কভারস্টোরি I সংগীতের সংবেদনে
ধ্বনিকে ছন্দে আর সুরে বেঁধে মানুষ সৃষ্টি করেছে সংগীত। নিজের ইন্দ্রিয়কে তৃপ্ত করার জন্যই শুধু নয়, জীবনের বৃহত্তর পরিসরে আবেগের ঐশ্বর্যকে অনুভব করতেও এর ভূমিকা অসামান্য। ফলে শিল্পকলার সব শাখার মধ্যে এর তরঙ্গকম্পন সবচেয়ে তীব্র। লিখেছেন চঞ্চল আশরাফ
পিকাসো বলেছিলেন, সব মহৎ শিল্পকলাই সংগীত হয়ে উঠতে চায়। অর্থাৎ, তিনি শিল্পকলার বিভিন্ন শাখার মধ্যে মিউজিকের স্থান উপরেই রেখেছেন। অথবা বলা যেতে পারে, শিল্পের উত্তরণ সংগীতে উপনীত হওয়ার মধ্য দিয়েই ঘটে। কিন্তু এক দিনে বা হঠাৎ করে মানুষের মধ্যে এমন উপলব্ধি তৈরি হয়নি। জানা যায়, প্রাচীন মানুষ গুহাগাত্রে ছবি আঁকার পাশাপাশি মনোযোগী হয়েছিল সংগীতে। ধারণা করা হয়, পাথরযুগের অধিবাসীরা শিকারযাত্রার আগে এবং পশু হত্যার পর আবেগ ও আনন্দ প্রকাশের জন্য উল্লাসধ্বনি করত। সম্ভবত এটিই ছিল মানুষের প্রথম সংগীত তৈরির অসচেতন চেষ্টা। তারা নৃত্যের সঙ্গে উচ্চারিত কণ্ঠস্বরে আবিষ্কার করেছিল একধরনের ছন্দময়তা। তাই সংগীতকে বলা হয় গীত, বাদ্য ও নৃত্যের সমাবেশ। প্রাচীন মানুষ এসব পেয়েছিল প্রকৃতি থেকে। ধীরে ধীরে তা আকার পেতে থাকে। তবে খ্রিস্টজন্মের প্রায় চার হাজার বছর আগে অসংগঠিত হলেও কিছুটা শাস্ত্রসম্মতভাবে সংগীতের চর্চা শুরু হয় মিসরীয় সভ্যতায়।
জানা যায়, পৃথিবীর সব দেশেই ধর্মের সঙ্গে সংগীতের একটি নিবিড় যোগ রয়েছে। আবার যুদ্ধক্ষেত্রেও তা অপরিহার্য ছিল। গ্রিকরা প্রথম এই ক্ষুদ্র পরিসরের বাইরে মিউজিকের সীমানা বিস্তৃত করে। তারা উপলব্ধি করেছিল, কেবল ব্যবহারিক জীবনের কয়েকটি বিশেষ ক্ষেত্রে সংগীতকে গন্ডিবদ্ধ রাখলে তা পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে না। এভাবে সংগীত মানবজীবনে অনিবার্য হয়ে ওঠে। মানুষের জীবনে এর প্রভাব যে কত সুদূরবিস্তৃত, তা উপলব্ধি করে তারাই। এ কারণে শ্রোতার মানসিক উৎকর্ষ সাধনের চেষ্টাও হয়েছিল। যেমন পাশ্চাত্যের চার্চসংগীত, ভারতবর্ষের নাম গান, পর্বাদি উপলক্ষে গান। যেগুলোর সুর ও উপস্থাপন রীতি নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে আধ্যাত্মিক জগৎ পার হয়ে যুক্ত হয়েছে বৃহত্তর অনুভূতির সঙ্গে। ক্রমশ উন্নীত হয়েছে সর্বজনীন স্তরে।
রোমানরা সংগীত শিখেছিল গ্রিকদের কাছে। শুরুর দিকে যুদ্ধক্ষেত্রে এর প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে যেসব বাদ্যযন্ত্র কাজে লাগে, সেগুলো সম্পর্কেই তারা বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। তখন স্ট্রেইট ট্রাম্পেট (সোজা আকারের ভেরি), লিটমাস (ইংরেজি জে অক্ষরের মতো ভেরি), বাকসিনা (আরেক শ্রেণির ভেরি), ঢাক এবং খঞ্জনির বিশেষ সমাদর ছিল। কিন্তু এভাবে বেশি দিন চলেনি। তারা সংগীতের সৌন্দর্যের দিকটি বুঝতে পেরেছিল। একটি অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্রও আবিষ্কার করেছিল। এখনকার অর্গানের আদি সংস্করণ সেটিই। গ্রিকদের ‘সিরিঙ্কস’ যন্ত্রটির কিছু উন্নতি সাধন করে এটি তৈরি হয়েছিল। সংগীতের অগ্রগতির ইতিহাসে তা একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
