ছুটিরঘণ্টা I সাংগীতিক শান্তিনিকেতনে
নিসর্গ, ভবনগুচ্ছ, শিল্পকলা, পাঠশালা- সবই সেখানে এক সুরে বাঁধা। ফলে শিক্ষা, সংগীত ও জ্ঞান অবিচ্ছেদ্য রূপে বিরাজিত। রবীন্দ্রস্মৃতির এই তীর্থ নিয়ে লিখেছেন ফাতিমা জাহান
‘মোরে ডাকি লয়ে যাও মুক্তদ্বারে
তোমার বিশ্বের সভাতে
আজি এ মঙ্গলপ্রভাতে॥
উদয়গিরি হতে উচ্চে কহো মোরে:
তিমির লয় হল দীপ্তিসাগরে-
স্বার্থ হতে জাগো, দৈন্য হতে জাগো,
সব জড়তা হতে জাগো জাগো রে
সতেজ উন্নত শোভাতে॥’
বৈতালিক দিয়ে শুরু হয় সকাল। সূর্য রঙ ছড়ানোর খানিক আগে জড়ো হয় সুরের পাখিরা। শান্তিনিকেতন- নামের মধ্যেই সব মাধুর্য লুকিয়ে আছে, শান্তির সুগন্ধি পাপড়ি ছড়িয়ে রয়েছে সেখানে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিজ হাতে গড়া। যাকে ঘিরে ছিল তার অফুরন্ত আকাক্সক্ষা, ভালোবাসা। জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় তিনি এখানে কাটিয়েছেন।
এক সকালে কলকাতা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ট্রেনে চেপে সোজা বোলপুর, শান্তিনিকেতন। এখানকার একেকটি স্থানের সঙ্গে যেন আমার কয়েক জন্মের চেনাজানা।
১৮৬৩ সালের কথা। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একবার বোলপুর থেকে রায়পুরে যাওয়ার পথে ভুবনডাঙ্গা নামের নির্জন জায়গায় একটি ছাতিমগাছের নিচে কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নেন। স্থানটি তার খুবই পছন্দ হয়। তার মনে হলো, ঈশ্বরের ধ্যান ও উপাসনার জন্য জায়গাটা খুবই উপযুক্ত। পরে রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ভুবনডাঙ্গার সেই ছাতিমগাছসহ কয়েক বিঘা জমি তিনি কিনে নেন। সেখানে তৈরি করেন একটি বাড়ি, নাম দেন ‘শান্তিনিকেতন’। চারপাশের শূন্য প্রান্তরে লাগানো হয় আম, জাম, কাঁঠাল ও নারকেলগাছ। ক্রমে পুরো এলাকাটাই শান্তিনিকেতন নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িটিকে মূলত অতিথিশালা, আশ্রম ও উপাসনার জায়গা হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন।
১৮৯০ সালের শেষ দিকে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেখানে মন্দির স্থাপন করেন। প্রথম দিন উপাসনা করেছেন দ্বিজেন্দ্রনাথ আর বক্তৃতা করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর। গান গেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর সেখানে যাত্রা ও কীর্তনও হয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে একদিন রবীন্দ্রনাথ পিতার শরণাপন্ন হয়ে বললেন, ‘শান্তিনিকেতন’ এখন প্রায় শূন্য অবস্থায়, সেখানে যদি একটি আদর্শ বিদ্যালয় স্থাপন করতে পারি, তাহলে জায়গাটি সার্থক হয়ে উঠতে পারে। পিতা তখনই উৎসাহের সঙ্গে সম্মতি দিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘তখন আশ্রমের পরিধি ছিল ছোটো। তার দক্ষিণ সীমানায় দীর্ঘ সার-বাঁধা শালগাছ। মাধবীলতা-বিতানে প্রবেশের দ্বার। পিছনে পুব দিকে আমবাগান, পশ্চিম দিকে কোথাও-বা তাল, কোথাও-বা জাম, কোথাও-বা ঝাউ, ইতস্তত গুটিকয়েক নারকেল। উত্তরপশ্চিম প্রান্তে প্রাচীন দুটি ছাতিমের তলায় মার্বেল পাথরে বাঁধানো একটি নিরলংকৃত বেদী। তার সামনে গাছের আড়াল নেই, দিগন্ত পর্যন্ত অবারিত মাঠ, সে মাঠে তখন চাষ পড়ে নি। উত্তর দিকে আমলকীবনের মধ্যে অতিথিদের জন্যে দোতলা কোঠা আর তারই সংলগ্ন রান্নাবাড়ি প্রাচীন কদমগাছের ছায়ায়। আর-একটি মাত্র পাকাবাড়ি ছিল একতলা, তার মধ্যে ছিল পুরানো আমলের বাঁধানো তত্ত্ববোধিনী এবং আরো-কিছু বইয়ের সংগ্রহ। এই বাড়িটিকেই পরে প্রশস্ত করে এবং এর উপরে আর-একতলা চড়িয়ে বর্তমান গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়েছে। আশ্রমের বাইরে দক্ষিণের দিকে বাঁধ তখন ছিল বিস্তৃত এবং জলে ভরা। তার উত্তরের উঁচু পাড়িতে বহুকালের দীর্ঘ তালশ্রেণী। আশ্রম থেকে দেখা যেত বিনা বাধায়। আশ্রমের পূর্ব সীমানায় বোলপুরের দিকে ছায়াশূন্য রাঙামাটির রাস্তা গেছে চলে। সে রাস্তায় লোক চলাচল ছিল সামান্য। কেননা শহরে তখনো ভিড় জমে নি, বাড়িঘর সেখানে অল্পই। ধানের কল তখনো আকাশে মলিনতা ও আহার্যে রোগ বিস্তার করতে আরম্ভ করে নি। চারি দিকে বিরাজ করত বিপুল অবকাশ নীরব নিস্তব্ধ।…এই শান্ত জনবিরল শালবাগানে অল্প কয়েকটি ছেলে নিয়ে ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের সহায়তায় বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ করেছিলুম। আমার পড়াবার জায়গা ছিল প্রাচীন জামগাছের তলায়।’
১৯০১ সালে কলকাতা থেকে প্রায় এক শ মাইল দূরে বীরভূম জেলার বোলপুর রেলওয়ে স্টেশনের ভুবনডাঙ্গা গ্রামে রবীন্দ্রনাথের সপরিবার বসবাস এভাবেই শুরু। তার স্থাপিত বিদ্যালয়টি পরে বহু শাখাপল্লবে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের নামের সঙ্গে এটিও পৃথিবীর বিজ্ঞানী, লেখক, দার্শনিক, শিল্পী, সাহিত্যিক ও রাজনীতিকদের মনোযোগের একটি কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখানে আশ্রম করে রবীন্দ্রনাথ চেয়েছেন দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে নতুন তাৎপর্যে ভূষিত করে। সব কালে সমকালীন করে রাখে। সংস্কৃতির ধারাবাহিকতা সমাজের জন্য স্বাস্থ্যকর। তাই তার নবজাগরণ হবে- তিনি তা চাইতেন। ইউরোপীয় সভ্যতার কোনো কিছুই রবীন্দ্রনাথ নির্বিচারে গ্রহণ কিংবা বর্জন করতে চাননি। বিশ্বভারতীতে সেসব গ্রহণ, বর্জন, সৃজন, মার্জন করে পাঠের তালিকায় রেখেছেন।
আশ্রমের ধারণাটিকেও রবীন্দ্রনাথ নতুন করে তাৎপর্যমন্ডিত করতে চেয়েছেন। সেসবের মধ্যে তার পরিবেশচিন্তা ফুটে উঠেছিল। তখন পরিবেশ নিয়ে পৃথিবীর কোথাও তেমন কোনো আলোচনা ছিল না, অথচ রবীন্দ্রনাথ অনুমান করতে পেরেছিলেন, জীবনের জন্য সেটি প্রয়োজন। তাই আশ্রমের চিন্তাকেন্দ্রে ছিল পরিবেশ।
