ফিচার I ঐতিহ্যের নতুন রূপ
পুরোনো পোশাকের প্রত্যাবর্তন। বর-কনের সাজে। কারণ একটাই- ভিড়ভাট্টা থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখা। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার
বর-কনের সাজ নিয়ে সবারই আগ্রহ থাকে। অতিমারিতেও তাতে ভাটা পড়েনি। যদিও বছরের শুরুর দিকে অনেক বিয়ের আয়োজন আটকে গিয়েছিল। এখন নতুন স্বাভাবিকতায় বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে সীমিত পরিসরে। ফলে বর-কনের সাজপোশাকে এসেছে পরিবর্তন।
উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া
কনেরা বেশ আগে থেকেই স্বপ্ন দেখে, বিয়ের দিন কীভাবে সাজবে। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে শপিং বাদ দিয়ে অনেকেই ঝুঁকছেন নিজেদের কাছে থাকা ‘ভিনটেজ’ কালেকশনের দিকে। প্রতিবছরই বিয়ের পোশাকের নতুন ট্রেন্ড আসে। তা সত্ত্বেও কনেরা নিজের মা বা নানি-দাদির বিয়ের গাউন পরে বিয়ে করছেন। পশ্চিমেও এমনটা দেখা গেছে। এখন অন্য সব সময়ের চেয়ে এটি বেশি করতে দেখা যাচ্ছে। যেমন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নাতনি প্রিন্সেস বিয়াট্রিস। এ বছর ব্রিটিশ রাজপরিবারের অন্য সবার মতোই মহা ধুমধামে বিয়ের আয়োজনের কথা ছিল। কিন্তু করোনা এসে ভেস্তে দিল সব। ৪ জুলাই ইংল্যান্ডে ৩০ জন অতিথি নিয়ে সীমিত পরিসরে বিয়ের অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৭ জুলাই রাজপরিবারের কিছু সদস্যের উপস্থিতিতে ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয় এই রাজকন্যার। বিয়েতে তিনি পরেন তার দাদি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের একটি গাউন। ১৯৬২ সালে ‘লরেন্স অব অ্যারাবিয়া’ ছবির প্রিমিয়ার উপলক্ষে রানির জন্য গাউনটি ডিজাইন করেছিলেন রয়্যাল ডিজাইনার নরম্যান হার্টনেল। প্রিন্সেস বিয়াট্রিসের বিয়ে উপলক্ষে স্লিভলেস গাউনটিতে অরগ্যাঞ্জা কাপড়ের হাতা লাগিয়ে আপসাইকেল করা হয়। গয়না হিসেবে পরেছিলেন কোকোশিঙ্ক মুকুট। যেটি ১৯৪৭ সালে রানি নিজের বিয়েতে পরেছিলেন। রাজকীয় বিয়ের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী পোশাক সব সময় ব্রাইডাল ফ্যাশনে প্রভাব ফেলে। সে কারণে অনেকেই বিয়েতে ‘উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া’ পোশাক পরার কথা ভাবছে।
এ ধরনের পোশাক আপসাইকেল করলে সহজে আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারে। গাউনে অনেক কিছুই করা যায়। যেমন নতুন স্লিভ লাগানো, নতুন ডিজাইনের ফ্রিল, ফ্রিঞ্জ, রাফল বা টুইল যোগ করা ইত্যাদি। আমাদের দেশের কনেরা মায়ের বিয়ের শাড়ি পরতে চাইলে আপসাইকেল করার তেমন প্রয়োজন পড়বে না। সে ক্ষেত্রে নজর দেওয়া যায় ব্লাউজ আর ওড়নার দিকে। দর্জির কাছে ফরমাশ দিয়ে বানিয়ে নেওয়া যায় বিভিন্ন ডিজাইনের ব্লাউজ। ডিজাইনে বোট কলার, হাই নেক, হল্টার কলার খুব জনপ্রিয়। হাতা হতে পারে থ্রি কোয়ার্টার, ফুল স্লিভ, বাটারফ্লাই স্লিভ, পাফ স্লিভ, চায়নিজ স্লিভ ইত্যাদি। এ ছাড়া হাতায় ব্যবহার করা যায় ফ্রিল, ফ্রিঞ্জ, টাসেল। ইদানীং শাড়ির সঙ্গে টপ পরার বেশ চল দেখা যাচ্ছে। চাইলে হাল ফ্যাশনের টপ স্টাইলের ব্লাউজও পরা যেতে পারে।
লালের প্রত্যাবর্তন
একসময় আমাদের দেশে বিয়ের শাড়ি মানেই ছিল টুকটুকে লাল রঙের বেনারসি আর কাতান। ২০০০ সালের পর থেকে কনেরা লাল থেকে বেরিয়ে বিয়েতে বাহারি রঙ আর কাপড়ের শাড়ি পরা শুরু করে। কয়েক বছর ধরে মেরুন, বেগুনি, গোলাপি, কমলা, সোনালি, নীল, পিচ- এসব রঙের বেশ কদর ছিল। কিন্তু এ বছর নতুন স্বাভাবিকতায় স্বমহিমায় ফিরে এসেছে লাল টুকটুকে শাড়ি। গত কয়েক মাসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া ছবিতে ৯০ শতাংশ কনেকেই লাল রঙের ঐতিহ্যবাহী কাতান বা বেনারসি পরতে দেখা গেছে। কিছু কনে জামদানি আর মসলিন পরেছে। সেসবের রঙও লাল। কনের রুচি অনুযায়ী লাল কাতান বা বেনারসিতে ভারী অথবা হালকা সোনালি কিংবা রুপালি জরির কাজ দেখে কেনা হচ্ছে।
