ফিচার I সফর-এ-কাওয়ালি
গানের সঙ্গে অধ্যাত্মসাধনার যোগ ঘটে সংগীতের এই ধারায়। ভারতবর্ষের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছেন এর শিল্পীরা। বাংলাদেশেও আছেন
কাওয়ালির জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য দেখিয়ে গেছেন নুসরাত ফতেহ আলী খান! আকাশসংস্কৃতির জমানায় তার উত্তরপুরুষ রাহাত ফতেহ আলী খান অথবা দিল্লির নিজাম এলাকার নিয়াজি-নিজামি ভাইরাও পরিচিত। তবে ঢাকায় চট করে এক কাওয়াল খুঁজে পাওয়া বিস্ময়কর। এখানকার ‘বংশগত একমাত্র কাওয়াল’ বলে পরিচয় দেওয়া নাদিম এহতেশাম রেজা খাঁ।
আরবি ‘কাওল’-এর অর্থ হলো ‘কথা’, বিশেষত মহানবী (সা.) সম্পর্কিত। কাওয়াল শব্দের অর্থ, যে কথাগুলো (কাওল) প্রায়শই প্রতিধ্বনিত করে (গায়)। আর কাওয়ালি হলো কাওয়ালরা যা গায়। এর অর্থ এভাবেই দিয়েছেন টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি ডিকশনারি অব অ্যারাবিকের সংকলক বিএ কোরেশি।
কাওয়ালি হলো ভারতীয় উপমহাদেশের সুফি ঘরানার গান ও সুরের উপস্থাপন, যা ভারত, পাকিস্তান আর বাংলাদেশে আবর্তিত, বিশেষত খানকাহগুলো ঘিরে। এ গানের একেকটা আসরকে বলা হয় মাহফিল-এ-সামা। এর উদ্ভব মূলত অষ্টম শতাব্দীর পারস্যে। আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় সুফি মতবাদ ও দর্শনের। দার্শনিক ভাবধারার শ্লোকে সাজানো দলগত সংগীত আয়োজন তৎকালীন সুফি চর্চার অন্তর্গত ছিল। আবু হামিদ আল গাজালি (১০৫৮-১১১১ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন এই শ্লোকগুলোর শ্রেষ্ঠ কবি। ফার্সি-হিন্দুস্তানি ঘরানার এই সংগীতের অন্যতম গজলের আঙ্গিক তারই আবিষ্কার।
একাদশ-দ্বাদশ শতকে ভারতে সুফিদের মূল আস্তানা মুলতান ও পাঞ্জাবকেন্দ্রিক হলেও ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে তা ছড়িয়ে পড়ে কাশ্মীর, বিহার, বাংলা আর দাক্ষিণাত্যে। তাদের বয়ে আনা কাওয়ালি দিল্লিতে এসে পড়ে হজরত আমির খসরুর কাছে। চিশতিয়া সিলসিলার অন্যতম পুরুষ, দিল্লির নিজাম-উদ-দিন আউলিয়া (র.)-এর এই শিষ্য এই গানকে শাস্ত্রীয় সংগীতের ব্যাকরণসম্মত রূপ দেন।
বঙ্গ এলাকায় কাওয়ালির প্রচলন কে করেছিলেন, তা সঠিক জানা যায় না। তবে ইতিহাস বলে, বাংলায় চিশতিয়া সিলসিলা ত্রয়োদশ-চতুর্দশ এমনকি তার আগেও বেশ প্রভাবশালী ছিল। তবে বাংলায় শুরুতে প্রবেশ করেছিল সোহরাওয়ার্দিয়া সিলসিলার সাধকেরা। তাদের অনুবর্তী হয়েছিল চিশতিয়া ধারার অনুসারীরা। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক বলেছেন, ‘চিশতীয়হ্ ও সুহরব্র্দীয়হ্ সম্প্রদায়ের সাধকদের মধ্যে গান ও বাজনা একটি অপরিহার্য্য বিষয়। এই দুই সম্প্রদায়ভুক্ত সাধকেরা গান ও বাজনার সাহায্যে হৃদয়কে উত্তেজিত করিয়া অধ্যাত্মভাবে বিভোর হইয়া যাইতেন। কখনও কখনও নাচিতে নাচিতে (‘হ্বল্কহ্’ করিতে করিতে) কখনও কখনও ভাবিতে ভাবিতে তাহারা হঠাৎ দশাগ্রস্ত (হ্বাল্) হইয়া পড়িতেন।…বঙ্গদেশে এই সম্প্রদায়ের প্রাধান্যই অধিক ছিল। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাঙ্গালার প্রাচীন ‘খানক্বাহ; বা স্বূফী আশ্রম বা আখড়াগুলি একদা আধ্যাত্মিক রাগ-রাগিণীর মধুর লীলায় লীলায়িত ও উদ্দাম নর্ত্তনে (হ্বল্কহ্) মুখরিত ছিল। এই রূপে গান-বাজনার সহিত উদ্দাম নর্ত্তনের সঙ্গে বাঙ্গালীরা স্বূফীদের দ্বারা সর্ব্বপ্রথম পরিচিত হইয়াছিল।’