কলকাতায় জোড়াসাঁকো বাড়িতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ প্রথমে বৈদিক সাহিত্যের সংহিতা অংশ এবং পরে উপনিষদের আলোকে প্রাচীন ভারত সম্পর্কে চিন্তার পরিমন্ডল তৈরি করে রেখেছিলেন। আশ্রমে প্রথমে মুনি-ঋষিদের বসবাস ছিল। পরবর্তীকালে বাউল, লেখক, রাজনীতিবিদেরাও এসে থাকা শুরু করেছিলেন। প্রাচীনকালের আশ্রমের ধারণাকে রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞানমনস্কতা, জ্ঞান এবং সৃষ্টিশীল চিন্তায় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ দিয়েছেন। সেসব শুধু যুগোপযোগীই নয়, তাকে বহুমুখী করে তুলেছেন।
বিজ্ঞানের প্রতি তার গভীর মনোযোগের কারণে সেখানে এসব বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি জানতেন, বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার অগ্রগতি ব্যতিরেকে সাহিত্য এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চক্রের মতো ঘুরতে থাকবে।
শান্তিনিকেতনে তিনি গড়ে তুলেছেন মার্জিত, সংযত এবং পরিশীলিত রুচির পরিবেশ। সারল্য আর শুদ্ধতা- এই দুটোই ছিল এখানকার নিসর্গের ভেতরের কথা। তার জীবিতকালে চল্লিশ বছরে আনন্দ পাঠশালা ছাড়া আরও অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান এবং তার নানা বিভাগ গড়ে তুলেছিলেন সেখানে- বিশ্বভারতী, পাঠভবন, শ্রীনিকেতন, কলাভবন, সংগীতভবন, রবীন্দ্রভবন, চীনাভবন, শিক্ষাভবন।
প্রকৃতির পরশে রয়েছে ছাতিমতলা, আ¤্রকুঞ্জ, মালবীথি ও বকুলবীথি।
শান্তিনিকেতন থেকে প্রকাশিত হতো হাতে লেখা পত্রিকা। সাহিত্যসভা, আলোচনা, তর্কবিতর্ক, আবৃত্তি, সংগীত, নৃত্য ও নাট্যাভিনয়। সব দিক থেকে ছাত্রদের স্বকীয় এবং সৃজনশীল আত্মশক্তির উন্মেষ ও বিকাশ যেন ঘটে, তার উপযুক্ত পরিবেশে শিক্ষাকে আনন্দময় করাই ছিল উদ্দেশ্য।
আধুনিক কৃষি ও উদ্ভিদবিজ্ঞান এবং গো-পালনবিদ্যা পড়তে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে আমেরিকায় পাঠিয়েছিলেন। তাদের যন্ত্রচালিত বৈজ্ঞানিক চাষাবাদ ও গো-পালনকেন্দ্রে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ উৎসাহ দিয়েছেন। দেশে সমবায়ভিত্তিক যন্ত্রচালিত কৃষি খামার আন্দোলনের তিনিই প্রথম সূচনা করেন। গ্রামোদ্যোগ পরিকল্পনায় পল্লি পুনর্গঠন ও কারুশিল্প বিভাগে আধুনিক বিজ্ঞান এবং কারিগরি বিদ্যার পূর্ণ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। দেশের সমাজ ও সাংস্কৃতিক জীবনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের উদ্দেশ্যেই রবীন্দ্রনাথ সেদিন ‘স্বদেশী সমাজ’ গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন।
