skip to Main Content

ফিচার I তরুমর্মে

শহুরেদের মধ্যে সবুজের বিস্তারে কাজ করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। দিচ্ছে গার্ডেনিং সেবা। ফলে, প্রয়োজনীয় উপাদানসহ বাগান পরিচর্যার কৌশলও মেলে

‘এই জায়গায় আগে বন-বাদাড় ছিল’, বয়োজ্যেষ্ঠ কারও সঙ্গে শহর পরিভ্রমণে বেরোলে কথাটি শুনতে হয়। তথাকথিত নগরায়ণের উৎপাতে বুড়িগঙ্গার তীরটি এখন নিছক কংক্রিটের জঙ্গল। সেখানে জৈব সবুজ নেই। যদিও বৃক্ষায়ণের প্রয়োজন আছে খুব। এই উপলব্ধি অনেকের মধ্যেই নেই। যাদের আছে, তারা আবার ভূমি কিংবা উপকরণের অভাবে গাছ বুনতে পারেন না।

ভূমির অভাব না হয় ছাদ, বারান্দা কিংবা ঘরের অভ্যন্তর দিয়ে কিছুটা পুষিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু উপযুক্ত বীজ, সার, মাটি কই? ব্যস্ত শহরে যেখানে ঘড়ির কাঁটায় মুখ গুঁজে চলতে হয়, সেখানে বাগানের পেছনে সময় দেওয়ারই-বা ফুরসত কোথায়! এই শূন্যতা পূরণেই দেশে গড়ে উঠেছে কিছু বৃক্ষদরদি সংস্থা। রোপণে আগ্রহীদের কাছে গাছ পৌঁছে দেওয়া এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বয়ে বেড়ানোই তাদের ব্রত। সে জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই গড়ে উঠেছে অনেকগুলো সংস্থা। অল্প পরিসরে সব কটির ঠিকানা ও কর্মফিরিস্তি দেওয়া কঠিন। তবে কয়েকটির কথা বলা যেতেই পারে। যেমন গ্রিন সেভার্স, ট্রিইজম ফাউন্ডেশন ও নগরকৃষি।
২০১০ সালে গ্রিন সেভার্স যখন তাদের কার্যক্রম চালু করে, তখন বাগান করায় মানুষকে উৎসাহ জোগানো খুব সহজ ছিল না। গাছের উৎস ছিল শহরে বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকা কিছু নার্সারি। বাগান করার প্রতি মানুষের অনীহার মূল খুঁজতে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। হদিস পেয়ে সেই অনাগ্রহ দূর করতে তৎপর হয়। স্বেচ্ছাসেবীরা লক্ষ করেন, শহুরে মানুষের কাছে সময়, বীজ, সার ও মাটির অপ্রাপ্যতা ছাড়াও আরও কিছু সুবিধা অপ্রতুল। বিশেষ করে প্রশিক্ষিত বাগান চর্চাকারীর অভাব রয়েছে শহরে। গার্ডেনিংয়ের টেকনিক্যাল টার্মগুলো শিখে নেওয়ার মতোও সুযোগ হাতের কাছে নেই। প্রতিষ্ঠানটি বুঝতে পারে টেকনিক্যাল ও প্রফেশনাল সাপোর্ট দিতে পারলে শহুরেরা বাগান করতে আগ্রহী হবে। তাই নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে প্রচারণা শুরু করে গ্রিন সেভার্স। লিফলেট বিতরণ থেকে শুরু করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি- এসবেও খুব সাড়া মেলেনি। তাই পরিকল্পনা বদলে স্কুলভিত্তিক কাজ শুরু করে সংস্থাটি। শিশুদেরকে সবুজমনস্ক করে তোলার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সেখানেও দেখা গেল বিপত্তি। শিশুরা গাছগুলোর প্রতি যত্নশীল হচ্ছে না। তাই গ্রিন সেভার্স শুরু করে মোটিভেশনাল অ্যাকটিভিটিজ। শিশুদের হাতে গাছ তুলে না দিয়ে প্রথমে ওদেরকে ওয়ার্কশপ করানো হয়। বোঝানো হয় গাছের প্রয়োজনীয়তা। কথাগুলো মুঠোফোনে বলছিলেন গ্রিন সেভার্সের প্রতিষ্ঠাতা আহসান রনি। নিজের প্রতিষ্ঠানের অগ্রযাত্রার বয়ানে বললেন, ‘শিশুদের বললাম, প্রকৃতি থেকে আমরা প্রতিদিন যে অক্সিজেন নিই, এটার একটা দাম আমরা প্রতি মাসে দেব। প্রতি মাসে ১ টাকা করে গাছের জন্য কন্ট্রিবিউট করব। তো এটা শিশুরা গ্রহণ করল। ভাবল যে হাসপাতালে ভর্তি হলে অক্সিজেনের জন্য অনেক টাকা দিতে হয়; আমরা প্রকৃতি থেকে অক্সিজেন নিচ্ছি, তাই দাম হিসেবে ১ টাকা করে বক্সে জমাব। প্রথমে ঢাকার ১০টি স্কুলে আমরা এই কার্যক্রম শুরু করি। তারপর ১০০টি স্কুলে। আমরা শিশুদের মধ্যে একটা ট্রি গার্ডেনিংশিপ দিলাম। যে গাছটি সে রোপণ করেছে, সেই গাছটির অভিভাবক ও নিজেই। এতে শিশুদের মধ্যে গাছের প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো। নিজের গাছের বিষয়টি ওর অভিভাবকদের সঙ্গে শেয়ার করল। ফলে বাবা-মায়ের কাছ থেকে আমাদের কাছে ফোন আসা শুরু হলো। তারাও বাড়িতে গাছ রোপণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন। এরপর আমরা রুফটপ গার্ডেনে মনোযোগী হই। এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ছাদবাগান করেছি। বারান্দা ও বেলকনি বাগানসহ।’