সুফি প্রভাবেই বাংলায় ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক লোকসংগীতের জগতে বেশ কিছু পরিবর্তন, পরিবর্ধন ঘটে। ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে বৈষ্ণব শ্যামা সংগীত আর সহজিয়া ধারার বাউল সুফি ‘সামা’ থেকেই প্রভাবিত হয়ে উদ্ভূত। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ।
গ্রিক নোজিসের ধারণার মতোই মা’রিফাত অভ্যন্তরীণ জ্ঞানের নির্দেশ করে, যা সাধারণের কাছে অধরাই থেকে যায়। এর বিন্যাস ও উপাদানে সুরের ভেতরে কালাম বা শব্দজুড়ে দুরধিগম্য মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয়। নির্দিষ্ট সুফি শব্দমালা ব্যবহারের মাধ্যমে ওই ভাবকে আরও বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে গভীরতা সৃষ্টি করে। কাওয়াল প্রায়ই একটি বাক্যাংশ বা বাক্যে আটকে গিয়ে সেই অংশের নিশ্চিত ও গুপ্ত উপাদানকে নির্দেশ করেন; তাতে বিভিন্ন শব্দ আর পদের উপর জোর দিয়ে আর বারবার বলার ভেতর দিয়ে, শ্রোতাদের মাঝে অর্থ পুরোপুরি আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত। কাওয়াল ইসলামের আধ্যাত্মিকতা ভাগ করে নেন এই বিশ^াসে যে জ্ঞান বিনোদনের মাধ্যমেও ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
কাওয়ালি এবং এর গায়কদের উদ্দেশ্যের একটি হলো ধর্মীয় পরিবেশে শ্রোতাদের মোহগ্রস্ত করে তোলা। কাওয়ালের এই দক্ষতার চরম পরীক্ষা হয় কাওয়ালির সঙ্গে অপরিচিত শ্রোতাদের সামনে, তবে উঁচু পর্যায়ের সাধকেরা সমস্ত শ্রোতাকেই মোহগ্রস্ত করতে পারেন ‘হাল’ (দশাগ্রস্ত) পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে, এমনকি তারা যদি একটা শব্দও না বোঝে। দশাগ্রস্ততা অনেকভাবেই প্রকাশিত হতে পারে। এটির শেষ পর্যায় হলো ফানা। এই পর্বে পার্থিব চেতনা লোপ পায় এবং চিরন্তনের সঙ্গে চূড়ান্ত সাক্ষাৎ ঘটে। কদাচিৎ কাওয়ালির আয়োজনে মৃত্যুর নজিরও রয়েছে। তখন এই ঘটনাকে মৃত ব্যক্তি ফানা লাভ করেছেন বলে আখ্যা দেওয়া হয়। বলা হয়ে থাকে, দিল্লির হজরত কুতুব-উদ-দিন বখত-ইয়ার কাকি ১২৩৬ সালে সুরের মোহেই এক কাওয়ালির আসরে মারা গিয়েছিলেন।
কাওয়ালি সাধারণত পুরুষেরাই পরিবেশন করেন। তবে রিচার্ড এম ইটন দেখিয়েছেন, দাক্ষিণাত্যে মহিলারা সুফিদের লেখা গান গেয়ে থাকেন বিভিন্ন পারিবারিক পরবে। ইবনে বতুতার মতেও খোদ দিল্লিতে ইসলামি সংগীতে পারদর্শী মহিলারা ছিলেন, যারা রমজানে নারীদের তারাবির জামাতে সুরেলা কণ্ঠে সুরা পড়তেন। এখন আবিদা পারভীন বা রেশমার মতো শিল্পীরও উত্থান ঘটেছে। বহু বিখ্যাত পুরুষ কাওয়ালের সঙ্গে তাদের নামও উচ্চারিত হয়।
প্রথমে কাওয়ালি গাওয়া হতো ফার্সিতে। পরে ধীরে ধীরে যেসব এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে, সেখানকার ভাষা যোগ হয়েছে এই গানে- পাঞ্জাবি, উর্দু, পূর্বী, ব্রজ, দক্ষিণি ও বাংলা। কাজী নজরুল ইসলামও কিছু কাওয়ালি লিখেছেন। লালনের গানের কথাতেও সুফি প্রভাব স্পষ্ট। শ্রোতাদের সঙ্গে সংযোগে ভাষা বাধা হয়ে দাঁড়ালে এর গভীরতা বোঝাতে এবং মোহগ্রস্ততা তৈরি ও পরমানন্দ সঞ্চার করতে কাওয়ালরা সুরের ধরন আর ছন্দময়তার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ নুসরাত ফতেহ আলী খান। তিনি পশ্চিমা শ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করেছিলেন ছন্দ আর স্বরক্ষেপণের বৈচিত্র্যে।
