এডিটরস কলাম I জেগে ওঠার গান
শোক, শূন্যতা, আনন্দ, প্রশান্তি, পূর্ণতা, আকাক্সক্ষা- জীবনের সব অনুভব সংগীতে এসে ঐশ্বর্যময় হয়ে ওঠে
প্রাত্যহিক জীবনে সংগীতের প্রভাব নানাভাবেই প্রচ্ছন্ন এবং স্পষ্ট। তা ব্যক্তিক হোক কিংবা সামষ্টিক। ব্যক্তিমানুষের জীবনধারায় কখনো কখনো তা উচ্চকিত হয়ে ওঠে। কখনো অনুভূতির গভীরে সংশ্লেষিত হয়ে থাকে। তেমনি সামষ্টিক যাপনেও এর বিশেষ এক স্থান রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই সংগীতকে ধর্মের স্থান দেওয়া হয়েছে। প্রাচ্যে, বিশেষত ভারতবর্ষে একটা কথা বেশ প্রচলিত বহুদিন ধরেই। তা এই, ভারতীয়দের ধর্ম দুটো- একটি হলো ক্রিকেট, অন্যটি সংগীত। উল্লেখ বাহুল্য নয়, ক্রিকেটীয় সংস্কৃতির মধ্যেও ঢুকে পড়েছে সংগীত। আপনারা নিশ্চয় গ্যালারি থেকে চিয়ারলিডারদের দেখেছেন। অন্যদিকে যেকোনো অনুষ্ঠানে সংগীতের স্থান অনেকটা উপাসনার স্তরে পৌঁছেছে বেশ আগে থেকেই। এসব আয়োজনে প্রাণসঞ্চারের এ এক মোক্ষম উপাদান।
২
শোক, শূন্যতা, আনন্দ, প্রশান্তি, পূর্ণতা, আকাক্সক্ষা- জীবনের সব অনুভব সংগীতে এসে ঐশ্বর্যময় হয়ে ওঠে। এমনকি দুর্যোগের দিন, কিংবা অস্তিত্ব বিপন্ন হলে গান থেকে শক্তি সংগ্রহের দৃষ্টান্তও কম নয়। এটি তাই যুগে যুগে বিপর্যস্ত, নিপীড়িত ও নিঃস্ব মানুষের জেগে উঠবার প্রণোদনা হিসেবে কাজ করে। পিট সিগার, বব মার্লে, ভূপেন হাজারিকা, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস প্রতুল মুখোপাধ্যায়, কবীর সুমন- এদের গানে নিপীড়িত মানবচিত্তের জাগরণ ঘটেছে।
আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে সাহস জুগিয়েছে সেসময়ে বেতারে প্রচারিত উদ্দীপনামূলক গানগুলো। রবীন্দ্র-নজরুল-ডিএল রায়- এদের রচিত সংগীত তো ছিলই। নতুন নতুন কথা ও সুর সৃষ্টি হয়েছে তখন। গণমানুষের প্রেরণা হিসেবে নতুন শিল্পীর আবির্ভাবও ঘটেছে। আমাদের মনে আজও জেগে ওঠে সেই ছবি- যেখানে রেডিও সেট ঘিরে দেশপ্রেমিক সাধারণ মানুষ এবং রণপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে মুক্তিযোদ্ধারা গান শুনছেন, যা স্বাধীনতার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করতে উদ্দীপনা ও সাহস জুগিয়েছে। তখন তো এটাই ছিল আমাদের প্রধান বিনোদন। শুধু কি তাই! বিনোদনের মাত্রা ছাড়িয়ে পরিণত হয়েছিল আত্মিক চাহিদা পূরণের অনিবার্য উপাদানে। গানের শক্তি এত গভীর ও বিপুল হতে পারে, এটা সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধ না এলে আমাদের জীবনে উপলব্ধি করা যেত না।
‘মুক্তির গান’ প্রামাণ্যচিত্রটির কথা এ প্রসঙ্গে প্রায় সবারই মনে পড়বে। একদল স্বাধীনতাকামী শিল্পীযোদ্ধা কথায়-সুরে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন দেশপ্রেমে। নিরাশ্রয়দের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন। দেশের গান, গণসংগীত, লোকগান নিয়ে তারা গিয়েছিলেন বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে, সীমান্তবর্তী অঞ্চলে, শরণার্থীশিবিরে। সেসব গান মানুষকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল দেশমাতৃকার মুক্তির আকাক্সক্ষায়। ভরসাও দিয়েছিল।