বাংলা অঞ্চলে সংগীতের ইতিহাস পাওয়া যায় পাল বংশের রাজত্বকালে। তখনকার প্রচলিত গানের আঙ্গিক ছিল স্তোত্র। পূজা-অর্চনার জন্য এগুলো গাওয়া হতো। শেষ রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেব রচিত ‘গীত গোবিন্দ’-এর পদগুলোও গীতিপ্রধান। সেসব ছিল ‘প্রবন্ধ শ্রেণি’র সংগীত। তবে দশম শতাব্দীতে চর্যাপদগুলো গীত হতে থাকে। এগুলোকে এই অঞ্চলের প্রাচীনতম সংগীত মনে করা হয়। চর্যায় রাগের উল্লেখ রয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে সেসব গাওয়া হতো। উল্লেখ্য, চর্যাকারেরা ছিলেন সম্ভবত হঠযোগী। তারা সূর্য ও চন্দ্রের যোগ সাধনা করতেন। এতে প্রাণায়ামের মাধ্যমে বায়ুরোধ করে সাধনায় সিদ্ধিলাভের উপায় ছিল। চর্যাকারেরা আশঙ্কা করেছিলেন, তাদের মৃত্যুর সঙ্গে এই সহজ সাধনা হারিয়ে যাবে। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, মানুষকে প্রভাবিত করার একমাত্র পথ হলো সংগীত। তা দীর্ঘদিন স্মৃতিতে ধরেও রাখা যায়। তখন সৃষ্টি হলো চর্যাগীতি।
১২০১ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির আগমনের পর বাংলাদেশে মুসলমান শাসনের সূত্রপাত। তখন থেকেই এখানে সংগীতের নতুন ধারার আবির্ভাব ঘটে।
তবে প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ রোগে, শোকে, আনন্দে, বেদনায়, জন্ম-মৃত্যুতে, এমনকি খাদ্য সংগ্রহেও অতিপ্রাকৃতের অস্তিত্ব অনুভব করত। তাকে তুষ্ট করার প্রধান পথই ছিল সংগীত। গীত, বাদ্য ও নৃত্যের সহযোগে তারা পূজা-অর্চনায় মন দিয়েছিল। পিরামিড থেকে শুরু করে সিন্ধু সভ্যতার নানান খননকাজের মাধ্যমে পাওয়া জিনিসের মধ্যে রয়েছে বাঁশি, বীণা ইত্যাদির অস্তিত্বের নিদর্শন। সামবেদ ও ঋগবেদে নৃত্য, গীত এবং বাদ্যের প্রচলনের কথা পাওয়া যায়।
তবে মানুষের সঙ্গে সংগীতের নিবিড় সম্পর্কের কারণ, মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য বিভিন্ন স্বরের ব্যবহার। সেই স্বর ধীরে ধীরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গানের উদ্ভব ঘটায়। মানুষ অন্যের মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে কণ্ঠস্বরের সাহায্যে এক প্রকার মনোহর ধ্বনি উচ্চারণ করত। যেগুলো পরবর্তীকালে উৎকর্ষ লাভ করে এবং কালক্রমে সংগীতবিদ্যায় পরিণত হয়।
অভিব্যক্তিবাদীরা মনে করেন, সংগীত মানবমনে অনুভূতি ও আবেগ জাগায়, ভাব সঞ্চার করতে সক্ষম হয়। শ্রোতার চিত্তে যে উপলব্ধি জাগিয়ে তোলে, তা বিশ্বজনীন, প্রাকৃতিক এবং আবশ্যকীয়। কোনো কোনো শিল্পতাত্ত্বিক শ্রোতার আবেগপূর্ণ অভিজ্ঞতা বলতে তাদের মেজাজকে বুঝিয়েছেন, যা মস্তিষ্কে স্থায়ীভাবে বাসা বাঁধে এবং কখনো কখনো ব্যক্তিকে সঞ্চালিত করে। আবেগ এ ক্ষেত্রে ক্ষণস্থায়ী। তবে সংগীতের প্রভাবে সংবেদনশীল শ্রোতার আচরণেও কখনো কখনো দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখা যায়। আবেগে-আনন্দে অশ্রু ঝরে, চোখ-মুখের পেশির সংকোচন-প্রসারণ ঘটে। এমনকি ঘুম আনতেও তা অনুঘটকের কাজ করে। মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, মিউজিক ভোক্তার মনে, স্নায়ুতে, শ্বাস-প্রশ্বাসে, রক্তচাপে শিহরণ তোলে। এতে মনোদৈহিক আচরণে প্রভাব পড়ে। গতিশীল ও উদ্দীপনাময় হয়ে ওঠে।
