আলাপন I গাছ রক্ষা মানে নিজেকে বাঁচানো– বিপ্রদাশ বড়ুয়া
তরুলতা ও পাখির সঙ্গে তার বন্ধন গড়ে ওঠে শৈশবে। একটা জীবন অরণ্যশোভা গাছ, ফুল, পাখির সঙ্গে কাটিয়ে দিয়েছেন, দিচ্ছেন। তিনি বিপ্রদাশ বড়ুয়া। প্রকৃতিবিদ, কথাসাহিত্যিক, শিশুসাহিত্যিক- সব পরিচয়ে সমান প্রসিদ্ধি। স্বীকৃতিও পেয়েছেন। যেমন- একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, আন্তর্জাতিক যুববর্ষ পদক ও অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক ইত্যাদি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাবিবুল্লাহ ফাহাদ
ক্যানভাস: প্রকৃতির সঙ্গে আপনার সম্পর্ক গড়ে ওঠে কখন? কীভাবে শুরু হলো?
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: এটা আমার ছেলেবেলা থেকেই। বড় হয়েছি গ্রামে। আমার বাড়িতে বিশাল ভিটা। সেখানে হেন জিনিস নেই যে ছিল না। গাছপালা ছিল। শিয়াল থাকত। পুকুর ছিল। ছনের বাগান ছিল। গাছপালা আর ফলমূলে ভরা। গ্রামে দুটি পুকুর আর ছোট ডোবা ছিল। এই যে প্রকৃতি, সেটা আমাকে ছেলেবেলা থেকেই প্রভাবিত করেছে। ওই সময়ে আমি প্রকৃতির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ি।
ক্যানভাস: আপনার জন্ম ইছামতীর তীরে। কেমন ছিল সেই নদী?
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: বাড়ির পাশে কর্ণফুলী ও ইছামতী। নদীভাঙনে আমাদের আড়াই একরের ভিটার অর্ধেক বিলীন হয়েছে। আমার ছোটবেলায় অবশ্য ভিটায় নদীভাঙন শুরু হয়নি। একটা-দুটো বাড়ির পাশ পর্যন্ত নদী চলে এসেছিল। প্রাইমারি স্কুল থেকে উচ্চবিদ্যালয়ে যাচ্ছি, তখন বাড়ির আশপাশের প্রকৃতি এবং কর্ণফুলী ও ইছামতীর জালে আটকা পড়েছি।
ক্যানভাস: শৈশবের দিনগুলো কেমন ছিল?
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: গ্রাম ভালো লাগত। ভালো লাগত নদীর চরে ফুটবল খেলতে। বাতাবি লেবুকে ফুটবল বানিয়ে খেলতাম। ওই সময়ে বড় হতে থাকলেও প্রকৃতি আমাকে এত আটকে ফেলল, সেখান থেকে বের হতে পারলাম না। কলেজে যাওয়ার পর থেকেই লেখালেখির সূচনা। তখন সবকিছু লেখার মধ্যে বেঁধে ফেললাম।
ক্যানভাস: গ্রাম থেকে শহর কত দূরে ছিল?
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: দূরে নয়। বাসে এক ঘণ্টার পথ। গ্রামের পাশেই গুমাই বিল। ওই বিলে আমরা বর্ষাকালে নৌকা বেয়ে যেতাম। জেলেদের থেকে নৌকা ভাড়া করে নিতাম। গুমাই বিল এখনো আছে। প্রচুর ধান হয় সেখানে। আমি রাঙামাটি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে এক বছর পড়াশোনা করেছি। সেখানে কাটানো সময়টা আমার জীবনকে নতুন বাঁক দিয়েছে। সেটা ছিল জীবনের স্বর্ণসময়।
ক্যানভাস: রাঙামাটির গল্পটা যদি বলতেন…
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: খুব আনন্দের ছিল রাঙামাটির দিনগুলো। সেখানকার প্রকৃতিতে আমি আটকে গেলাম। আমার সহপাঠী তখন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা। পরে যিনি নামকরা আদিবাসী নেতা ও রাজনীতিক হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। ওই সময়ে আকাশে একটা ধূমকেতু উঠেছিল। নাম দেওয়া হয়েছিল ইয়াকাসেকি। ওই ধূমকেতু আমাকে বেশ নাড়া দিল। তখন তারা-নক্ষত্র সম্পর্কে পড়তে শুরু করলাম। এরও কয়েক বছর পরে আবদুল জব্বারের লেখা ‘তারা পরিচিতি’ বইটা পেলাম। বাংলা একাডেমি থেকে বেরিয়েছিল। অসাধারণ একটি বই। সেটি পড়ে নিজে নিজেই আকাশ দেখতাম। সেসব আমার লেখায় উঠে এসেছে। নক্ষত্র নিয়ে একটি বইও লিখেছি।
ক্যানভাস: আপনার গল্প, উপন্যাস বা ছোটদের জন্য লেখাগুলোতেও প্রকৃতির উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো। শৈশবের অভিজ্ঞতাগুলো কি পরে লেখালেখিতে আশ্রয় খুঁজেছে?