কাওয়ালির আসর বসে মূলত বৃহস্পতিবার রাতে, দরগা বা সুফিদের মিলনস্থলে। এর বাইরে সাধারণত ওরসে বড় আসর অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক কাওয়াল ও শ্রোতারা পদ্মাসনে বসেন মাটিতে, দরগার উঠানে। মোহরি বা মূল গায়ক মাঝখানে বসেন, দরগার দিকে মুখ করে, পীরকে সম্মান জানাতে। তবলাবাদকেরা তার পেছনে বসেন, আর প্রম্পটার বা আওয়াজিয়া তার বাঁ কাঁধের সামান্য পেছনে বসে থাকে। মোহরির দুপাশে সাধারণত দুজন করে গায়ক থাকেন হারমোনিয়াম, দাফলি আর মাঞ্জিরা নিয়ে। কোরাস শিল্পীরা দুপাশে সারিবদ্ধ হয়ে বসেন। প্রায়ই দ্বিতীয় লিড কাওয়ালকে দেখা যায় আওয়াজিয়ার বাঁ পাশে, তিনি মূল কাওয়ালকে পুরো আসরে সহায়তা করেন। এই দ্বিতীয় কাওয়ালের ধারণা আসে দলে দুই ভাই অথবা বাবা-ছেলে থাকলে। সাধারণত সম্মান দেখিয়ে মূল কাওয়ালের থেকে সবাই একটু পিছিয়ে বসে। এ ক্ষেত্রে কিছু অলিখিত নিয়মও থাকে- দক্ষতা, বয়সভেদে। এই ক্রমে যারা নিচের দিকে, তারা পেছনে বসে। তাদের কায়াদা বলা হয়। যদিও এখন প্রযুক্তির কারণে বসার নিয়মে একটু বদল এসেছে।
নাদিম এহতেশাম রেজা খাঁর মতে কাওয়ালি চর্চার মূল ধরন হলো কণ্ঠ আর তালি। সময়ের পরিবর্তনে কিছু লোকজ বাদ্যযন্ত্রের প্রয়োগ ঘটেছে। যেমন ভারতীয় কাওয়ালির প্রবাদপুরুষ আমির খসরুকেই সেতার আর তবলার আবিষ্কারক বলা হয়। কাওয়ালি শুরু হয় আলাপের ভেতর দিয়ে, মূল গায়ক আল্লাহ, মহানবী (সা.) আর পীরকে স্মরণ করেন দ্বিপদী শ্লোকের মাধ্যমে। এ সময়টায় দলের অন্যরা ও শ্রোতারা নীরব থাকে, যেটা কাওয়ালির আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার পরিবেশ তৈরি করে দেয়। প্রথম পর্যায়ে একটু গতি তুলে কাওয়ালরা কাওয়ালির মূল অংশে প্রবেশ করেন, যেখানে ছন্দ মাঝারি লয়ে থাকে। এরপর লয় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আর কাওয়াল ও কায়াদারা শ্রোতাদের গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। কোনো শব্দ, বাক্য বা সুর শ্রোতাদের ছুঁয়ে গেলে তার পুনরাবৃত্তি হয়।
ঢাকার কাসিদা-কাওয়ালির প্রশংসা থাকলেও এই গান নিয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই। বাংলাদেশে বংশপরম্পরায় কাওয়াল বলতে যা বোঝায়, সেটা একমাত্র নাদিম এহতেশাম রেজা খাঁ-ই, সে কথা অনেক জায়গা থেকেই শোনা গেছে। তার মামাতো ভাই ভারতে, চাচাতো ভাই পাকিস্তানে কাওয়ালি পরিবেশন করছেন এখনো। এহতেশাম রেজা খাঁ, দাদা কেয়াম রেজা খাঁ, পূর্বপুরুষ নবী রেজা খাঁ, ওয়ালী রেজা খাঁ- এভাবে তাদের বংশের আরও পুরোনো কাওয়াল রয়েছেন, যারা নাকি কাওয়ালির শুরু থেকেই তা পরিবেশন করে আসছেন। তার সঙ্গে এই লেখার সূত্রে কথা বলে জানা গেল ঢাকার হাইকোর্ট মাজারে খাজা শরফুদ্দিন চিশতী (র.)-এর দরগায়ও একসময় বসত কাওয়ালির আসর। হজরত শাহ আলী বোগদাদী (র.)-এর দরগা রয়েছে মিরপুরে, সেখানে এখনো মাহফিলে সামা হয়। নাদিম সাহেবের চাচারা নবাববাড়ির পীর সাহেব নাজমুল হাসান (র.)-এর সঙ্গে সিলেটে হজরত শাহজালাল (র.)-এর মাজারে চাদর পেশ করে মাহফিলে সামায় যোগ দিতেন বলে তিনি জানান। শরীয়তপুরে চিশতিনগরেও কাওয়ালির আসর বসে। পাশাপাশি পপ কালচারে ঢুকে যাওয়া কাওয়ালিকে এখন সামাজিক অনুষ্ঠানেও আদৃত হতে দেখা যায়। ঢাকাতেই কাওয়ালির চর্চা করছেন আরও অনেকে। দরগাকেন্দ্রিক কাওয়ালও কম নেই, তাদের অগ্রজদের ইতিহাস চমকপ্রদ হওয়ার কথা। তবে ঢাকার ঐতিহাসিকদের কাওয়ালি নিয়ে নীরবতা বেশ পীড়াদায়ক।
আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট