skip to Main Content

স্মরণ I সৌমিত্র-অন্বেষণ

সত্যজিৎ রায়ের সিনেমায় সৌমিত্রের উপস্থিতি শুধুই অভিনয়ের আখ্যান নয়। এই যুগলবন্দিতে রচিত হয়েছিল কলকাতার সাংস্কৃতিক আধুনিকতার চলচ্চিত্রবৃত্তান্তও। সদ্য প্রয়াত এই শিল্পীর স্মরণে লিখছেন অতনু সিংহ

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধ থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ অবধি বঙ্গীয় রেনেসাঁ বা নবজাগরণের ন্যারেটিভ বৃহৎ বঙ্গের প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসচর্চায় আজও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। অন্যদিকে, পশ্চিমা দৃষ্টিতে প্রাচ্য দেখার ভঙ্গিমা নানা স্তরে বহুদিন ধরে খারিজ হওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ফলত রেনেসাঁ, নাকি ঔপনিবেশিকতার সঙ্গে সম্পৃক্ত কলকাতার বাবু বাঙালি কর্তৃক পশ্চিমা চিন্তার উপনিবেশ-পরিকাঠামোর মজবুত ভিত্তি নির্মাণ- এই প্রশ্ন, বিতর্ক, বাহাস বঙ্গের সাংস্কৃতিক ইতিহাসচর্চার গুরুত্বপূর্ণ দিক। এসব প্রসঙ্গ ভাবনায় নিয়ে সম্প্রতি প্রয়াত অভিনয়শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কৃতিত্ব অন্বেষণ করা দরকার। সত্যজিতের চলচ্চিত্রমাধ্যমে তার অভিনয়শিল্পই হতে পারে আমাদের আলোচনার উৎস।
আধুনিকতার কথা বলা হচ্ছে; কারণ, প্রথমত সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের একজন প্রথম সারির অভিনয়শিল্পী। দ্বিতীয়ত, তার কথা বলতেই সত্যজিতের প্রসঙ্গ উঠবে। একজনকে বাদ দিয়ে অন্যজনকে স্মরণ এবং মূল্যায়ন অসম্ভব। তৃতীয়ত, সত্যজিতের চলচ্চিত্র আঙ্গিক ও ফিল্ম-ল্যাঙ্গুয়েজ এবং সৌমিত্রের অভিনয়ের স্টাইলাইজেশন নিয়ে আলাপ করতে হলে সমাজ-রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাতে কলকাতার শিল্প-সাহিত্যে বুর্জোয়া আধুনিক নন্দনতত্ত্বের প্রসার ও পাশ্চাত্য আধুনিকতার বঙ্গীয় তথা উপমহাদেশীকরণের মতো বিষয়গুলো উল্লেখ করা প্রয়োজন। নইলে প্রয়াত এই চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পীর যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব নয়। চতুর্থত, এই যুগলবন্দিতে বাংলা সিনেমা আধুনিকতায় উত্তরণের বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে। রুপালি পর্দায় সৌমিত্রের অভিনয়ের ফর্মালিজম এবং সত্যজিতের চলচ্চিত্র নির্মাণে একদিকে হলিউডের ধ্রুপদিয়ানার উপাদান, অন্যদিকে ইউরোপীয় (পড়ুন ইতালীয়) নব্য বাস্তবতাবাদের প্রেরণা বাংলা সিনেমাকে একটি বৈশ্বিক শিল্পধারার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করেছে। তার ভাব বা দার্শনিক উপাদানগত জায়গা আধুনিকতা। আর বঙ্গীয় আধুনিকতার বিষয়টি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রসঙ্গে উত্থাপনের সর্বশেষ যে কারণটিতে আলোকপাত করা যায়, তা হলো, সত্যজিতের