skip to Main Content

ফিচার I ডিজেয়িং

তিন দশক ধরে চলছে সংগীতের এই ধারা। শাদি থেকে সাকরাইন- সব উৎসবেই এর চাহিদা আজকাল তুঙ্গে। শুরুতে ধনাঢ্য শ্রেণির বিনোদনের খোরাক হলেও এখন প্রায় সর্বজনীন। পেশা হিসেবে নিয়েছেন অনেকেই। দেশের ডিজেরা মাতাচ্ছেন বিদেশি পার্টিও। তাদের নিয়ে এই নিবন্ধ

ডিজে রাহাত

মধ্য আশিতে বাংলাদেশে সংগীতের নতুন এক ধারার আবির্ভাব ঘটে। ডিস্ক জকিং; সংক্ষেপে ডিজেয়িং। তখন ক্যাসেট দিয়েও ডিজেয়িং করা হতো। সংগীতের এই ঘরানায় যেসব ইনস্ট্রুমেন্ট ব্যবহৃত হয়, সেগুলো খুব একটা সহজলভ্য ছিল না। দামও ছিল আকাশচুম্বী। ফলে এই বিনোদন কেবল ধনাঢ্যদের মধ্যেই সীমিত ছিল প্রায় দুই দশক। এরপর ধীরে ধীরে তা জনমানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে নিউ মিলেনিয়ামে মধ্যবিত্তরাও ডিজেসংগীত উপভোগী হয়ে ওঠে। এখন ডিজেপাড়া মাতিয়ে রেখেছেন রাহাত, সনিকা, জিকো পল, জর্জ খান, জুডোসহ আরও অনেক ডিজে। তাদের শুরু ২০০৪ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে। ‘শাদি টু সাকরাইন’ সবকিছুতেই ডিজেয়িংয়ের চাহিদা এখন। খুব বেশি ইনস্ট্রুমেন্ট ও আর্টিস্ট না লাগার কারণে পার্টি মাতাতে এই ফর্ম সমকালে পোক্ত জায়গা করে নিয়েছে।

ডিজে জিকো পল

কিন্তু বাংলাদেশে এই সংগীতের গ্রহণযোগ্যতা তৈরির পটভূমি এক দিনে গড়ে ওঠেনি। মানুষকে এর সঙ্গে অভ্যস্ত করে তোলা সহজ ছিল না। উল্লিখিত ডিজেরা তো বটেই, দেশের অন্যান্য আর্টিস্টের চেষ্টায় এই সংগীত সম্প্রতি জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। বিশেষ করে পার্টিতে। এখন এটি একটি প্রফেশনও। দেশের ডিজেরা বিদেশ মাতিয়ে ফেরেন। তবে সংগীতের এই ধারা খুব ফ্যাশনেবল বলে তা এখন মূল উদ্দেশ্য ছেড়ে ‘লোক দেখানোর’ দিকে ঘুরে যাচ্ছে বলে কথিত আছে। প্রশিক্ষিত ডিজের অভাবও বোধ করেন পেশাদার আর্টিস্টরা। ‘এখন বাংলাদেশে ডিজে অ্যাভেইলেবল। কিন্তু এর বেসিকটা অনেকে জানে না। ডিজে হতে হলে টোটাল বেসিকটা জানতে হয়। ইন্টারন্যাশনালি মুভ করতে হলে এই বেসিক ক্লিয়ার থাকতে হবে। ডিজেদের এসব বিষয়ে ভালোভাবে ট্রেইন আপ করা দরকার।’ কথাগুলো বলছিলেন ডিজে জিকো পল। ২০০৮ সাল থেকে এর সঙ্গে যুক্ত তিনি। এখন দেশের একটি অ্যামিউজমেন্ট পার্কের ওয়াটার সেকশনের অফিশিয়াল ডিজে হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি ডিজেয়িং শেখাচ্ছেন ৪৮ জন স্টুডেন্টকে।
দেশের প্রথম নারী ডিজে ‘সনিকা’। তার মতে, নারী ডিজেদের মধ্যেও এখন প্যাশন কম। তিনি বলেন, ‘এখনকার মেয়েরা ডিজেয়িংকে ফ্যাশন হিসেবে নিচ্ছে। কিন্তু ওদের এটা চিন্তা করা উচিত যে কীভাবে মানুষকে বেটার মিউজিক দেওয়া যায়, কীভাবে ভেরিয়েশন আনা যেতে পারে। আমি বলতে চাই, যারাই ডিজেয়িং করতে চায়, তারা যেন নতুন কিছু নিয়ে আসে।’ দেশের নারী ডিজেয়িংয়ের পথিকৃৎ বলা চলে সনিকাকে। মিউজিকের এই ফর্ম নিয়ে দেশ-বিদেশ মাতাচ্ছেন তিনি।
ডিজেয়িংয়ের প্রতি তরুণদের ঝোঁক বাড়ছে। চাহিদার বিস্তৃতিও ঘটছে। সাম্প্রতিক হালচাল নিয়ে আলাপকালে ডিজে জর্জ বলেন, ‘এখন এই সেক্টরে অনেক ডিজে বেড়েছে, অনেকের এ বিষয়ে আগ্রহও বেশ। কাজ করার জায়গা আগের থেকে বেড়েছে। কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য কমেও গেছে। তবে ডিজে খুব বড় একটা মার্কেট। এখানে আরও বড় পরিসরে কাজ করার অনেক স্কোপ আছে।’ ডিজেপ্রেমীরা ‘ডিজে জি’ নামে যাকে চেনেন, তিনিই জর্জ খান। ২০০৭-এর শেষের দিকে তার ডিজেয়িং শুরু। মালয়েশিয়া, দুবাই ও কাতারের বিভিন্ন পার্টিতে পারফর্ম করেছেন তিনি। এই অঙ্গনের কারও কারও প্রশ্ন, দেশে কাজ করার স্কোপ কি জুনিয়র ডিজেরা পাচ্ছেন? সিনিয়ররা তাদের খোঁজখবর কতটা রাখেন? দেশের ভেতর সিনিয়র-জুনিয়র ডিজেদের আন্তসম্পর্কটাই-বা কেমন? ডিজে জিকো পলের উত্তর, ‘এই সেক্টরের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, কারও সঙ্গে কারও বন্ডিং নেই। সিনিয়র থেকে জুনিয়র- ডিজের সঙ্গে ডিজেদেরই দূরত্ব আছে। মুখে মুখে বন্ডিংয়ের কথা বলা হলেও তা উপরে উপরে দেখা যায়। কিন্তু বাস্তবে কিছুই নেই। আগে ডিজেদের মেন্টালিটি ঠিক করতে হবে। বাইরের দেশে সিনিয়ররা জুনিয়র ডিজেদের প্রমোট করে। বাংলাদেশে সেই অবস্থা নেই। একজন ডিজের শুরুর ভিত্তিটা গুরুত্বপূর্ণ।’