৩
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পৃথিবীব্যাপী জনমত গড়ে তোলার জন্য সংগীত প্রধান একটি ভূমিকা পালন করে। রবিশঙ্করের উদ্যোগে জর্জ হ্যারিসন, পল ম্যাকার্টনি, জন লেনন, জোয়ান বায়েস প্রমুখের অংশগ্রহণে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। এই অনুষ্ঠান থেকে সংগৃহীত অর্থ দেওয়া হয় মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা এবং পাকিস্তানি সামরিকজান্তা পরিচালিত গণহত্যার বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে তারা পৌঁছে দেন গানের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন, সহমর্মিতা ও গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতা মুখরিত হয়ে ওঠেন।
সম্রাট আকবরের সভাশিল্পী তানসেন সুরে সুরে বৃষ্টি নামিয়েছেন বলে কথিত আছে। এ-ও আমরা জানি, সংগীত অসুস্থ ব্যক্তিকে উপশম দিতে পারে। এবার যদি বলা হয়, গান দিয়ে মানবতাকেও রক্ষা করা যায়, তবে কি অত্যুক্তি হবে? সংগীতের ইতিহাসে সেই উত্তর আছে।
৪
ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ- বাঙালি জাতির সব অস্তিত্বসংগ্রামে সংগীত অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে পাকিস্তান সরকারের নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে সংগঠিত ছায়ানটের প্রেরণাই ছিল গান। তখন পয়লা বৈশাখ উদযাপনের প্রস্তুতির মূলেও ছিল সংগীত। এমনকি পরবর্তীকালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামেও গান জনচেতনা সৃষ্টি করেছে। পুরোনো গান গাওয়ার পাশাপাশি রচিত হয়েছে নতুন সংগীত। এসবের কথা ও সুর দশকে দশকে এ দেশের মানুষের চেতনায় জাগিয়েছে উদ্দীপনা। দুঃশাসন থেকে মুক্তির এক অনন্য শক্তি সেই গানগুলো।
৫
বিজয়ের প্রায় অর্ধশতাব্দী পর এখন কেউ যদি সেসব গানের মূল শিল্পীর কণ্ঠস্বর শুনতে চান, দেখা যাবে অধিকাংশেরই হদিস মিলছে না। অর্থাৎ এটা প্রমাণিত এবং দুঃখজনক যে, আমরা নিজেদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসটুকু যথাযথ সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছি। তখন যেহেতু ভালো রেকর্ডিংয়ের প্রযুক্তিগত সুবিধা অপ্রতুল ছিল এবং জনসচেতনতাও গড়ে ওঠেনি, ফলে সেসব হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিছু টিকে থাকলেও সেগুলোর সুরে খানিকটা পরিবর্তন ঘটেছে। সম্ভবত শিল্পীর গায়কির কারণে এবং যন্ত্রানুষঙ্গের বাড়তি প্রয়োগে এমনটি হয়েছে। তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু আমাদের গর্বের সংগীতগুলো, বিশেষত গণজাগরণের ক্ষেত্রে যেগুলোর ভূমিকা অনস্বীকার্য, সেসবের সংরক্ষণ জরুরি। আশার কথা হলো, ইতিমধ্যেই মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের অনেক কিছু স্থান পেয়েছে। বাহান্ন থেকে একাত্তর পর্যন্ত উদ্দীপনামূলক বাংলা গানগুলোর সঙ্গে যারা ছিলেন, তাদের যাবতীয় তথ্যসহ সংরক্ষণে এই প্রতিষ্ঠান যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। সে আশাই করছি।