ফিচার I আমাদের ধ্রুপদি প্রেম
ভারতবর্ষে পুরাণ, অধ্যাত্মচেতনা ও লোকচিন্তাই প্রেমভাবনাকে পল্লবিত করেছে নানাভাবে। শেষ পর্যন্ত এগুলো মানবিক আবেগে উত্তীর্ণ। লিখেছেন মনোজ দেব
প্রেম নিয়ে আদিকাল থেকেই মানুষের কল্পনা এবং ব্যাখ্যার শেষ নেই। তবে এ সম্পর্কে কথা বলতে গেলে দুটি ধারণা সামনে আসে। প্লেটনিক বা নিষ্কাম প্রেম এবং ফ্রয়েডীয় কিংবা কামজ প্রেম। পৃথিবীব্যাপী এই দুটি রূপেরই নানান দর্শন কালে কালে উপস্থিত হয়েছে। ধ্রুপদি যত প্রেম মানুষের কল্পনা ও আবেগকে উজ্জীবিত এবং সঞ্চালিত করেছে, সেসবও এই দুটি তত্ত্ব বা দর্শনেরই অন্তর্গত। কিন্তু এই উপমহাদেশে এর যে রূপ ও আদর্শ গড়ে উঠেছে, তার কোনো কোনোটি এসব তত্ত্বের চেয়ে প্রাচীন। রাধা-কৃষ্ণ, লীলা-কঙ্ক বা রামি-চন্ডীদাস, দুষ্মন্ত-শকুন্তলা, রাম-সীতা অথবা বাস্তবের নর-নারীর কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া প্রেমই হোক-কোথাও তা বিরহ-মিলনের উৎকণ্ঠায় ব্যাকুল, কোথাও রূপক, কিংবা রক্তমাংসের উষ্ণতায় আবেগময়।
বৈষ্ণববাদে রাধা-কৃষ্ণ জীবাত্মা ও পরমাত্মার রূপক। এ দুটির মিলনের আকুতি চিরন্তন। বৈষ্ণবরা ‘আমি’ ও ‘তুমি’র সম্পর্কের মাধ্যমে জীবাত্মা এবং পরমাত্মার লীলারস আস্বাদন করেননি। তারা ‘আমি’ ও ‘তুমি’র স্থানে রাধা-কৃষ্ণের রূপকের মধ্য দিয়ে হৃদয়বৃত্তির চর্চা করেছেন। পারস্যের সুফি দার্শনিকদের এই প্রেম-ভাবনা বেশ সূক্ষ্ম এবং জটিল। রাধা-কৃষ্ণের দর্শন সে তুলনায় সহজ। কারণ, এরা দুজনই এখানে সাধারণ নারী-পুরুষ। সংসারে বা বাস্তব জীবনে দুজন নর-নারীর যেভাবে পূর্বরাগ, অনুরাগ, অভিসার, মান, আক্ষেপ, প্রতীক্ষা, মিলন এবং বিচ্ছেদ ও বিরহের অবকাশ রয়েছে বৈষ্ণবরা রাধা-কৃষ্ণকে দেহজ সম্পর্কের সেই প্রচলিত পটভূমিতে রেখে প্রেম সম্পর্কে ভাবনা প্রকাশ করেছেন।
চণ্ডীদাস বলেছেন, রজকিনী প্রেম নিকষিত হেম, কাম গন্ধ নাহি তায়। জলে ক্রীড়া করবে অথচ জল ছোঁবে না। মিলনের মধ্য দিয়ে কাম ভাব সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য নয়। নারী কীভাবে তার সবকিছু সমর্পণ করে প্রেমিককে তুষ্ট করার জন্য সচেষ্ট, তা-ই তুলে ধরা তাদের লক্ষ্য। তবে বৈষ্ণব পদাবলির অনেক জায়গায় নারীকে কতভাবে ভোগ করা যায়, তার অসংখ্য বর্ণনাও রয়েছে। কিন্তু সেসবই রূপক অর্থে লেখা হয়েছে। মূলত বৈষ্ণব সাহিত্যে রাধা-কৃষ্ণের প্রেমের যে দর্শন প্রকাশিত, তাতে জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের ইচ্ছাই প্রধান। অর্থাৎ তা নিষ্কাম প্রেমের আদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বাঙালির প্রেম-দর্শনকে সমৃদ্ধ করেছে কালিদাসের ‘মেঘদূতম্’। বিরহী এক প্রেমিকের আকুলতা দীর্ঘকাল ধরে মানুষের মনের গভীরে বেজে চলেছে। আকাশে বর্ষার নতুন মেঘের ঘনঘটা দেখলেই আমাদের স্মৃতিতে ভেসে ওঠে নির্জন পর্বতে নিঃসঙ্গ এক প্রেমিকের মিনতি। রাজকাজে অবহেলার শাস্তিস্বরূপ রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত হয়েছিল যক্ষ। তার প্রিয়া আছে অলকাপুরীতে। যক্ষ মেঘের কাছে অনুরোধ করে, সে যেন তার প্রেমের বাণী বয়ে নিয়ে যায় অলকায়। প্রেমে বিরহই যেন চিরন্তন। মিলনের আকাঙ্ক্ষয় ব্যক্তির মনের তীব্র আবেগ ও বেদনা সৃষ্টি করে, তাই এই উপমহাদেশে ধ্রুপদি প্রেমের একটি রূপ তৈরি করেছে।
দুই
তবে মানুষ প্রেম ভাবনার গোড়া থেকেই দেবতাকেও নিজের স্বরূপে কল্পনা করে নিয়েছিল। পুরাণের ঘটনাবলি এ কারণেই সমাজে নানানভাবে ক্রিয়াশীল থেকেছে, এবং এখনো তার রেশ রয়েছে। তাই মানুষের দোষ-গুণও দেখা যায় দেবতাদের প্রেম-জীবনে। বস্তুত তাদের ইন্দ্রিয়পরায়ণ, কামাসক্ত, বহুপত্নীক এমনকি অনেক ক্ষেত্রে ব্যভিচারী রূপে পাওয়া যায়। দেবসভা অপ্সরাদের নাচের ছন্দে মুখরিত হতো। এদের মধ্যে উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা, বিদ্যুৎপর্ণা, ইন্দ্রাণী বা শচী উল্লেখযোগ্য। এদের প্রত্যেকেই নৃত্যকলায় পারদর্শী, প্রেম ও যৌনাবেদনময়ী।
ঋগ্বেদে থেকে কথাসরিৎসাগর পর্যন্ত, নানা প্রাচীন গ্রন্থে উর্বশীর প্রণয়ের কথা রয়েছে। এই অপ্সরা সম্বন্ধে বিভিন্ন পুরাণে একাধিক কাহিনি প্রচলিত আছে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে প্রসিদ্ধটি হলো পুরুরবার সঙ্গে উর্বশীর মিলন। এই প্রেম ও মিলনের সবচেয়ে প্রাচীনতম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগে¦দের সংবাদসুক্তে। সেই আখ্যানে আছে, উর্বশী চার বছর পুরুরবার সঙ্গে ছিলেন এবং গর্ভবতী হওয়ার পর তিনি চলে যান। শতপথব্রাহ্মণে রয়েছে এই নারী কয়েকটি শর্তে পুরুরবার সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী রূপে বাস করতে রাজি হন। সেগুলো হলো- উর্বশী কোনো দিন যেন পুরুরবাকে বিবস্ত্র না দেখেন, তার বিছানার পাশে প্রিয় দুটি মেষ বাঁধা থাকবে এবং তারা কখনো হারাবে না, উর্বশী এক সন্ধ্যামাত্র ঘি খাবেন। অন্যত্র আরও একটি শর্ত ছিল- উর্বশী কামাতুর না হলে মৈথুনকর্ম সংগত হবে না। শতপথব্রাহ্মণ অনুসারে পুরুরবা শর্তগুলো পালন করেন। কিন্তু দেবলোকে গন্ধর্বরা ব্যথিত হন। কৌশলে শর্তগুলো ভাঙার উপায় হিসেবে এক রাতে গন্ধর্ব বিশ্বাবসু মেষ দুটি চুরি করেন। উর্বশী কাঁদতে কাঁদতে পুরুরবাকে তা উদ্ধারের জন্য অনুরোধ করে। পুরুরবা নগ্ন অবস্থাতেই বিছানা ছেড়ে দ্রুতগতিতে বিশ্বাবসুর পেছনে ছুটতে থাকে। এ সময় দেবতারা বজ্রপাত ঘটান। এতে বিদ্যুতের আলোয় উর্বশী পুরুরবকে বিবস্ত্র দেখে তখনি অদৃশ্য হয়ে যান। পুরুরবা তখন উর্বশীর সন্ধানে দেশ-বিদেশ ঘুরতে থাকে। একদিন কুরুক্ষেত্রের কাছে এক জলাশয়ে চারজন অপ্সরার সঙ্গে উর্বশীকে স্নান করতে দেখে তাকে ফিরে আসতে অনুরোধ করে। উর্বশী জানায়, সে গর্ভবতী। বলে, এক বছর পর দেখা করলে তোমাকে আমার প্রথম সন্তান উপহার দেব এবং মাত্র একরাত্রি তোমার সঙ্গে বাস করব। এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর পর তাদের মিলন ঘটে। গন্ধর্বরা পুরুরবাকে বর দিতে চাইলে সে উর্বশীর সঙ্গে চিরপ্রেমিক হয়ে বাস করতে চান।
