skip to Main Content

রসনাবিলাস I গানের ক্যাফে

বিটলসের নাম জেগে ওঠে এখানকার কফির আড্ডায়। তবে এতেই শেষ নয়। আরও বিচিত্র পদের আয়োজন রয়েছে। সঙ্গে সেই রেট্রো মিউজিক

সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ইউরোপে যুদ্ধরত সৈন্যরা রেশন হিসেবে বরাদ্দ পাচ্ছিল তাদের প্রিয় খাবার আর পানীয়। কপাল ভালোই বলতে হবে ইতালিতে অবস্থান করা সৈন্যদের। ইতালীয়রা যতটা ভালোবাসে পিৎজা, পাস্তা আর ওয়াইন, ততটাই কফি। যদিও মার্কিন সেনাদের ইতালীয় কফিতে রুচি ছিল না। কারণ, সেটা ছিল ডার্ক অ্যান্ড রিচ।
আমেরিকানরা ড্রিপ ব্রিউ করা কফিতে অভ্যস্ত ছিল। তাতে হালকা স্বাদ পেতে যোগ করত দুধ। অন্যদিকে ইতালীয়রা এসপ্রেসোর বাইরে পান করত ক্যাপাচিনো। এটা ছিল হালকা স্বাদ ও ঘনত্বে আমেরিকানদের কফির কাছাকাছি। তবে পরিমাণে অনেকটাই কম। পাঁচ আউন্স এসপ্রেসো দিয়ে ফ্রোদি দুধ, যেখানে রেগুলার ড্রিপ কফি হতো ১৬ আউন্সের।
মার্কিন সৈন্যদের সুবিধার্থে ইতালীয় কফিশপগুলো পুরো কাপ ভর্তি করে বেচতে শুরু করে। এসপ্রেসো শটের সঙ্গে বাকিটা গরম পানি দিয়ে। এতে কেউ যোগ করে নিতে পারত দুধ আর চিনি। এই পানীয়র কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ইতালীয়রা তাদের প্রিয় এসপ্রেসোর এই দশা দেখে তাচ্ছিল্য করে বলে ঘোলা পানি। আর আমেরিকানদের প্রিয় ছিল বলে এর পোশাকি নাম হয়ে যায় আমেরিকানো।
এমনই এক কাপ আমেরিকানো হাতে বসে ছিলাম ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বিখ্যাত এক ক্যাফেতে। নাম বিটলস ক্যাফে। বসুন্ধরা এলাকাসহ ঢাকাবাসীকে পাঁচ বছর ধরে ভিন্ন ঘরানার খাবারের স্বাদ দেওয়া এল ডোরাডোর কফি ভেঞ্চার। মূল সড়ক ধরে এগোলেই বাজারের ঠিক উল্টো দিকে গোটাকতক দোকানপাট, তার আড়ালেই এল ডোরাডো আর বিটলস ক্যাফের অবস্থান। গলি ধরে তাকালেই বেশ ইউরোপিয়ান ঘরানার শেড আর বিটলস ক্যাফের সাইন। সঙ্গে ভিক্টোরিয়ান আদলের ল্যাম্প আমন্ত্রণ জানায়। পুরো উডেন এক্সটেরিয়রে কাচের আড়াল দিয়ে ভেতরটা সবটুকু দৃশ্যমান। কাউন্টারে হ্যাঙ্গিং লাইট। কফি হাতে সময় কাটানোর জন্য পাশের ছোট্ট শেলফে এবং দেয়ালের সঙ্গেও রয়েছে বই। ভেতরে ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের ল্যাম্পস্ট্যান্ড, ঝাড়বাতি। কাঠের পুরো ইন্টেরিয়রে সংগত দেওয়ার জন্য রয়েছে বেতের চেয়ার, উডেন টেবিল। নরম হলুদ আলোয় বেশ মায়াময় পরিবেশ।
কী কফি খেতে চাই জানতে চাইলেই বললাম ডাবল শট এসপ্রেসো দিয়ে একটা আমেরিকানো! অর্থাৎ মোট ৬০ মিলি এসপ্রেসোর সঙ্গে বাকিটা গরম পানি। উষ্ণ জল আগে ঢেলে তার উপরে কফি দেওয়ার নিয়ম। এতে করে এসপ্রেসোর উপরের ক্রিমি লেয়ারটা অক্ষুণœ থাকে, যাকে বলা হয় ক্রেমা। কাউন্টারে কফি বানানোর প্রক্রিয়া দেখতে দেখতেই জানলাম, এখানকার কফি বিন আসে নর্থ এন্ড থেকে। কফির তালিকায় রয়েছে এসপ্রেসো, মাকিয়াতো, আমেরিকানো, ক্যাপাচিনো আর লাতে।