শিল্পী তাল, লয়, সুর ও ছন্দসহযোগে সংগীত সৃষ্টি করেন, তখন শ্রোতা কোনো একটি বিশেষ প্রত্যাশায় আকুল হয়ে ওঠেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না গায়কের দক্ষতা সমস্ত অনিশ্চয়তা দূর করে খাঁটি আনন্দ লাভের পথ প্রশস্ত করে। শ্রোতার উৎকণ্ঠাও অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীকে স্পর্শ করে। তিনি নতুন শিল্প সৃষ্টিতে অনুপ্রাণিত হন। কেননা, প্রত্যাশা আভাসজাত এবং বিশেষ ধরনের রীতির ওপর এর ক্রিয়া প্রতিফলিত হয়। মানসিক ক্রিয়া সংগীতের অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত। আবার সচেতন মনের প্রতিটি স্পন্দনের ওপরেও এর রূপ ও ছায়া কোনো না কোনোভাবে রেখাপাত করে। তা ছাড়া সংগীত সৃষ্টির মধ্যে বিশ্বপ্রকৃতির সর্বজনীন ভাবধারা ফুটে ওঠে। এতে কাজ করে ইন্দ্রিয়ানুভূতি (সেনসেশন), প্রত্যয় (ইমপ্রেশন), অনুভব (ফিলিং), প্রেরণা (ইমপালস) ও আবেগ (ইমোশন)। এগুলো শিল্প সৃষ্টির অনুষঙ্গ, যা মানুষের মনোজগৎ ও মস্তিষ্ক বিকাশের সঙ্গেও সম্পৃক্ত।
প্রকৃতির বিভিন্ন ফর্ম, রং, ছন্দ, সুর, তাল, লয়ই মানুষ দৈনন্দিন ও ব্যবহারিক জীবনকে সমৃদ্ধ এবং উন্নত করার কাজে লাগিয়েছে। সংগীত মূলত এসবেরই একটি শিল্পিত ধ্বনিরূপ। কেবল সুর সংযোজিত ধ্বনির প্রকাশ নয়, মনুষ্যসৃষ্ট প্রতিটি ফর্মের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সংগীতের স্পন্দন। ভাস্কর্য নির্মাণে, স্থাপত্যকলায়, তৈজসপত্রে, এমনকি মানুষের চলন, উচ্চারণ, ঘুম, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঞ্চালনেও এই স্ফুরণ রয়েছে।
যেমন সভ্যতার প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। পিরামিড, মাচুপিচু বা কান্তজিউ মন্দির, অথবা অজন্তা, ইলোরা, উদয়গিরি, কোণারক ভুবনেশ্বরের মন্দির কিংবা বাংলাদেশের শালবন বৌদ্ধবিহার, আহসান মঞ্জিল, নাটোরের উত্তরা গণভবনসহ হাল আমলের অনেক বাস্তুকলা- প্রতিটি স্থাপনার নির্মাণশৈলীতে রয়েছে প্রচ্ছন্ন সুর ও ছন্দের প্রভাব। কেননা এসবের মধ্যে শিল্পীর অনুভব ও উপলব্ধির রং খেলা করে, রেখা এবং রূপের প্রতিচ্ছবি জেগে ওঠে। গানের সুর এবং স্বরের মধ্যেও এসবের স্পর্শ রয়েছে। সংগীতের রাগ-রাগিণীর সঙ্গে রং ও রূপের চিত্রমালাও তাই দেখা যায়। তা কেবল ভারতীয় কাংড়া ও দক্ষিণি চিত্রাবলিতেই নয়, মিকেল অ্যাঞ্জোলো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, পাবলো পিকাসো, সালভাদোর দালি, ফ্রিদা কাহলো, নভেরা আহমেদ প্রমুখ শিল্পীর আঁকা ছবি বা নির্মিত ভাস্কর্যের মধ্যে সাংগীতিক প্রক্ষেপণ লক্ষ্যযোগ্য; যা আমাদের ইন্দ্রিয় ও সংবেদনকে জাগিয়ে তোলে। মানবিক আনন্দের অনুভূতি দেয়।