ঋগ্বেদে যমী তার যমজ ভাই যমের কাছে সঙ্গম কামনা করে। দম্ভ নিজের বোন মায়াকে, লোভ নিবৃত্তিকে, ক্রোধ হিংসাকে ও কলি নিরুক্তিকে প্রেম নিবেদন এবং বিয়ে করেছে। আদিত্যযজ্ঞে মিত্র ও বরুণ উর্বশীকে দেখে প্রেমে ও কামলালসায় অভিভূত হয়ে যজ্ঞকুম্ভের মধ্যে শুক্রপাত করে। আবার উষাকে পাবার জন্য সূর্য, ইন্দ্র, অগ্নি ও অশ্বিনীদ্বয় দেবতাদের মধ্যে ভীষণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। এই পাঁচ শক্তিমান দেবতা উষার প্রেম প্রার্থী হওয়ায় প্রজাপতিগণ ঘোষণা করেন যে, অসীম আকাশপথ যিনি জয় করতে পারবেন এবং যত বেশি স্বরচিত বেদমন্ত্র উচ্চারণে সক্ষম হবেন, তিনিই পাবেন এই অপ্সরাকে। মৎস্যপুরাণে শতরূপ ব্রহ্মার কন্যা। কিন্তু ব্রহ্মা কন্যার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়। তার গর্ভে মুনর জন্ম। যদিও এর অন্য বিবরণও পাওয়া যায়। আবার তৈত্তিরীয়ব্রাহ্মণ অনুযায়ী ইন্দ্রাণী বা শচীর প্রেমে ও যৌনাবেদনে আকৃষ্ট হন স্বয়ং ইন্দ্র। এ জন্য তিনি অনেক সুন্দরীর প্রেম প্রত্যাখ্যান করেন।
শিবের জনপ্রিয়তা বাংলায় অদ্বিতীয়। সে জন্যই বাঙালি ধান ভানতেও শিবের গীত গায়। এ অঞ্চলে অসংখ্য শিব মন্দিরের উপস্থিতিতেও তার প্রমাণ মেলে। শিবজায়া শিবানীর উৎসবই এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগেও ছোট ছোট বাঙালি মেয়েরা বৈশাখে শিবপূজার সময় ছড়া ও মন্ত্র স্বগতোক্তি করত- ‘গৌরী কি ব্রত করে?’ ব্রতের শেষে প্রার্থনা করত- ‘যেন শিবের মতো বর পাই।’ তখন বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় সব মেয়েই কল্পিত হতো গৌরী হিসেবে। আর শিব বাঙালির কাছে জামাইবিশেষ।
এসব কাহিনি মূলত ধ্রুপদি প্রেমের দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। যদিও আপাতদৃষ্টিতে কামজ মনে হলেও এর আড়ালে রয়েছে মানবজীবনের চিরায়ত প্রেম-ভাবনার প্রকাশ। দুঃখ, বিরহ, বেদনা ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত মিলনই মানুষের একান্ত কামনা।
তিন
প্রথম দিকে পারস্যের সুফি দার্শনিকদের প্রেম-ভাবনার বিষয়টি বলা হয়েছে। পারস্য-আরব-মিসরে সৃষ্টি রোমান্সের কিছু কাহিনিও বাংলা অঞ্চলের প্রেমের ভাবাদর্শ তৈরি করেছে। এসবের মধ্যে শিরি-ফরহাদ, লায়লি-মজনু, ইউসুফ-জোলেখা উল্লেখযোগ্য। রূপের প্রতি মুগ্ধতা, বিরহ ও মিলনের যুগল নাটকীয়তায় ভরা এসব প্রেমকাহিনি। যা মূলত রূপক। অধ্যাত্মবাদী প্রেমই এর লক্ষ্য। মধ্যপ্রাচ্য থেকে এই প্রেমের আখ্যান বাংলা অঞ্চলে এলেও তাতে মিশেছে এখানকার লোককথা, রূপকথা, পুরাণ ও স্থানীয় সমাজের নানান সংস্কার। ফলে তা আর পুরোপুরি বিদেশি থাকেনি। এমনকি সুফিবাদী চেতনার মধ্যেও তার অর্থ শেষ হয়ে যায়নি; বরং এখানকার মানুষ ও সমাজের সঙ্গে মিলেমিশে এসব রোমান্টিক প্রেমের আখ্যান অনেকটা বাস্তব জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে।
ছবি: ইন্টারনেট