skip to Main Content

ফিচার I উৎস প্রকৃতি

পরিবেশবান্ধব ফ্যাশনের জন্য প্রকৃতির মধ্যেই খোঁজা হচ্ছে উপাদানগুলো। মিলেছেও কিছু। লিখেছেন আহসান পাভেল

লোটাস সিল্ক
পদ্ম। ফুল হিসেবে এটি সবার পরিচিত। তবে এর ডাঁটার আঁশ থেকে তৈরি সুতায় প্রস্তুত হচ্ছে লাক্সারি ফ্যাব্রিক; লোটাস সিল্ক। পদ্ম সুতার সঙ্গে সিল্কের মিশেলে তৈরি। অনুপাতভেদে এর নানান ধরন হয়। লোটাস ফাইবার ৮৪ ও সিল্ক ১৬ ভাগ ব্লেন্ড করা ফ্যাব্রিক বেশ আরামদায়ক। আবার ৫৫ ও ৪৫ অনুপাতে তৈরি করা কাপড় নরম এবং হালকা। এই ফ্যাব্রিক পানিরোধক ও সহজে শুকিয়ে যায়। এমনও বলা হয়ে থাকে, জাদুকরী লোটাস সিল্ক গ্রীষ্মে শীতল ও শীতে উষ্ণ অনুভব দেয়। ফলে বছরজুড়ে তা ব্যবহার করা যায়। অন্যান্য মাইক্রোফাইবারের মতো এরও রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। নরম ও টেকসই। হাজার বছর আগেই এই বয়নকৌশল মানুষ আয়ত্ত করে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়েও যায়, যা ফিরে এসেছে। এখন লাক্সারি ফ্যাব্রিকের তালিকায় ঢুকে গেছে এর নাম। ফ্যাশন দুনিয়ায় বিরল কাপড়গুলোর একটি এটি। স্কার্ফ, হালকা জ্যাকেট ও ড্রেস তৈরির জন্য আদর্শ ফ্যাব্রিক লোটাস সিল্ক।
পদ্ম ডাঁটা তোলার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এর থেকে আঁশ ছাড়িয়ে নিতে হয়। কেননা, ডাঁটা পর্যাপ্ত ভেজা অবস্থায় না থাকলে আঁশগুলো ভেঙে যায়। তাই পদ্ম ডাঁটা সংগ্রহ করে দিনে দিনে এর আঁশ বের করে সতর্কতার সঙ্গে শুকাতে হয়। তারপর তা পাকিয়ে তৈরি করা হয় সুতা। অতঃপর হস্তচালিত তাঁতে প্রস্তুত হয় লোটাস সিল্ক। এর রয়েছে নিজস্ব বুননরীতি, যাকে বলা হয় খেমার টেকনিক। তাঁতে সুতা ফেলার সময় টানায় ব্যবহার হয় সিল্ক আর পোড়েনে (আড়াআড়ি) লোটাস সুতা। সারা দুনিয়ায় গুটিকয়েক তাঁতশিল্পীর রয়েছে এই সিল্ক তৈরির দক্ষতা। কম্বোডিয়া, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামে এর সীমিত উৎপাদন হয়। তৈরিতেও লাগে দীর্ঘ সময়। ২৫ সেন্টিমিটারের এক টুকরা লোটাস সিল্কের স্কার্ফ তৈরিতে দুই মাস পর্যন্ত লেগে যায়। ফলে দামটাও চড়া। একটি সাধারণ সিল্কের চেয়ে ১০ গুণ পর্যন্ত দাম হয়ে থাকে। ভিয়েতনামের বাজারে লোটাস ফ্যাব্রিকের একটি স্কার্ফের মূল্য দুই শ ডলার। তিন থেকে চার হাজার ডলারে বিক্রি হয় এই সিল্কের তৈরি প্রতিটি ড্রেস। আকাশছোঁয়া দাম সত্ত্বেও ফ্যাশনিস্তাদের মাঝে বাড়ছে এর কদর। মূলত যুক্তরাষ্ট্র, হংকং, সিঙ্গাপুর ও ইউরোপিয়ান বাজারে এর চাহিদা বেশি।
লোটাস সিল্ক পরিষ্কার করতে ডিটারজেন্ট ব্যবহারের সুযোগ নেই। কেবল পেট্রোলিয়াম সলভেন্ট দিয়ে ড্রাই ওয়াশ করতে হয়। অন্যদিকে এই সিল্কের পোশাকে আয়রন ব্যবহারের দরকার হয় না।