আরও জানা গেল, ‘আপনার খরচে আমাদের গরজে’ নিয়মে এগোতে থাকে গ্রিন সেভার্স। যারা ছাদবাগান করেছে, তাদেরকে মালি সার্ভিস দেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। শহরে বর্তমানে যারা এই পেশায় আছেন, তাদের পেশাদারি কোনো অভিজ্ঞতা নেই। ফলে অ্যাডভান্স অ্যাগ্রিকালচারে যে ডেভেলপমেন্টগুলো হচ্ছে, সেটা সম্পর্কে মালিরা অজ্ঞ থেকে যাচ্ছেন। গ্রিন সেভার্স তাই কিছু মালিকে প্রশিক্ষিত করে তোলে। শিক্ষিত তরুণ, যারা কৃষিতে ডিপ্লোমা করেছে, তাদেরকে মালি-পেশায় আনা শুরু করে সংস্থাটি। কিন্তু সমাজের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ভালো পারিশ্রমিক দিয়েও শিক্ষিত তরুণদের এই পেশায় আনা যাচ্ছিল না। তখন পেশাটির নামটা বদলে ‘গাছের ডাক্তার’ করে দেয় গ্রিন সেভার্স কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ বৃক্ষ ক্লিনিক সেবা চালু করে। আরবান গার্ডেনিংয়ে সাসটেইনেবল মডেল নির্মাণে ২০১৭ সাল থেকে ‘হাইড্রোপনিক’ চালু করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এটিকে জনপ্রিয় করাই গ্রিন সেভার্সের আগামী দিনের পরিকল্পনা।
বৃক্ষকেন্দ্রিক আরেকটি সংস্থা হলো ট্রিইজম ফাউন্ডেশন। ২০১৬ সালে ‘ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান ট্রি’ স্লোগান নিয়ে যাত্রা শুরু করে সংস্থাটি। প্রতিষ্ঠানের ফাউন্ডার সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘পরিণত একজন মানুষকে সবুজায়নে আকৃষ্ট করা খুবই কঠিন। তাই শিশুদের নিয়ে কাজ করি। আমরা এখন পর্যন্ত ১৫ হাজার শিশুর কাছে গাছ নিয়ে পৌঁছেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘গাছও পোষ্য হতে পারে- এই সেন্সে বাচ্চাদের হাতে গাছ তুলে দিয়েছি। বলেছি- তোমরা এটিকে নিজের হাতে পরিচর্যা করবে। এর একটি আলাদা নাম দেবে। এতে বাচ্চার সঙ্গে সঙ্গে গাছটিও বড় হয়। সবুজের সঙ্গেই শিশুরা বেড়ে ওঠে। আমরা সারা দেশের ৫০টি স্কুলে গেছি আমাদের কার্যক্রম নিয়ে। আমাদের ৩০০ স্বেচ্ছাসেবী আছে।’
তার সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেল, গ্রামের শিশুদের ফলের গাছ দেন তারা। পাশাপাশি অভিভাবকের কাছে চিঠি মারফত অনুরোধ করেন গাছ ও শিশুটির এই বন্ধনকে দেখভাল করতে। প্রতিষ্ঠানটি শহুরে শিশুদের জন্য এমন গাছ বরাদ্দ করে, যেগুলো বারান্দায় কিংবা পড়ার টেবিলের কোণেই রাখা যায়। কোনো এলাকায় যখন বৃক্ষায়ণ অভিযান হয়, তখন ট্রিইজম ফাউন্ডেশন খেয়াল রাখে সেই অঞ্চলে গত ১০ বছরে কোন কোন গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। স্কুলশিক্ষার্থীদের মাধ্যমে সেই গাছগুলোই সেখানে বপন করে সংস্থাটি।
‘নগরকৃষি’র কার্যক্রম নিয়ে কথা হয় প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা সিইও কামরুল হাসানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘২০১৬ সালে আমরা নগরকৃষি তৈরি করি। শুরুর আগে অনেক রিসার্চ করেছি। যাদের সময় নেই, তাদের কাছে আমাদের লোক গিয়ে বাগান করে দেয়। যারা নিজের উদ্যোগেই বাগান করে, তাদেরকে ভালো বীজ, সার ও মাটির হদিস দিই আমরা। হোম ডেলিভারির মাধ্যমে এগুলো আগ্রহীদের কাছে পৌঁছাই। গাছের ধরন অনুযায়ী আলাদাভাবে তিন ধরনের মাটি তৈরি করেছি। গার্ডেনিং সার্ভিসের পাশাপাশি মালির জোগানও দিয়ে থাকি। সাপ্তাহিক কিংবা মাসিক, যে যেভাবে সার্ভিস নিতে আগ্রহী, সেভাবেই দিচ্ছি। গাছের রোগবালাই নাশেও সমাধান দিই।’
জানা গেল, সবজি চাষের প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে প্রতিষ্ঠানটি। ঢাকার বাইরেও কিছু প্রজেক্ট আছে সংস্থাটির। তা ছাড়া বাগানের মধ্যে সোলার লাইট ব্যবস্থা এবং গ্রিন হাউস প্রযুক্তি নিয়েও কাজ করছে। পাশাপাশি রেস্তোরাঁগুলোতে ‘হাই ভ্যালু ক্রপ’ ফলানোর টেকনোলজি নিয়ে কাজ করছে নগরকৃষি।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top