সংগীত যেন দেহধারী। এমন একটি সত্তা যা তার নিজের জগতেই ইন্দ্রিয়কে সজাগ করতে উদ্গ্রীব। ভারী গয়নার মতো সৌন্দর্য বাড়ায় না, ছবির মতো ফুটে ওঠে। এর ধ্বনি যে রূপ সৃষ্টি করে, তা শূন্যগর্ভ নয়, আবার ফাঁকা স্থান পূরণও করে না। জীবন্ত সৃষ্টির একটি পরিপূর্ণ আকার উপস্থিত করে। ধ্বনি অশরীরী এবং সূক্ষ্ম। হেগেল তাই সংগীতকে বলেছেন আইডিয়া, যা মূলত শিল্পীর চিন্তা ও অনুভূতির দ্বারা একটি সমগ্র মূর্তি গড়ে তোলে। স্থাপত্যকলা, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, বাগান পরিকল্পনা, এমনকি বাস্তুসংস্থানের মধ্যেও এই রূপ কিংবা আকার দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। সুরের যেমন উত্থান-পতন, আরোহী-অবরোহী, স্বরান্তর, সংগতি প্রভৃতির বিন্যাস রয়েছে, মানুষের জীবনাচরণ এবং অপরাপর শিল্পেও তারই একটি প্রতিচ্ছবি মূর্ত হয়।
তা ছাড়া জীবনযাপনের নানা পর্যায়ে সংগীতের সম্পর্ক তো রয়েছেই। ইন্দ্রিয়াতীত অভিভোগের মধ্যেও আছে তার ক্রিয়াশীলতা। সেবাস্টিয়ান বাখ, মোৎসার্ট, বেটোফেন, চাইকোভোস্কি, বিসমিল্লাহ খাঁ, রবিশঙ্কর এবং হালের ইয়ানির মিউজিক ব্যক্তির অন্তর্জগতে যে আবেশ ও আবেগ তৈরি করে, তা যেমন উদ্দীপনাময়, অনুপ্রেরণা সৃষ্টিকারী তেমনি নিজের সত্তার গভীরে প্রবেশের এক নতুন অভিজ্ঞতার উৎস।
সব কালে সব দেশেই প্রচলিত থেকে যায় কিছু সংগীত। যেগুলো মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। যেমন ছড়া গান। শিশুদের শান্ত করতে বা তাদের ঘুম পাড়াতে এসব গানের সুর ও ছন্দ একটা মোহনীয় আবেশ তৈরি করে। সংগীতের নানান ধ্বনিতরঙ্গ সব বয়সের মানুষের ইন্দ্রিয় ও মনোজগতে প্রভাব ফেলে। তা কেবল সংবেদনশীলদের মধ্যেই নয়, আপাতদৃষ্টিতে স্থূল সংস্কৃতির ধারক মনে হলেও কোনো না কোনোভাবে মানুষের আবেগকে জাগিয়ে তুলতে এর ভূমিকা রয়েছে। তবে বয়স, অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি- ইত্যাদির ভিন্নতায় মিউজিকের পৃথক আয়োজন দরকার। দেখা গেছে, সংগীতবিমুখ ব্যক্তির মনেও সুরের আবেশ কাজ করছে। তাই ছাদ পেটানোর গান যেমন রয়েছে, তেমনি আছে ভিক্ষাবৃত্তি, হাটে-বাজারে পণ্য বা ওষুধ বিক্রির সংগীতও। খেলাধুলার সঙ্গে এর সম্পর্ক তো সর্বজনবিদিত। বেশ আগে থেকেই এটি চলে আসছে। খেলা শুরুর আগে গান গেয়ে খেলোয়াড় ও দর্শকদের অনুপ্রাণিত করার জন্য এটি অনিবার্য একটি উপাদান। গ্রিক গ্লাডিয়েটর যুদ্ধ (মূলত তা ছিল তখনকার সম্রাটদের বিনোদনের উদ্দেশ্যে বন্দিদের সঙ্গে রাজ পৃষ্ঠপোষতায় বীরের খেলা) থেকে এখনকার দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সব খেলাতেই সংগীত আবশ্যিক এক অনুষঙ্গ। বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটের মিউজিক অত্যন্ত জনপ্রিয়। সাঁতার, হাডুডু, নৌকাবাইচ তো বটেই, বাংলাদেশের লোকায়ত যত ক্রীড়া রয়েছে, প্রায় সবকটিই সংগীত ছাড়া অকল্পনীয়।