ডিজে সনিকা

এ বিষয়ে ডিজে রাহাত বলেন, ‘একটা অনুষ্ঠানে যখন ডিজের প্রয়োজন হয়, তখন সেটা ডিপেন্ড করে কে কোন ডিজেকে চায়। আয়োজকদের পছন্দের ডিজে থাকে। এটা প্রায়শই ঘটে, বেশি টাকা খরচ করে একজন অপরিচিত কিংবা নতুন ডিজেকে নিয়ে আসা হয়। এটা ব্যক্তিপছন্দের ওপর নির্ভর করে। এখানে সিনিয়র জুনিয়রের বিষয় নেই। এটার প্রমাণ এভাবে দেওয়া যায় যে ঢাকায় সাধারণ সময়ে মিনিমাম ১০০টা শো হয়। তার মানে ১০০ জন ডিজে ১০০ জায়গায় পারফর্ম করেন। কেননা, একজনের পক্ষে তো ১০০ জায়গায় থাকা সম্ভব নয়। যারা কোনো না কোনোভাবে শো পাচ্ছে না, তারা হয়তো মনের কষ্টের জায়গা থেকেই এই কথাগুলো বলে যে সিনিয়রদের কারণে আমরা শো পাচ্ছি না। ১০০টা শোতে যে ১০০ জন ডিজে থাকে, সেখানে ১০০ জনই তো আর সিনিয়র নয়। তাহলে তারা কারা? তা ছাড়া আমি আমার স্টুডেন্টদের শুধু যে ডিজেয়িং শেখাই, তা নয়। তাকে আমি মোটামুটি রেডি করি যেন সে যখন একটি শোতে গিয়ে বাজায়, আমার সম্মান সেখানে বজায় রাখে।’ দেশের আধুনিক ধারার ডিজেয়িংয়ের পথিকৃৎ বলা চলে রাহাতকে। এখনকার সুপরিচিত ডিজেদের অনেকেই তার হাতে গড়া।
ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিদিনই বেশ কিছু ডিজে পার্টি হলেও করোনাকালে এসব আয়োজনে ভাটা পড়েছে। জিকো পল বললেন, ‘করোনা পরিস্থিতির জন্য একটু থমকে আছে বাংলাদেশের ডিজে সেক্টর। তবে এটা রানিং হচ্ছে। একটু সময় দরকার। ঘরোয়া প্রোগ্রামগুলো হচ্ছে। কিন্তু ডিজের যে বড় আয়োজনগুলো হয়ে থাকে, সেসব আপাতত বন্ধ আছে।’ একই অভিমত মিলল ডিজে জুডুর বক্তব্যে। তিনি বললেন, ‘করোনার পর এখন ধীরে ধীরে ডিজে পার্টিগুলো শুরু হয়েছে। ছোট ছোট ইভেন্ট হচ্ছে। ধারণা করছি, থার্টি ফার্স্টে বড় ইভেন্ট করা সম্ভব হবে।’ ২০০৭ সালে ডিজেয়িং শুরু করা জুডু জানালেন পার্টি আয়োজনের সীমাবদ্ধতার কথাও। ‘আয়োজনের ক্ষেত্রে পারমিশন প্রয়োজন হয়। সেটার জন্য অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তাই বাংলাদেশে চাইলেও অনেক বড় বড় ইভেন্ট আমরা করতে পারি না। আগে বাইরে থেকে ডিজে এনে পার্টি করা হতো। তাদের সঙ্গে বাংলাদেশি আর্টিস্টরাও কাজ করত। এখন আর সেগুলো হয়ে ওঠে না। এখানেও পারমিশনের জটিলতা।’ নিজের বক্তব্যে যোগ করলেন ডিজে জুডু।