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: হ্যাঁ, বলতে পারো। শৈশবে দেখা প্রকৃতি আমি ভুলতে পারি না। বাচ্চাদের জন্য যখন গল্প লিখি, তখন এসব টেনে আনি। সাঁতরে কর্ণফুলী নদীর ওপারে যেতে চাইতাম। একদিন নদী পাড়ি দেওয়ার জন্য সাঁতার শুরু করলাম। কিন্তু নদীতে নেমে দেখি, আর শেষ হয় না। আমার সঙ্গে যে ছিল, সে সাঁতরাচ্ছিল। সে ভালো সাঁতারু। সে ওপারে চলে গেছে। তার সঙ্গে আরও একজন ছিল। আমি আস্তে আস্তে সাঁতার কেটে যাচ্ছি। নদী পার হয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। ওপারে গিয়ে বালির ওপর শুয়ে পড়ি। আর ভাবি, আরে বাবা কর্ণফুলী নদী, আমি সাঁতরে পার হয়েছি! ফিরে যাওয়ার সময় ওরা সাঁতার কেটে চলে গেছে। আমি আর সাঁতার কেটে যাইনি। নৌকা দিয়ে নদী পার হয়েছি।
ক্যানভাস: আপনি নগরের নিসর্গ নিয়ে বিস্তর লিখেছেন, এখনো লিখছেন। এ বিষয়ে শুনতে চাই।
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: কার্জন হলে একটা মাদার গাছ আছে। নারকেল গাছের সমান উঁচু। আমার ভিটাতেও মাদার গাছ ছিল। মাদার গাছে ফুল ফোটে। কিন্তু সাদা মাদার ফুল কখনো দেখিনি। তখন কার্জন হলের ওখানে গিয়ে ফুলটা দেখে আসি। ঘরে এসে দেখি, আরে এটা তো সাদা মাদার। এই গাছ নিয়ে লিখেছি দৈনিক বাংলার প্রথম পৃষ্ঠায়, প্রথম কলামে।
ক্যানভাস: এখনকার ঢাকার নগর-প্রকৃতি নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: নগরের প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তার পাশে হাইকোর্টের সামনের দিয়ে এক সারি অশ্বত্থ গাছ ছিল। সেই সারিটি চলে গিয়েছিল আর্ট কলেজের ওপাশে। রমনা উদ্যানের চারদিকে বড় গাছ ছিল। এগুলো ব্রিটিশ আমলে প্রাউড লক করেছিলেন। ঢাকার কোথায় কী গাছ হবে, এসব পরিকল্পনা তিনি করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গাছগুলো তার সময়ের। মন্ত্রীদের বাসভবনের আশপাশে বড় বড় গাছ দেখা যায়। এগুলো সরকারি গাছ বলে এখনো কেউ কাটেনি। মিন্টো রোড, হেয়ার রোডে এখনো বহু পুরোনো পাদাউক গাছ দেখা যায়। গাছটি বার্মার। বহু বছরের পুরোনো অনেক গাছের শিকড় ফুটপাত, রাস্তা করার সময় কেটে ফেলা হয়েছে। এতে গাছগুলো ধীরে ধীরে জীবন হারিয়েছে। যে গাছ দুই শ বছর বাঁচতে পারত, সেগুলোর আয়ু অর্ধেক হয়ে গেছে।
ক্যানভাস: গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক শতবর্ষী গাছ চোখে পড়ে। গ্রামের মানুষের প্রকৃতিপ্রেম শহুরেদের চেয়ে বেশি বলে মনে হয়?
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: বাংলাদেশে বা কলকাতার কোথাও গেলে খুঁজি আমার বয়সী গাছ। দেখলে কাছে গিয়ে মনে মনে বলি, বন্ধু, তুমি আমার বয়সী। এটা হয়তো লোকে বলবে পাগলামি। কিন্তু গাছ দেখে বুঝতে পারি, ওই জায়গার লোকে গাছকে কতটা ভালোবাসে। কলকাতা শহরে রাস্তা বা ফুটপাতের পাশে যত বড় গাছ আছে, আমাদের এখানে নেই। ঢাকার বাইরে জেলা প্রশাসকদের বাসভবন বা কার্যালয়ের আশপাশে শতবর্ষী গাছের দেখা মেলে। এগুলো সরকারি বলে রক্ষা পাচ্ছে। তবে মাঝেমধ্যে কিছু কাটা হয়েছে। যখন দেখেছি, সেসব নিয়ে পত্রপত্রিকায় লিখেছি। গাছকাটা বন্ধ হয়েছে। একটা গাছ আমার লেখার কারণে বেঁচে গেলে খুব ভালো লাগে।
ক্যানভাস: ঢাকার প্রকৃতি দিন দিন যে শোভা হারাচ্ছে, এটি কি আপনাকে ব্যথিত করে?