এমনকি জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গেও সংগীত সম্পর্কিত। মানবশিশুই কেবল নয়, পরিবারে পোষা প্রাণীর বাচ্চা প্রসবে সবাই যেমন আনন্দিত হয়, তেমনি তার মঙ্গলার্থে গান গাওয়ার চলও রয়েছে। বৃক্ষ বা শস্য জন্মানোর সঙ্গে আছে এর যোগ। কথাসাহিত্যিক শওকত আলী উত্তরবঙ্গে গ্রামীণ এক কৃষককে মাটিতে কান পেতে বীজ গজানোর ধ্বনি শুনতে দেখেছিলেন। কোনো কোনো আদিবাসী সমাজে শস্য উৎপাদনের সঙ্গে সংগীতের ভূমিকা দেখা যায়। সেটি হলো জুমচাষ। শান্তিনিকেতনে উদযাপিত হয় বৃক্ষরোপণ উৎসব। সংগীতই এই আয়োজনের প্রধান অনুঘটক। বেশ কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে একটা খবর বেরিয়েছিল, বিজ্ঞানীরা ভালো ফসল ফলানোর জন্য তারযন্ত্রের মাধ্যমে শস্যখেতে সংগীত পরিবেশন করে লাভবান হয়েছেন। শ্রীকৃষ্ণের বাঁশিতে তো রাখালিয়ার সুর। ওই সুরেলা ধ্বনি বনের পশু, পাখি এমনকি মানুষের মনের ওপরও তার রেশ রেখে যায়। সংগীতের প্রভাবে আগুন জ্বলে, বৃষ্টি নামে, ব্যক্তির চিত্তশুদ্ধি ঘটে, অসুস্থ স্নায়ুর ওপর ক্রিয়া করে সুস্থতা আনে। খরার সময় বৃষ্টির গান তো আমাদের লোকায়ত জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অনুষঙ্গ। সামগানে সাতটি স্বরের যে ব্যাখ্যা পাওয়া যায়, তার অর্থ হলো সুরের সাহায্যে বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন।
মৃত্যুতেও রয়েছে গান। আপনজনকে হারানোর বেদনা ভুলতেই কেবল নয়, মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তির মানসিক প্রশান্তির জন্যও সংগীত পরিবেশিত হয়। তা সব সময় ধর্মীয় শ্লোক বা আয়াত তেলাওয়াত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, বাজানো হয় নানা আনন্দদায়ক মিউজিক। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে যা কিছু কণ্ঠনিঃসৃত সেসব যদি সুখশ্রাব্য না হয়, তবে উপস্থিতদের সেটি প্রীতিকর কোনো সাড়া তৈরি করে না। তাই সব ধর্মের প্রার্থনা-মন্ত্র, শ্লোক, আয়াত সুরেলা ও শ্রুতিমধুর।
সৌন্দর্যবোধ ও অনুভূতির সঙ্গে সংগীতের যোগ রয়েছে। এর সঙ্গে জ্ঞান এবং কল্পনাও সম্পৃক্ত। ব্যক্তির সৃষ্টিশীলতা ও মনের সুকোমল বৃত্তিগুলোর বিকাশও সংগীতনির্ভর। সংগীতজ্ঞ হ্যানস্লিক ইউরোপীয় মিউজিক পর্যালোচনায় এ কথা বলেছেন। আনন্দের সূচনা ঘটে তখনই, যখন কল্পনাবৃত্তির সংযোগে সংগীত শ্রোতার মনে অনুভূতি ও সংবেদনা সৃষ্টি করে। কল্পনার মাধ্যমেই মিউজিকের উপাদান সাজিয়ে নিতে হয়। এর রূপ সূক্ষ্ম চিন্তা এবং অভিজ্ঞতার ফল, এগুলো ভাষারও বাহন। তা ছাড়া সংগীতও একপ্রকার ভাষা। মানুষের ভাষা আবিষ্কারের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। তুরস্কের একটি পাহাড়ি অঞ্চলের জনগোষ্ঠী মনের ভাব আদান-প্রদানের জন্য ব্যবহার করে সুরেলা কণ্ঠধ্বনি (শিস বাজিয়ে তারা কথা বলে)। যা মূলত সংগীত। সুখশ্রাব্যও বটে।