পাইনঅ্যাপল ফ্যাব্রিক
আনারসের পাতাও ফেলনা নয়। এর আঁশ দিয়ে তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের কাপড়। মূলত ফিলিপাইনে এই ফ্যাব্রিক প্রচলিত, যা পাইনা নামে পরিচিত।
এই ফলের চাষাবাদ হয় মূলত ফিলিপাইন, তাইওয়ান, ব্রাজিল, হাওয়াই, বাংলাদেশ, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজে। কিন্তু এর আঁশ ব্যবহার করে কাপড় তৈরির কৃতিত্ব ফিলিপাইনের। পাইনা তাঁতবস্ত্রের প্রচলন হাজার বছরের পুরোনো। হিস্পানিক সময়ে এর উদ্ভাবন হয়। পাইনা পোশাকগুলো বহু শতাব্দী আগে গ্রিস ও আফ্রিকান দেশগুলোতে পৌঁছেছিল বলে জানা যায়। উনিশ শতকে এই ফ্যাব্রিক দারুণভাবে সমাদৃত হয়। তা কেবল ফিলিপাইনে নয়, দুনিয়াজুড়ে। কিন্তু সুতিবস্ত্র সহজলভ্য ও জনপ্রিয় হলে অদৃশ্য হতে শুরু করে পাইনা। বিশ শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই কাপড়ের সংগ্রহ কিছু বয়স্ক মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। খণ্ডকালীন তাঁতিরা কেবল একে টিকিয়ে রেখেছিল। ফ্যাশন মার্কেটে এই কাপড় তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে দুই দশক ধরে।
আগেই বলা হয়েছে, পাইনা আনারসের পাতার আঁশ থেকে আসে। এই ফলের বেশির ভাগ পাতা লম্বা ও শক্ত হয়ে থাকে। পাতা থেকে প্রথমে সতর্কতার সঙ্গে একটি একটি আঁশ আলাদা করা হয়। মূলত এ কাজে ভাঙা প্লেট বা নারকেল মালার ব্যবহার চলে। অবশ্য গবেষকেরা এই কাজের জন্য কিছু টুলও তৈরি করেছেন, যাতে আঁশ বিচ্ছিন্ন করা সহজ হয়। আঁশ বের করার পর এগুলো ধুয়ে খোলা আকাশের নিচে শুকানোর নিয়ম। তারপর একটির সঙ্গে আরেকটি আঁশ জোড়া দিয়ে লম্বা করা হয়। আনারসের আঁশ অন্যান্য প্রাকৃতিক আঁশের থেকে চিকন। ফলে এক কেজি আঁশ দিয়ে ৬০ সেন্টিমিটার দীর্ঘ ১৫ থেকে ১৮টি পর্যন্ত সুতা তৈরি করা যায়। তারপর হস্তচালিত তাঁতে পাইনা তৈরি হয়, যা প্রাথমিক পর্যায়ে ক্রিম কালারের হয়ে থাকে। পরে এতে দেওয়া হয় পছন্দসই রং। পাইনা পুরোটাই হাতে তৈরি। ফিলিপাইনে একে কাপড়ের রানি বলে। সেখানকার অভিজাতদের পছন্দের ফ্যাব্রিক। পাইনার উৎপাদন সময়সাপেক্ষ ও কষ্টকর বলে এর দাম বেশি। মূল্য কিছুটা নাগালে রাখতে অনেক তাঁতি তৈরি করছেন পাইনা সিল্ক। আনারস আঁশের সঙ্গে সিল্কের মিশেলে এই কাপড় তৈরি হয়।
পাইনা আইভরি বা সাদা রঙের হয়। প্রাকৃতিকভাবেই এটি ঝলমলে। ওজনে হালকা ও মজবুত। অনেকটা লিনেন কাপড়ের মতো। দেখলে টিস্যু ফ্যাব্রিকই মনে হয়। পাইনা দিয়ে তৈরি পোশাকের মধ্যে রয়েছে ফিলিপাইনে ছেলেদের ওয়েডিং ড্রেস বারং টাগালগ, ব্লাউজ, গাউন, কোরসেট এবং বিভিন্ন ফরমাল ড্রেস।