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: আমি তো বলি, কেন যে এই সময়ে জন্ম নিলাম! ন্যূনতম সম্ভাবনা থাকলেও শতবর্ষ আগের দেশে ফিরে যেতে চাইতাম। যেখানে গাছের প্রতি মানুষের ভালোবাসা ছিল। প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও মায়া ছিল। ভারতে গাছ বাঁচাতে একটা আন্দোলন হয়েছিল, চিপকো আন্দোলন। এটি দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
ক্যানভাস: চিপকো আন্দোলন সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন…
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: উত্তর ভারতে একবার বড় গাছ কেটে ফেলার চেষ্টা হলো। গাছ ব্যবসায়ীরা এ কাজ করতে গেল। কিন্তু ওই অঞ্চলের মানুষ গাছ কাটতে দেবে না। গাছ থেকে যেসব শুকনো ডাল, পাতা পায় সেগুলো দিয়ে জ্বালানি হয়। এগুলো খেয়েপরে তারা ভালো থাকে। যখন কোম্পানির লোকজন গাছ কাটতে এলো, তখন গ্রামের মানুষ সবাই হাতে হাত ধরে গাছগুলোকে জড়িয়ে রাখল। সরকারি লোকজন তাদের লাঠিপেটা করেছে। আন্দোলনকারীরা কয়েকজন মারাও গেছেন; কিন্তু পিছু হটেননি। পরে সরকার গাছ কাটা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। সে জন্য আন্দোলনের নাম হলো চিপকো আন্দোলন। অর্থাৎ গাছকে চিপে ধরে বাঁচানোর আন্দোলন। এখনো ভারতে কোথাও বড় গাছ কাটার উদ্যোগ নিলে চিপকো আন্দোলনের মতো মানুষ গাছকে জড়িয়ে ধরে রক্ষা করেন।
ক্যানভাস: উন্নত জাতি গঠনে প্রকৃতির ভূমিকা কতটুকু?
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: প্রকৃতিকে অনাদরে রেখে উন্নত জাতি হিসেবে গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। মানুষ প্রকৃতির অংশ; প্রকৃতি মানুষের অংশ নয়। মানুষের পৃথিবীতে আসার আগে প্রকৃতি ভরে গেছে। মানুষ তো গাছপালা থেকেই খাদ্য পেয়েছে। মানুষ চলে যাবে, কিন্তু প্রকৃতি থাকবে। বাংলাদেশে প্রতিটি জেলায় বাঘ ছিল। তা না হলে এত বাঘের গল্প কোথা থেকে এসেছে? হাতি ছিল। প্রাচীনকালের গল্পগুলো পড়লে দেখা যায়। দেব সাহিত্য কুটিরের বইগুলো পড়তে গিয়ে দেখি কাপ্তাইয়ে হাতি ধরা নিয়ে গল্প। কিন্তু বাঘ আর হাতি এখন বিপন্ন প্রাণী। এগুলোর জন্য দায়ী মানুষ।
ক্যানভাস: প্রকৃতি রক্ষা করার জন্য কী ধরনের উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন?
বিপ্রদাশ বড়ুয়া: সরকার থেকে কঠোর নজরদারি করতে হবে। শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। জেলা প্রশাসক, উপজেলা, এমনকি ইউনিয়ন পরিষদ প্রশাসনকে দায়িত্ব দিতে হবে গাছ রক্ষার। শতবর্ষী গাছগুলো রক্ষা করতে হবে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে গাছপালা, জীববৈচিত্র্যকে ভালোবাসে এমন লোক বাছাই করতে হবে। গাছকে যে ভালোবাসবে, তাকেই চাকরিতে নেওয়া হবে। তাকে ফুটপাতের পাশে বাগান রচনায় বাধ্য করতে হবে। বঙ্গবন্ধু রাস্তার পাশে ফুটপাতের জায়গায় ফলের গাছ লাগিয়ে দিয়েছিলেন। লোকেরা হেসেছিল। কিন্তু তিনি সঠিক কাজটিই করেছিলেন। এখন সেগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। দোকানপাট করা হচ্ছে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। গাছ রক্ষা মানে নিজেকে বাঁচানো। পরিবেশ রক্ষা। দেশকে রক্ষা। পৃথিবীকে রক্ষা।
ছবি: মো. রাকিবুল হাসান