গানের মধ্যে একটা অগ্নি-শক্তিও কাজ করে। যেটি সমাজের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে যুগে যুগে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে। চারণ কবি মুকুন্দ দাস গ্রামে গ্রামে গান গেয়ে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে জনগণকে উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেকের গানে সেই অগ্নি-শক্তির রূপ দেখা গেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও সংগীত পাকিস্তানি স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
সামাজিক উৎসবে সংগীত অপরিহার্য। বিয়ে, নবান্ন, পয়লা বৈশাখ, এমনকি কৃষিজ সমাজের ভিন্ন ভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন বিনোদনের মাধ্যম, তেমনি মানুষকে জীবনের শোক, দুঃখ, বেদনা ও বিষাদ থেকে কর্মমুখরতায় অনুপ্রাণিত করে তুলতে এর ভূমিকা রয়েছে। আবার অনুভূতি পরিমার্জিত করতেও পারে সংগীত। কুটিলতা, হিংসা, বিদ্বেষ, পরশ্রীকাতরতার মতো মন্দ আবেগগুলো মিউজিকের প্রভাবে দূর হয়। মানুষ হয়ে ওঠে উদার ও মানবিক। অনেকেই ডাকাতি, লুণ্ঠনসহ অন্যান্য সামাজিক অপরাধ থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে এবং সংগীত হয়েছে তাদের আশ্রয়। যেমন হাসন রাজা। যৌবনে তিনি ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। নারী সম্ভোগলিপ্সু। পরবর্তীকালে তিনি মরমি সংগীত সাধনায় বাংলা গানের জগৎ সমৃদ্ধ করেন।
তা ছাড়া মানুষ তার অন্তর্জগতের সন্ধান পাওয়ার জন্যও সংগীতের দ্বারস্থ হয়। অধ্যাত্ম সাধনার সঙ্গে সুরের গভীর একটা যোগ রয়েছে। ভাবের প্রকাশ ঘটে সুরের ভেতর দিয়ে। কথা সেখানে প্রধান নয়। রবীন্দ্রনাথ ‘জীবনস্মৃতি’তে বলেছেন, ‘গান নিজের ঐশ্বর্যেই বড়ো, বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে। বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেইখানেই গানের আরম্ভ। যেখানে অনির্বচনীয় সেখানেই গানের প্রভাব। বাক্য যাহা বলিতে পারে না, গান তাহাই বলে।’ কাজেই সুরই মানুষের জীবনে প্রভাব বিস্তার করে।
গানমাত্রই তাৎক্ষণিক, কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা চিরস্থায়ী অনুভবের ছাপ রেখে যায় মনে। কোনো ক্ষুদ্র সীমার মধ্যে আবদ্ধ নয় এই শিল্পকলা। সব সীমাবদ্ধতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেওয়ার ক্ষমতা সংগীতের আছে। শিল্পের অনেক মাধ্যমই রয়েছে, যেগুলো সমাজের সব শ্রেণির মানুষ উপভোগ করতে পারে না। যেমন মিকেল অ্যাঞ্জেলোর ভাস্কর্য বা ফ্রেস্কো, অথবা মোনালিসা, কিংবা তাজমহল চাইলেই যে কেউ সরাসরি দেখে উপভোগ করতে পারবে না। তার জন্য প্রয়োজন অর্থবিত্ত। কিন্তু সংগীতের সেই সীমারেখা নেই। বিশেষত দ্রুত বিকাশের ফলে বিনোদন-প্রযুক্তি সহজলভ্য হওয়ায় পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকেই কাক্সিক্ষত সংগীত উপভোগ করা সম্ভব।
মডেল: সায়রা
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: মাহিনুজ্জামান পিয়ান ও ইন্টারনেট