যেসব ছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন, বেশির ভাগ সিনেমা অন্তর্বস্তু, আখ্যান ও চরিত্রায়ণের দিক থেকে ঔপনিবেশিক আধুনিকতা অনুসরণ করার বদলে জানালা খুলে রাখার মতো করে বিশ্বের আলো-বাতাস গ্রহণ করেছে। আবার নিজেদের অন্তর্জগৎকে প্রকাশ করেছে বহির্বিশ্বের সামনে। এমনকি চলচ্চিত্রের দুনিয়াদারির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আত্মনির্মাণও করেছে ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং উপমহাদেশীয় সমাজবাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে, যা শৌখিন সামন্তবাদী বাবু বিলাসিতা নয়; বরং তার সমান্তরালে প্রগতিশীল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক নান্দনিকতার উপমহাদেশীয় পরম্পরার ধারা নির্মাণ। বাংলা চলচ্চিত্রের শতবর্ষের ইতিহাসে এই প্রগতিশীল বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক নান্দনিক ধারার পরিচালক সত্যজিৎ রায়, আর সফল অভিনয়শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আমরা সত্যজিতের ছবিতে সৌমিত্রের অভিনয়ের বিষয়ে আলাপ করব। তার আগে এই ধারা সূচনার পরিপ্রেক্ষিত এবং সেই সংক্রান্ত কয়েকটি সর্বজনবিদিত ঐতিহাসিক তথ্যে আলোকপাত করা দরকার।
আমরা জানি, সিনেমা একই সঙ্গে ফরাসি গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও বুর্জোয়া শিল্পবিপ্লবের ফসল। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশে তো এই ধরনের বিপ্লব কোনো দিনই হয়নি, তারপরেও চলচ্চিত্র মাধ্যমটি এখানে ক্রিয়াশীল হয়েছে তার উদ্ভবের ঠিক পরেই। বলা ভালো, হীরালাল সেনের বঙ্গভঙ্গবিরোধী প্রামাণ্যচিত্রের (সম্ভবত ১৮৯৯ সালে তার প্রথম সিনেমা নির্মিত হয়) বিজ্ঞাপনে ‘খাঁটি স্বদেশি সিনেমা’র মতো ক্যাপশন ছিল। অর্থাৎ চলচ্চিত্রের উন্মেষ ইউরোপে হলেও তার বঙ্গীয়করণের চেষ্টা ছিল শুরু থেকেই। এখন কথা উঠতে পারে স্বদেশি আন্দোলনের শ্রেণি-প্রেক্ষাপট নিয়ে। সেই তর্কে না ঢুকেও বলা যায় সিনেমা ইতিবাচক অর্থেই ইটসেলফ একটি বুর্জোয়া শিল্পমাধ্যম। এ উপমহাদেশে বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লব না হলেও দ্বারকানাথ ঠাকুরদের মতো ব্যবসায়ীর উত্থান হয়েছিল এই মাটিতেই। ফলে বঙ্গের জাতীয় বুর্জোয়ার বিকাশের সম্ভাবনা ভালোমতোই যে ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ঔপনিবেশিক অর্থনীতি ও রাজনীতি সেই সম্ভাবনা খারিজ করলেও আন্তর্জাতিক পরিসরের সঙ্গে যোগাযোগের দরজা অনেক আগেই খুলে গেছে। তাই এটা বলাই যায় যে বঙ্গে নবজাগরণের বিষয়টি নানাভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও ফরাসি বিপ্লব এবং শিল্পবিপ্লবের ইতিবাচক প্রভাব এখানেও পড়েছিল। সেই প্রভাবের রাজনৈতিক প্রসার ফোর্ট উইলিয়ামের সুবাদে প্রতিহত হলেও সাংস্কৃতিকভাবে তা সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। চলচ্চিত্রের দিকে যদি তাকাই, হলিউড স্টুডিও সিস্টেমের সমান্তরালে কলকাতায় বিগত শতাব্দীর ৩০-৪০ দশকে রমরমা চলচ্চিত্র সম্ভার হাজির করেছে নিউ থিয়েটার্স। এখানকার সিনেমার স্বাভাবিক অগ্রগতি জারি ছিল। এই যাত্রাপথেই সত্যজিৎ, ঋত্বিক, মৃণাল- কলকাতাকেন্দ্রিক এই ত্রয়ী সিনে-মাস্টারের আবির্ভাব। হলিউড ক্ল্যাসিকস ও ইতালিয়ান নিওরিয়ালিজম প্রভাবিত সত্যজিতের সিনেমায় অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। মৃণাল সেনের চলচ্চিত্র-ভাষাকে আমরা যদি আরবান গেরিলা কমিউনিস্ট (যা অনেকাংশে প্রথম দিকে ফ্রান্সের নব্যতরঙ্গের সিনে-ভাষা প্রভাবিত বলা যেতে পারে) বলা হয়, তবে ঋত্বিক একই সঙ্গে শ্রেণিসচেতন কিন্তু দেশীয় তথা বঙ্গীয় লৌকিক সিনেভাষার জন্ম দিয়েছেন, এটা বলা যেতে পারে। অন্যদিকে সত্যজিৎ অবশ্যই পশ্চিমা আধুনিক ধ্রুপদিয়ানার সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়েছেন প্রাথমিকভাবে। তার অনেকগুলো সিনেমার গুরুত্বপূর্ণ অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যথাযথভাবে ওই পাশ্চাত্য ধ্রুপদিয়ানার ফর্মালিস্ট, মিনিমালিস্ট, পরিশীলিত অভিনয় রীতির সাক্ষ্য রেখে গেছেন আমাদের কাছে। ইতালিয়ান চলচ্চিত্রী ফেদেরিকো ফেলিনির চলচ্চিত্রে যেমন পরিশীলিত, মার্জিত, রোমান্টিক অভিনেতা মার্সেলো মাস্ত্রোয়েইনি অথবা হলিউড ক্ল্যাসিকসের পুরোধা অরসন ওইয়েলসের সিনেমায় জোসেফ কোটেক, ঠিক তেমনই সত্যজিতের ফিল্মোগ্রাফির মধ্যে অপরিহার্য হয়ে ওঠেন বাংলা সাহিত্যের ছাত্র, থিয়েটারের অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
কলকাতাকে সৌমিত্র বহন করেছেন তার অভিনয়ের মধ্যে। ধারণও। এই ঔপনিবেশিক শহর পাশ্চাত্য আধুনিকতার আমদানির সুবাদে এবং রণরক্তসহ নানাবিধ পরিপ্রেক্ষিতের সাক্ষ্য বহন করে একদা হয়ে উঠেছিল উপমহাদেশের শিল্প-সাহিত্যের কেন্দ্রভূমি। যে কলকাতা একই সঙ্গে বাবুয়ানি বা এলিটিজমের দোষে দুষ্ট, আবার যে শহর হয়ে উঠেছিল উদ্বাস্তুর ঠিকানা, খাদ্য আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি, ধ্রুপদিয়ানা গড়ার ও ভাঙার আভাঁগার্দ নান্দনিকতার বিচরণভূমি- সৌমিত্রের অভিনয়ভঙ্গিমা এবং তার অভিনয়জীবনের মধ্যে সেই শহরের ক্যানভাস জড়িয়ে রয়েছে।
সৌমিত্রের মধ্যে বিভূতিভূষণের অপুকে নতুনভাবে আবিষ্কার করা যায়। এই চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কলকাতার ছাপোষা মধ্যবিত্তের জীবনসংগ্রাম, অশ্রু, নান্দনিক বোধ ও রোমান্টিকতা পরিস্ফুট। আমরা অপু আর অপর্ণার প্রেমে পড়ে যাই, অশ্রু-ঝলমল চোখে দেখি রুপালি পর্দায় প্রজন্মকে কাঁধে করে পথ চলছেন অপু। তার হাসি, অশ্রু, লাজুক চাহনির মধ্যে আমাদের বুকের ভেতর আগলে রাখা রোমান্টিক কোনো ‘আমি’র সন্ধান পেয়ে যাই। উপন্যাসের গল্প অতিক্রম করে রুপালি পর্দা থেকে অপু ঢুকে পড়েন আমাদের মায়ার মননে। আমরা একবার ভালোবেসে ফেলি অপুকে, আরেকবার সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। আবিষ্কার করি আমাদের স্মৃতিবিজড়িত কলকাতা।
