়ে থাকে কাখ্যাং (পায়ের খারু), মাথায় গবং (মাথার বন্ধনী)। ছেলেদের বিয়ের পোশাক হলো খঃয়অ ও য়ঃক্যা রাংজিঃ/আংঙ্গি (একধরনের লুঙ্গি ও শার্ট)। এগুলো সাধারণত মিয়ানমার থেকে আনা হয়। এখন খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবানের বিভিন্ন টেক্সটাইল শপ ও রাখাইনদের দোকানে পাওয়া যায়।
তথ্য সহায়তাকারী : তর্পণ ঘাগ্রা, তিতাস চাকমা, অং মারমা, আদিত্য ত্রিপুরা
মডেল: বৃষ্টি ও প্রেজুয়াল
জুয়েলারি: আনজুম’স
ওয়্যারড্রোব: তেনজিং চাকমা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ফারাবী তমাল