পেয়ালা হাতেই এল ডোরাডো দেখে নেওয়া হলো। দুপুরের খাবারের প্রস্তুতি চলছে শেষ প্রান্তে- লাইভ কিচেনে। হলুদ হ্যাঙ্গিং লাইটের সঙ্গে সাদা স্পট লাইটের মিশ্রণ, অন্ধকারাচ্ছন্ন ফলস সিলিংয়ের বৈপরীত্য বেশ আরামদায়ক অনুভূতি দেয় চোখে। প্রায় ৭০ জনের বসার ব্যবস্থা সেখানে। ক্যাফেতে ১২ জনের মতো। ক্যাফেতে বসেই দুপুরের খাবারের মেনু দেখতে লাগলাম। কফি ছাড়া আর সব খাবারই এল ডোরাডোর। ২০১৫ সালে রেস্তোরাঁটি শুরু হয়েছিল মেক্সিকান খাবার দিয়ে, এখন মেনুতে কন্টিনেন্টাল খাদ্য যোগ হয়েছে। আর আগের তুলনায় খাবারের দামও বেড়েছে। মেনুতে নজর দিলাম খানিকটা সময়ের জন্য। সাব স্যান্ডউইচ রয়েছে পাঁচ পদের। সঙ্গে মাশরুম, চিজ, বিফ বা টার্কি বেকন, সালামি, পেপেরনি, পাইনঅ্যাপল, হ্যালাপিনো, পিকেল, সস বা গার্কিন অ্যাড অন করে কাস্টমাইজ সাব বানিয়ে নেওয়ার সুবিধা তো রয়েছেই। আঠারো পদের র‌্যাপ আছে চিকেন, বিফ আর ভেজ মিলিয়ে। পুরোনো এল ডোরাডোর স্বাদ মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য সাব স্যান্ডউইচের পাশাপাশি রয়েছে বারবিকিউ চিকেন উইংস, নাচোস, ট্যাকো। সঙ্গে সম্ভবত নতুন এল ডোরাডোর চাট পটেটো! বার্গার সপ্তপদী। গার্লিক মেয়ো চিজ, নাগা, স্টেক এন চিজ, বারবিকিউ, ডোরি ফিশ অ্যান্ড শ্রিম্প, টেরিয়াকি, হাওয়াইন। যথারীতি অ্যাড অন অপশন রয়েছে এখানেও। ফুল লাঞ্চ আর ডিনার মেনুতে রয়েছে বারবিকিউ চিকেন উইথ রাইস, বারবিকিউ চিকেন ড্রামস্টিক, সিল্যান্ট্রো চিকেন, গার্লিক প্রন, ইতালিয়ান স্যালাড বোল, বোল আমেরিকানো, গ্রিলড সাওয়ার ফিশ, গ্রিলড অ্যান্ড রোলড বারামুন্ডি, লেমন বাটার ফিশ, সয়া হানি চিকেন, ভ্যালেন্সিয়া চিকেন, মরোক্কান চিকেন, বিফ রিবস, কালামারি রিং, সল্ট এন পেপার স্কুইড, বারবিকিউ সাওয়ার ফিশ, গ্রিলড রেড স্ন্যাপার, ফ্লোরেন্টা স্টাফড চিকেন রোল, চিজি ফ্লোরেন্টো চিকেন রোল, অরেঞ্জ চিকেন ব্রেস্ট, আলফ্রেডো পাস্তা, সারলোয়িন মিনি স্টেক, ক্রাস্টেড সারলোয়িন বিফ স্টেক, মারিনারা স্প্যাগেটি আর সি ফুড মারিনারা স্প্যাগেটি। সঙ্গে চা, কফি, জুসসহ বিভিন্ন মকটেইল তো রয়েছেই।
এত খাবারের মধ্যে দ্বিধান্বিত অবস্থা থেকে বাঁচালেন রেস্টুরেন্টের কর্ণধার আজিজুর রহমান রুবেল। উপস্থিত না থাকতে পারলেও ফোনে সমাধা করলেন এই সমস্যার। অর্ডার করা হলো সিল্যান্ট্রো চিকেন আর লেমন বাটার ফিশ। সঙ্গে সিম্পল পানি। খাবার চলে এলো কিছু সময়ের মধ্যেই। প্রথমেই মাছের স্বাদ নেওয়া হলো। ডোরি মাছের ফিলে সঙ্গে সবুজ রঙা হার্ব রাইস। আর ক্যাপসিকাম-টমেটোর গ্রিন স্যালাড। ডোরি মাছের ফিলে হালকা ভাজা, তবে সঙ্গের স্পেশাল লেমন বাটার সসে স্বাদ খোলতাই হলো অনেকখানি। একটু টক, সামান্য বাটারের স্বাদ- হার্ব রাইসের সঙ্গে মন্দ নয়। স্যালাডটাও বেশ আলাদা, টক-মিষ্টি স্বাদের।
এরপর পালা সিল্যান্ট্রো চিকেন চেখে দেখার। মেনুতে বর্ণনা দেওয়া মেরিনেটেড চিকেন ব্রেস্ট উইথ হার্ব রাইস, সটেড ভেজিটেবল। বিবরণ পড়ে বোঝার উপায় নেই আসল খাবারটা কী! চিজে ভরপুর এই চিকেনে চিজের বর্ণনাই যে নেই! বরং সিল্যান্ট্রো চিকেন না হয়ে এর নাম চিজি চিকেন হলেও আপত্তির কিছু ছিল না।
খাওয়া শেষে আরেক কাপ আমেরিকানো হাতে নিয়ে একটু আয়েশ করে বসতেই সাউন্ড সিস্টেমে ভেসে এলো বিটলসের গান,
‘বাট লিসেন টু দ্য কালার অব ইয়োর ড্রিমস
ইট ইজ নট লিভিং
ইট ইজ নট লিভিং
অর প্লে দ্য গেম ‘একজিসটেন্স’ টু দ্য এন্ড
অব দ্য বিগিনিং
অব দ্য বিগিনিং…’
হুট করে মাথায় নাড়া দিয়ে গেল বিটলসের সঙ্গে কফির যোগসূত্র আজন্মের! লিভারপুলের কাসবাহ কফি ক্লাব থেকেই যে তাদের শুরু!

 আল মারুফ রাসেল
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top