শুরু থেকেই খুব আলগোছে যে কথা বলতে চাইছি, তা হলো কলকাতার বাবুয়ানি, ভদ্রবিত্ত সমাজে নারীর অন্দরজগৎ, আর্ট এন কালচার ও সমাজবোধ- সবকিছুকে পোস্টমর্টেম করে গেছেন ব্রাহ্ম জমিদারতনয় রবীন্দ্রনাথ। তার যোগ্য উত্তরসূরি সত্যজিৎও সেই সাহস দেখাতে পেরেছিলেন। তিনিও এলিট, কলকাতাকেন্দ্রিক ব্রাহ্ম। ‘চারুলতা’য় বিমল চরিত্রের মধ্যে ভদ্রবিত্তের রোমান্টিকতা, শিল্প ও সমাজচেতনা এবং পারিবারিক ঘেরাটোপকে অতিক্রম করে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার মতো বিষয়গুলো সৌমিত্রই তার অভিনয়ের মধ্য দিয়ে যথাযথ মূর্ত করতে পেরেছিলেন। সৃজনশীল ও নিঃসঙ্গ চারু চরিত্রের যোগ্য সাহচর্য হয়ে উপন্যাসে বিমল যেভাবে প্রকাশিত, তার থেকেও আরেকটু প্রাণবন্তভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন তিনি।
অশনি সংকেত সিনেমায় আমরা নীতিবান, আদর্শবাদী ডাক্তারবাবু চরিত্রে একইভাবে সৌমিত্রকে আরও একবার নতুন করে পেয়ে যাই। কলকাতা সাক্ষী ছিল ঔপনিবেশিক ও পশ্চিম ভারতীয়দের যৌথ প্রযোজনায় বঙ্গে মন্বন্তর-দুর্ভিক্ষের দিনগুলোতে। সেই ক্ষুধা, অর্থাভাব আর দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে মানবিকতার মুখ আমরা খুঁজে পাই ‘অশনি সংকেত’ সিনেমায়। কিংবা কলকাতা শাসন করেছে যে কবি-লেখকদের গোষ্ঠী ‘কৃত্তিবাস’, তাদের রোমান্টিকতা, পাতিবুর্জোয়া হর্ষ-রোমাঞ্চ আর নিজেদের আয়নার মুখোমুখি দাঁড় করানোর দিনশেষে এক শহুরে কাব্যিক প্রয়াস, তাদেরই প্রতিনিধি তথা এই পত্রিকার একদা সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’কেও সত্যজিৎ সাহস দেখিয়েছিলেন নব্যবাস্তববাদী চলচ্চিত্রবোধের জায়গা থেকে চিত্রায়িত করার। সেটি উপন্যাসকেও কোথাও কোথাও ছাপিয়ে গিয়ে চলচ্চিত্রের স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও শমিত ভঞ্জ এবং তাদের সাহচর্য দেওয়া শর্মিলা ঠাকুর, কাবেরী বসু, সিমি গাড়েয়ালদের মতো অভিনয়শিল্পীদের কারণে। উল্লেখ্য, এ সিনেমাতেও সৌমিত্র স্বমহিমায় আবির্ভূত হয়েছিলেন।
সত্যজিতের সৌমিত্র নিয়ে কথা বলব অথচ ‘ফেলুদা’ সিরিজ নিয়ে আলাপ করা হবে না, সেটা তো সম্ভব নয়। কলকাতাকেন্দ্রিক বাঙালির মধ্যে আধুনিকতা, আধুনিক রাষ্ট্রচেতনা এবং তাকে ঘিরে অপরাধবিজ্ঞানের হদিস দেওয়ার ক্ষেত্রে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ও সত্যজিৎ রায়ের নামই সর্বাগ্রে আসবে। বাঙালিকে শিল্পসম্মত, নান্দনিক উপাদানসমৃদ্ধ গোয়েন্দা আখ্যান পরিবেশনায় শরদিন্দুর ব্যোমকেশ চরিত্রটির অনেক পরে চলচ্চিত্রায়িত হলেও সত্যজিৎ নিজের সাহিত্যভুবনের চরিত্র ফেলুদাকে