প্রথাছুট
লকডাউন শুরুর বেশ আগে বাংলাদেশি সেলিব্রিটি কাপল টয়া এবং শাওনের বিয়ের ছবি আর ভিডিও নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ মাতামাতি শুরু হয়। টয়ার প্রথাছুট মেহেদি অনুষ্ঠান এবং বিয়ের সাজ সবারই খুব মনে ধরে। মেহেদির অনুষ্ঠানে তিনি পরেছিলেন বাসন্তী রঙের স্লিভলেস ফ্রক স্টাইল কুর্তা। বিয়েতে বেছে নিয়েছিলেন স্নিগ্ধ সাদা রঙের সারারা সেট। ধারণা করা হচ্ছিল, টয়ার দেখাদেখি অনেক বাংলাদেশি কনেই বিয়ের অনুষ্ঠানে পরার জন্য প্রথাছুট পোশাক বেছে নেবে। এখন সেই ধারণা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে। অনেকে বিয়ের অনুষ্ঠানে সারারা, ঘারারা, আনারকলি পরছে। আগে এসব পোশাক কেবল পানচিনি বা এনগেজমেন্টের দিনই পরতে দেখা যেত। এখন ঘরোয়া হলুদের আয়োজন আর বিয়ের মূল অনুষ্ঠানেও ফ্যাশন-সচেতন কনেরা এ ধরনের পোশাক পরছে। আগামীতে বাংলাদেশি বিয়ের ফ্যাশনে শাড়ি, লেহেঙ্গার পাশাপাশি সারারা, ঘারারার জনপ্রিয়তা আরও বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মাস্কে বর-বউ
সত্তর-আশির দশকে বরেরা বিয়েবাড়ি আসত রুমাল মুখে দিয়ে, এখন আসছে মাস্ক পরে! অতিমারির এই কালে নিজেদের সুরক্ষার জন্য এই মুখাবরণ পরতেই হবে। তবে বিয়ের সাজের সঙ্গে মাস্ক বড্ড বেমানান হলেও এটি একটি ফ্যাশনেবল অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুরুর দিকে বর-কনেকে সার্জিক্যাল মাস্ক পরতে দেখা গেছে। কিন্তু আজকাল বিয়ের পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে এটি পরা হচ্ছে। অনেক ফ্যাশন হাউসই বিয়ে উপলক্ষে মাস্ক বানাচ্ছে। বিয়ের শাড়ি বা পাঞ্জাবির সঙ্গে মিলিয়ে বানিয়ে নিচ্ছে বিশেষ মুখাবরণ। কনের মাস্কে দেখা যাচ্ছে নানা রঙের সূচিকর্ম, যা বিয়ের সাজে অন্য মাত্রা এনে দিচ্ছে।
গয়নার বাক্স
কিছুদিন আগেও কনেরা বিয়েতে হালকা ট্রেন্ডি গয়না পরত। সোনার গয়নার বাজার দখল করেছিল রুপা, মুক্তা, হীরা, হোয়াইট গোল্ড, পাথর আর অ্যান্টিক গোল্ড। তবে আজকাল বেশির ভাগ কনে ঐতিহ্যবাহী সাবেকি ধারার সোনার গয়না পরছে। অলংকারের জোগানদাতা মা, নানি-দাদির গয়নার বাক্স। আগে বিয়ের শাড়ি লেহেঙ্গা কেনার পর তার সঙ্গে মিলিয়ে গয়না বানানো হতো। এখন এসবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শাড়ি বাছাই করা হচ্ছে। অলংকার খুব জমকালো হলে শাড়ির ডিজাইনটি হালকা দেখে কেনা ভালো। গয়না হালকা হলে ভারী শাড়ি বেছে নিতে হবে। চাইলেই পুরোনো অলংকার মেটাল গোল্ড, সিলভার, ব্রাশ বা কপারে অক্সিডাইজ করে ‘আপসাইকেল’ করা যায়। অনেকে তা করছেও। যাদের পারিবারিক গয়না নেই, তারা খুব হালকা ধাঁচের সোনা বা রুপার গয়না বেছে নিচ্ছেন।
বরের সাজ
কনের সঙ্গে বরের সাজও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে বিয়ের পোশাক হিসেবে বরদের কাছে শেরওয়ানির অনেক কদর। এখন ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ের আয়োজনে পাঞ্জাবি বেশি পরা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাহারি রঙের কটি। সাদার পাশাপাশি মেরুন, সোনালি ধাঁচের পাঞ্জাবিই বেছে নিচ্ছে বরেরা। কেউ কেউ অবশ্য শেরওয়ানি পরছে, তবে সেটি খুব জমকালো নয়। শেরওয়ানির বিকল্প হিসেবে এই স্টাইলের পাঞ্জাবি পরতেও দেখা যাচ্ছে।
নতুন বাস্তবতায় বিয়ের আয়োজনে ছাড় দিতে হচ্ছে। কিন্তু জীবনের সবচেয়ে বিশেষ দিনটি স্মরণীয় করে রাখতেও হবে। বিয়ের সাজে ট্রেন্ডের ধারণা থাকলে পোশাক বাছাই করতে বেশ সুবিধা। তবে সব সময় যে ট্রেন্ড মেনে চলতে হবে এমনটি নয়। এর বাইরে গিয়েও ব্যতিক্রমী বিয়ের সাজ হয়ে উঠতে পারেন অনন্য ও আকর্ষণীয়।
মডেল: সায়মা
জুয়েলারি: আনজুম’স
ওয়্যারড্রোব: রিলা’স
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: ফারাবী তমাল