তিনি গতানুগতিক ধাঁচের পড়াশোনার সঙ্গে বন্ধুত্ব কোনো দিনই করতে পারেননি। নিজের কল্পনা আর দর্শন মিলিয়ে তাই শান্তিনিকেতনে একটা ব্যতিক্রমী বিদ্যালয় তৈরি করেছিলেন। যেখানে মন পাবে মুক্তি, থাকবে না গতানুগতিকতা ও কড়াকড়ি, শিক্ষায় থাকবে আনন্দের সংমিশ্রণ।
শান্তিনিকেতনে আমার ভ্রমণ শুরু হয়েছে বৈতালিক দিয়ে। সকাল চোখ মেলেছে গানের সুর আর ছন্দ নিয়ে। বৈতালিক অনুষ্ঠিত হয় উপাসনাগৃহে। সাদা রঙের একতলা রঙিন কাচ দিয়ে ঘেরা ঘরই উপাসনার দ্বার খুলে দিয়েছে। সুর যখন ছড়িয়ে পড়ে সবদিকে- গাছের পাতায়, ঘাসের শিশিরে তার রেশ রয়ে যায়।
উপাসনাগৃহের পাশে খড় বা টালির ছাউনি দেওয়া একতলা পাঠগৃহ। একদম শান্ত, শব্দহীন এক জগৎ যেন। এত নিরিবিলি, প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ, সবুজ গাছের আবরণে মোড়া পাঠগৃহে নিজেরই ছাত্র হয়ে থেকে যেতে ইচ্ছে করছিল। পাঠগৃহের পাশে গাঁয়ের সাবলীল গোলাকার মাটির ঘর, সবুজের মাঝে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। এই ঘরটির নাম তালধ্বজ। তালগাছকে কেন্দ্র করে নির্মাণ করা হয়েছে এ ঘর।
একদম সামনে চোখে পড়বে রবীন্দ্র জাদুঘর। কবির ফটোগ্রাফ, ব্যবহৃত জিনিসপত্র, লেখা, আঁকা ছবি, বিভিন্ন সময়ে পাওয়া পুরস্কার এখানে রাখা আছে। জাদুঘর পার হয়ে সামনের দিকে রয়েছে কবির বাসভবন- উত্তরায়ণ। পাঁচটি বাড়ি নিয়ে গড়ে উঠেছিল তার নিজস্ব আবাসস্থল। বাড়িগুলোর রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন নাম : উদয়ন, কোনার্ক, শ্যামলী, পুনশ্চ এবং উদীচী। একটি ভবন আরেকটি থেকে দৃষ্টিসম্মত দূরত্বের সমান।
উত্তরায়ণের প্রথম বাড়ি ‘কোনার্ক’ নির্মিত হয় ১৯১৮ সালে। প্রথম দিকে এটি সম্পূর্ণ বাড়ি বলতে যা বোঝায়, তা ছিল না। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন চারদিক খোলা একটি ঘর, যেখানে বসে তিনি শান্তিনিকেতনের খোলা দিগন্তবিস্তৃত মাঠের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব এবং দৈনন্দিন প্রাকৃতিক রহস্য উপলব্ধি করবেন নীল আকাশের অনন্তলোকে। তাই কোনার্ক গড়তে গিয়ে প্রথমে তৈরি হলো বেশ উঁচু মেঝেতে চারটি থামের ওপর খড়ে ছাওয়া চারদিক খোলা একটি ঘর। এখানে বসে লিখতে লিখতে তিনি প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন। ঘরের পশ্চিমে বেশ কয়েকটি সিঁড়ি দিয়ে নিচে একটি শোবার এবং তার পাশে একটি ছোট খাবার ঘর ছিল। এখন অবশ্য কোনার্কের বহিঃরূপ ইট কাঠ সিমেন্টের স্থাপনা।
রবীন্দ্রনাথ ছেষট্টি বছর বয়সে ‘শ্যামলী’ গৃহ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তার চিন্তায় আসে এমন একটি বাড়ি, যা হবে পুরোপুরি মাটির, এমনকি তার ছাদও। মৃত্যুর পর মানুষ বিলীন হয়ে যায় ধূলিতে। তাই ধুলোমাটি দিয়েই তৈরি হোক একতলা বাড়ি, যার নাম হবে ‘শ্যামলী’। এটি কোনার্কের ডান দিকে। বাড়িটি তৈরি হয়েছিল মাটির কলসি এক-একটা গায়ে গায়ে সাজিয়ে। তাই শ্যামলীর দেয়াল খুব পুরু। কলসিগুলো ছিল শোয়ানো এবং তাদের মুখগুলো ঘরের ভেতরের দিকে। ভেতরে মাটির আস্তরণ। কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা বাড়ির বাইরে মাটির দেয়ালে নানা মূর্তি ও শান্তিনিকেতনের জীবনযাত্রার বিভিন্ন ছবি এঁকে অপরূপ করে তুলেছিলেন। মাটির ঘরের জানালার পাশে লেখার টেবিলে বসে কবির মন উড়ে যেত সেই কোনো সুদূরে আলপথের পাখির ডাকে সাড়া দিয়ে।
এখন অবশ্য সেই মাটির ঘর নেই। মজবুত করে গড়া হয়েছে সিমেন্ট দিয়ে। তবে দূর থেকে দেখলে মাটির ঘর বলেই মনে হয়।
শ্যামলীর পর ‘পুনশ্চ’। রবিঠাকুরের মন এক পরিবেশে, এক ঘরের দেয়ালের মধ্যে বেশি দিন আবদ্ধ থাকত না। নতুন লেখার তাগিদে দরকার হলো পরিবর্তন। তাই শ্যামলীর পূর্ব দিকে পুনশ্চর আবির্ভাব। তার জিনিসপত্র থাকত শ্যামলীতে। সকালবেলা লেখা ও ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে তিনি পুনশ্চর ঘরটিতে প্রবেশ করতেন। সারা দিন চলত লেখা ও ছবি আঁকা। এখানে তিনি বেশির ভাগ সময় ছবি আঁকায় মগ্ন থাকতেন। আবার কোনো কোনো সময় রাতও কাটিয়েছেন। ‘পুনশ্চ’য় বসবাসকালে সুবিধামতো ঘরটির রূপও ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়। এখন বাড়িটি একতলা হালকা হলুদ বর্ণের, হলুদ ফুল হয়ে চারদিক আলো করছে।
১৯২১ সাল থেকে ‘উদয়ন’-এর কাজ শুরু হয়। যখন যেমন অর্থ পাওয়া গেছে, সেভাবেই এগিয়েছে নির্মাণকাজ। তাই ঘর, ছাদ ও বারান্দার মধ্যে সংগতি এখানে পাওয়া দুষ্কর। এই অসংগতিই যেন উদয়নের সৌন্দর্য। রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ উদয়নের একতলার বসবার ঘর সাজিয়েছিলেন জাপানি রীতিতে। এই ভবনের স্থাপত্যে রয়েছে দেশি-বিদেশি শিল্পশৈলীর সংমিশ্রণ। ধবধবে সাদা দোতলা বাড়ি প্রথমেই উত্তরায়ণ চত্বরে চোখে পড়ে। ভবনের পাশে কবির নিজস্ব গাড়ি রাখা আছে।
উত্তরায়ণের শেষ নির্মাণ ‘উদীচী’। যথারীতি ‘পুনশ্চ’য় কয়েক মাস বাস করার পর আর সেখানে ভালো লাগল না কবির। প্রতিবারের মতো এবারেও প্রয়োজন অনুভূত হলো নতুন পরিবেশে চারদিক খোলা একখানি ঘরের, যা তার কাব্যচর্চার অনুকূল হবে। পুনশ্চর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে গোলাপ বাগানের গায়ে কয়েকটি ঢালাই করা থামের ওপর একটি চারদিক খোলা ঘর তৈরি হলো। সেখানে কাঠ বা কাচের চিরাচরিত জানালা ছিল না। ছিল রাজস্থানি স্থাপত্যের অনুকরণে অলংকৃত খোলা গবাক্ষ। এই ঘরে ওঠার জন্য বাগানের রাস্তার ধার থেকে একটা খোলা সিঁড়িঘরটির সঙ্গে যুক্ত ছিল। পরবর্তীকালে কবির মৃত্যুর পর এই বাড়ির ওপর-নিচে কয়েকটি নতুন ঘর যোগ হয়। রাজস্থানি জানালাকেও ঘরের চেহারায় ফিরিয়ে আনা হয়।