ডিজে জুডু

বাইরের দেশে ডিজেয়িংয়ের বেশ কদর। একেকটা পার্টিতে মোটা অঙ্কের টাকা লগ্নি হয় বলে জানালেন ডিজে সনিকা। তার মতে, ডিজেয়িং বেশ এক্সপেনসিভ প্রফেশন। এখানে অভিজাত লোকদের আনাগোনা। মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্টও বেশি দরের। তাহলে কি এই প্রফেশন এখনো কেবল ধনাঢ্যদের জন্য? জিকো পল অবশ্য তা মনে করেন না। তিনি বলেন, ‘উচ্চ কিংবা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসার বিষয়টা ডিজেয়িংয়ে কোনো ভ্যারিই করে না। যেটা ভ্যারি করে তা হলো, একজন জকিকে পরিবার থেকে কেমন সাপোর্ট দেওয়া হয়েছে। মূলকথা হচ্ছে, বাংলাদেশে ডিজেটা এখন অনেক এগিয়ে গেছে, কিন্তু অনেকের পরিবারই জানে না, ডিজে কী। ধীরে ধীরে দেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে, ডিজেও মিউজিকের একটি সেক্টর। তবে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ধনী পরিবার থেকে এলে একটা সুবিধা আছে। তার লিংকটা ভালো থাকে। প্রোগ্রামের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না। কারও হাতে-পায়ে ধরতে হয় না। এটা শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে।’
আজকাল ইউটিউব টিউটোরিয়াল দেখেও ডিজেয়িং শেখার ব্যবস্থা আছে। তবে হাতে-কলমে শেখার সঙ্গে কোনো কিছুরই তুলনা চলে না। ডিজে রাহাত বলেন, ‘আগে ডিজেয়িংয়ের জন্য সময়, শ্রম ও মেধা- সবকিছুর প্রয়োজন ছিল। কারণ, তখন সবকিছুর এক্সেস এত ইজি ছিল না। এখন ইন্টারনেট ও ইউটিউব থাকায় ডিজেদের টিপস ও ট্রিকস যা যা লাগে, সবকিছুই অনলাইনে মেলে। এসবে ডিজেয়িং কোর্সও করা যাচ্ছে। সে ধরনের প্রতিষ্ঠানও আছে। সুবিধাও আছে ইন্টারন্যাশনালি। তা ছাড়া ইউটিউবে ভালো ভালো ডিজের টিউটোরিয়াল আছে। সেখান থেকে সবকিছু শিখতে পারছেন। যেমন ‘গ্যারেজ’ নামে যে ডিজে হাউস আমি প্রতিষ্ঠা করেছিলাম, সেখানে সবাইকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিতাম। যেটা প্রপার ওয়েতে দেওয়া দরকার, সেটা হয়তো ভিডিও দেখে শেখা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া ভিডিও দেখে শেখা অনেক সময়সাপেক্ষ ও অনেক প্র্যাকটিসের ব্যাপার। কিছু অ্যাডভান্স কোর্সও আছে। ডিজেয়িংয়ের কঠিন বিষয়গুলোর সমাধানও সেখানে শেখানো হয়।’

ডিজে জি

সংগীতের এই ধারায় তরুণদের ভীষণ আগ্রহ। এখন প্রায় সব ডিজের চাওয়া- একটি সংগঠন। যেটা গঠিত হওয়ার কথা থাকলেও এখনো সেভাবে গড়ে ওঠেনি।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top