মাশরুম লেদার
বেশ কয়েক বছর ধরেই ফ্যাশনে পশুর চামড়া ব্যবহারে আপত্তি জানিয়ে আসছেন পরিবেশবাদীরা। ফ্যাশন দুনিয়াও সীমিত করতে চাচ্ছে পশুর চামড়া। কিন্তু এর জন্য পেতে হবে উপযুক্ত বিকল্প। চামড়ার সামগ্রী তৈরিতে সাধারণত সিনথেটিক লেদার ব্যবহৃত হয়। সেগুলো আবার পরিবেশবান্ধব নয়। ফলে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব মাশরুম লেদারের সন্ধান মিললে ফুটওয়্যার ব্র্যান্ডগুলো কৌতূহলী হয়ে ওঠে। ফ্যাশনে নবীন এই উপকরণে শু, ব্যাগ ও আর্মব্যান্ড তৈরি হচ্ছে। যদিও পরিমাণে নগণ্য। চাহিদার বিপরীতে এর উৎপাদন সামান্যই। তবু উৎপাদকেরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন, কোন উপায়ে মাশরুম লেদারের উৎপাদন বাড়ানো যায়।
এটি তৈরির ইতিহাস বেশি পুরোনো নয়। ডেনিশ প্রডাক্ট ডিজাইনার ডোনাস এডভার্ড এর প্রবক্তা। তিনি প্রাকৃতিক কাঁচামাল দিয়ে বিভিন্ন নতুন উপকরণ তৈরির গবেষণা শুরু করেন। ২০১৩ সালে তিনি চামড়ার বিকল্প হিসেবে মাশরুম লেদার তৈরিতে সক্ষম হন। মাশরুম মাইসিলিয়াম এবং প্ল্যান্ট ফাইবার এর প্রধান উপকরণ। এডভার্ড দেখতে পান, মাশরুম চাষ শেষে এর বাড়তি উপকরণগুলো শুকিয়ে একধরনের আকার ধারণ করে। ফলে এগুলো নিয়ে নতুন উপকরণ তৈরির চেষ্টা করেন তিনি। সফলও হন। মাশরুম মাইসিলিয়াম ও প্ল্যান্ট ফাইবারের সঙ্গে হেম্প, লিনেন ফাইবার ও অন্যান্য উপকরণের মিশেলে তৈরি করেন ফাইবার ম্যাট। এর স্থায়িত্ব তাকে মুগ্ধ করে। এভাবে প্রস্তুত হয় মাশরুম লেদার।
এটি তৈরির বিভিন্ন কৌশল রয়েছে। নতুন নতুন উপায়ে উৎপাদনের চেষ্টাও চলছে। এর উৎপাদন বাড়াতে পারলে চাপ কমবে পশুর চামড়ার ওপর। এমনকি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্লাস্টিকজাত বিভিন্ন পণ্যের বিকল্প হয়ে উঠবে মাশরুম লেদারে তৈরি প্রডাক্টগুলো। ব্যবহার শেষে এর পণ্য সহজেই নষ্ট করে ফেলা যায়। ওজনে এটি হালকা ও নমনীয়। ফলে চামড়াজাত যেকোনো পণ্যই এই লেদার দিয়ে তৈরি করা যায়।
এখন সীমিত উৎপাদন হলেও আগামী দিনগুলোয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এটি নিয়ে কাজ করবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা, এটি নন-টক্সিক, পানিরোধক, অগ্নিনিরোধক। এর পুরুত্ব যেকোনো শেপে করা যায়। ফলে কাগজের পুরুত্বে যেমন পোশাক তৈরি সম্ভব, তেমনি চামড়ার পুরুত্বে তৈরি করা যেতে পারে ট্রেন্ডি লেদার গুডস। এটি একই সঙ্গে নমনীয় ও টেকসই।
ভিন্ন উপকরণে তৈরি এসব পরিবেশবান্ধব ফ্যাব্রিক এবং লেদারের উৎপাদন সীমিত হলেও দিনে দিনে তা বাড়ছে। ফ্যাশন মার্কেট এদিকে ঝুঁকছে।
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top