আটাত্তর বছর বয়সে, অর্থাৎ মৃত্যুর কিছুদিন আগে থেকে কবি এই ঘরে বসবাস শুরু করেন। এটিই তার শেষ গৃহবদল। তার শেষ জীবনের আঁকা বহু ছবি ও কবিতার মধ্যে হৃদয়ের যে ব্যাকুলতা ও গভীর অনুভূতির প্রকাশ, তা এই উদীচীর মুক্ত ঘরেই সৃষ্ট।
রবীন্দ্রনাথ প্রাণের কথা বলে যান অবলীলায়। প্রকৃতির উদাত্ত স্পর্শ তাতে আছে বলেই সেই লেখার মধ্য দিয়ে আমরাও অনুভব করতে পারি অনন্তকে। আজ চারদিকে এত কোলাহল, এত কলরোল, এত দেখানেপনার মাঝে যখন মনটা অস্থির হয়ে ওঠে, চারপাশে অবিরত ঘটতে থাকা নানা ঘটনা থেকে ক্ষণিকের মুক্তি চাই, তখনই আমাদের সেই কাক্সিক্ষত মুক্তি মেলে রবীন্দ্রকাব্যে, গানে, কবিতায় এবং শান্তিনিকেতনে।
উত্তরায়ণের মায়াজালে আটকে হারিয়ে গিয়েছিলাম, নিজের ভেতরেই শূন্যতা এবং পূর্ণতা দুই-ই একসঙ্গে অনুভব করছিলাম। রবীন্দ্রনাথ এখানে গান বাঁধতেন, উদাস হতেন, গাইতেন, হেঁটে বেড়াতেন, কবিতায় আকাশে-বাতাসে এঁকে দিতেন প্রেম।
উত্তরায়ণই শুধু নয়, শান্তিনিকেতনে যে আরও অনেক কিছু দেখার বাকি এখনো। পা চালিয়ে চললাম কলাভবনের দিকে। দুধারে গাছের সারি, সবুজ চোখে আবেশ আনে, পায়ের নিচে লাল মেঠোপথ, মাথার উপর কবির আশীর্বাদ হয়ে ঝরছে টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা। সংগীতের মতোই।
কলাভবনের বাইরের দেয়াল পুরোটাই কালো বেইসের ওপর সাদা রঙ দিয়ে আঁকা।
সে ভবনের পাশে গ্রামের চালাঘরের মতো কয়েকটি নান্দনিক ঘর আর তার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে খোদাই করা ভাস্কর্য।
আরেক প্রান্তে গৌরপ্রাঙ্গণ, সিংহসদন, দিনান্তিকা এবং শান্তিনিকেতন নামের মূল ভবনটি। এটি ছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ধ্যান ও উপাসনাগৃহ। কবি সপরিবার এখানে অল্প কিছুদিন থাকার পর আর কেউ এ বাড়িতে থাকেননি।
আরেক দিকে আম্রকুঞ্জ। পাঠভবনের নিয়মিত শিক্ষাদান করা হয় এই আমগাছগুলোর নিচে। সেখানে সংগীত এর প্রধান অনুষঙ্গ।
শান্তিনিকেতনের পথঘাটের মায়া ত্যাগ করা যায় না। তাই মন ছোটে বকুলতলা থেকে অনতিদূরে সোনাঝুরির বনে। কখনো উপাসনাগৃহ থেকে কোপাই নদীর তীরে। যেখানে সাঁওতালপল্লি থেকে বাউল এসে ধরেন সাঁওতালি সুর, ‘হেথায় তোকে মানাইছে না রে, একেবারে মানাইছে না রে।’
গ্রামবাসী সাঁওতালি হস্তশিল্পের পশরা সাজিয়ে বসেন সোনাঝুরির হাটে।
এত প্রাণবন্ত, এত অকৃত্রিম রূপ দেখা যায় শুধু এই শান্তির আবাসস্থলে।
সারাবেলা বনভূমি, শিল্প-সাহিত্যের আলোয় ঘুরে বেড়িয়ে মন পড়ে থাকে কবির কাছেই। তিনিই জানেন সকলের মনের কথা। তাই যেন বলেছিলেন,
‘তোমার অন্ত নাই গো অন্ত নাই,
বারে বারে নূতন লীলা তাই।
আবার তুমি জানিনে কোন বেশে
পথের মাঝে দাঁড়াবে নাথ হেসে,
আমার এ হাত ধরবে কাছে এসে,
লাগ্বে প্রাণে নূতন ভাবের ঘোর
তোমায় খোঁজা শেষ হবেনা মোর।’
ছবি: লেখক