নিয়ে পরপর সিনেমা বানাতে ভোলেননি। ফেলুদা একই সঙ্গে পাশ্চাত্য অনুষঙ্গের আধুনিক, আবার পাশাপাশি তিনি পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি। এই সিরিজে সৌমিত্র তার সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন জটায়ু চরিত্রে সন্তোষ দত্ত আর তোপসের ভূমিকায় সিদ্ধার্থ চট্টোপাধ্যায়কে। সৌমিত্রের অভিনয়-আঙ্গিক নিয়ে এই গদ্যে বারবার যে কথাগুলো বলা হয়েছে, অর্থাৎ স্মার্ট, মিনিমালিস্ট, ফর্মালিস্ট, পরিশীলিত ইত্যাদি উপাদান ফেলুদা চরিত্রে বিদ্যমান। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, পরবর্তীকালে সব্যসাচী চক্রবর্তী কিংবা অন্য আর যারাই ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করুন না কেন, সৌমিত্রকে অতিক্রম করা কারও পক্ষেই সম্ভব হয়নি। কারও কারও অভিনয়ে সৌমিত্রই রয়ে গেছেন অন্দরে।
‘দেবী’, ‘অভিযান’, ‘গণশত্রু’, ‘শাখাপ্রশাখা’ ইত্যাদি চলচ্চিত্রে প্রথম পর্বের ও পূর্ণতা পর্বের সত্যজিৎ আঁকড়ে রেখেছিলেন সৌমিত্রকে। এ কথা ঠিক, নকশালবাড়ি আন্দোলন, ষাট-সত্তরের দশক ইত্যাদি বিষয় যখন সত্যজিতের ছবিতে হাজির হচ্ছে, তখন সেভাবে সৌমিত্রের উপস্থিতি ছিল না। তবে কলকাতাকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রায়িত আধুনিকতার মুখবন্ধ রচনায়, ধ্রুপদিয়ানা নির্মাণে ও মনস্তাত্ত্বিক গভীরতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় নয়, সৌমিত্রের কাছেই ফিরতে হয়েছে চলচ্চিত্রকারকে। কারণ, সত্যজিৎ জানতেন, তার অভিনয় যতই ফরমাল, ভদ্রবিত্ত ও মিনিমালিস্ট হোক না কেন, তাতে জাদুও আছে। রয়েছে আবেগের মার্জিত প্রকাশও। যা আমরা নানা পর্বেই দেখেছি। তা অপুর সংসারে হোক কিংবা অভিযান, অশনি সংকেত বা গণশত্রু অথবা শাখাপ্রশাখায়।
এই ম্যাজিকের কথা বলতে হলে অবশ্যই ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার উদয়ন পন্ডিত চরিত্রটির কথা আসবে। রোমান্টিক, দ্রোহপূর্ণ ও ম্যাজিক্যাল চরিত্র সেটি। যেখানে সৌমিত্র মঞ্চ অভিনয়ের কলাকৌশল প্রয়োগ করেছিলেন বলেই মনে হয়। ছবিটি ফ্যান্টাসিমূলক, রূপকথাধর্মী। তাই চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে হাইপ্যারাবোলিক আর্কিটাইপাল অভিনয়ে দেখা গিয়েছিল সৌমিত্রকে। ঋত্বিকের ছবির চরিত্রায়ণের ক্ষেত্রে শিল্পীদের অভিনয় যেমন। আমরা আজও প্রতীক্ষা করি, কবে পর্দা থেকে বেরিয়ে আসবেন উদয়ন পন্ডিত, আর জুলুমের অবসানে তিনিও গোপনে ষড়যন্ত্র করবেন আমাদের সঙ্গে নিয়ে। আমরা তার হাত ধরে ভোর বেলায় ময়দানে গিয়ে জুলুম আর ব্রেইনসাফের মূর্তিটাকে ভাঙব; বলব, ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’। হ্যাঁ, কলকাতার আধুনিকতা এই দ্রোহবাক্যেরও জন্ম দিয়েছিল। সত্যজিৎ আর সৌমিত্রের মধ্য দিয়ে।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top