ফিচার I বসন্তের অভিধান
এ ঋতুর পরিচায়ক শব্দটির রয়েছে নানান অর্থ। ফলে অর্থান্তর অবধারিত। কালে কালে এর রূপবদল ঘটেছে, কিন্তু ঋতুটির মর্ম ও সৌন্দর্য রয়েছে আগের মতোই। লিখেছেন আবু হেনা মোস্তফা এনাম
বসন্ত মানে কী? আজব প্রশ্নই বটে! কেউ হয়তো খুঁজতে চাইবেন ‘কুরঙ্গ’-এর অর্থ। এর মানে কি নেতিবাচক বিনোদনের কোনো রসিকতা? অথবা ‘কুম্ভীপাক’ কি বিশালাকার কোনো কুমিরের পাক খেয়ে বেড়ানো? একইভাবে ‘নখদর্পণ’ বা ‘কুজ্ঝটিকা’ শব্দের অর্থ খোঁজার জন্য অভিধান ঘাঁটতে চাইবেন কেউ। ফরাসি ঔপন্যাসিক গুস্তাভ ফ্লবের তার অসমাপ্ত বুভার ও পেকুশে নামের উপন্যাসে জুড়ে দিয়েছিলেন আহাম্মকের অভিধান। [The Dictionary of Received Ideas (in French, Le Dictionnaire des Idées Reçues)] সেখানে বলা হয়েছে, ‘অভিধানের নাম শুনলে হাসবে।’ ফ্লবের হাড়ে হাড়ে রসিক ছিলেন। আতশি কাচের তলায় সমকালকে রেখে মুচকি হেসে দেখেছিলেন মানুষের মনের এপিঠ-ওপিঠ। ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ আর শ্লেষের হদিস নিতে গেলে এখনো অভিধানটির নাম নিতে হয়।
ফ্লবেরের কথা উঠল, ধান ভানতে শিবের গীতের মতোই। কেননা, বসন্ত শব্দের মানে আমাদের অজানা নয়। ফাল্গুন ও চৈত্র মাসব্যাপী ঋতু বললে এর কালগত সীমা বোঝা যায়। [অবশ্য হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষে চৈত্র ও বৈশাখ, মতান্তরে ফাল্গুন ও চৈত্র নিয়ে ষষ্ঠ ঋতুর বিস্তারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।] কিন্তু এর অর্থ ঝম্প দেওয়া, ফাটিয়া বাহির হওয়া, ফাঁক হইয়া যাওয়া বা মসূরিকা, গুটিকা বললে বিদ্রূপাত্মক মনে হতে পারে। এমনকি আগাগোড়াই একটি বিভ্রান্তি তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ, বসন্তকে ঋতু হিসেবে জানলেও এর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মানে রয়েছে। প্রায় প্রতিটি শব্দ সৃষ্টির পেছনেই এই পরিপ্রেক্ষিত বিদ্যমান। সাধারণত মধুকাল, ঋতুরাজ, মধুমাস, ঋতুপতি, হিমান্ত ইত্যাদি সমার্থক শব্দ দিয়ে এর ব্যাপ্তি ও বৈশিষ্ট্য বোঝানো হয়। কিন্তু কীভাবে উপরের শব্দগুলো বসন্তের সমার্থক হয়ে উঠল? এর সঙ্গে সময়ের যোগসূত্র বা সংস্কৃতির সম্পর্ক কী?
শীতের কুয়াশায় বৃক্ষরাজি পাতা ঝরিয়ে নতুন রূপে সেজে ওঠার প্রস্তুতি নেয়। এ যেন পুরোনো জীর্ণ পোশাক সরিয়ে সৌন্দর্যের আহ্বান। শুষ্কতার পর শুরু হয় সজীব প্রাণের উপস্থিতি। ফুল ফোটে। পাখি, মৌমাছি আর কীটপতঙ্গের খাদ্য সহজে মেলে বলে তাদের জীবনও তখন হয়ে ওঠে আনন্দময়। প্রকৃতি হয় বহু রঙ আর সুরের রঙ্গশালা- বসন্তে। প্রবাহিত হয় দখিনা বাতাস। অভিধানে রয়েছে মলয় বাতাসের কথা। আবহাওয়া থাকে নাতিশীতোষ্ণ। অর্থাৎ না গরম, না শীত। অন্যান্য ঋতু থেকে এই মৌসুমের রূপ ও সৌন্দর্য একেবারেই আলাদা। এ জন্যই কি এর নাম ঋতুরাজ বা ঋতুপতি?
তাহলে বসন্তের অর্থ মধুকাল বা মধুমাস কীভাবে হলো? এরও কি রয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কারণ? হতে পারে। যদিও অভিধানপ্রণেতারা কোনো ব্যাখ্যা দেননি। সম্ভবত, অন্য ঋতুর চেয়ে বসন্তে অরণ্য বা শস্যখেত এবং শৌখিন বাগানে প্রচুর ফুল ফোটে। এ সময়, অগ্রহায়ণ থেকে জ্যৈষ্ঠ, মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ করে। কোথাও পরিবেশগত কারণে ব্যতিক্রম ঘটতে পারে। এই খাদ্য-উপাদনের সঙ্গে জড়িত মৌয়ালদের জীবিকা। উল্লেখ্য, গত মৌসুমে কেবল সুন্দরবন থেকে ১ হাজার ৫০ কুইন্টাল মধু এবং ২৬৫ কুইন্টাল মোম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায় অর্থনীতিতে এর গুরুত্ব। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য মানুষ। তাদের সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক ভূমিকা, সাংস্কৃতিক জীবনাচারের কারণেই হতে পারে বসন্ত ঋতুর এমন সমার্থক শব্দ।
অন্যদিকে বসন্ত উত্তর ভারতীয় সংগীতশাস্ত্রে বর্ণিত পূরবী ঠাটের একটি রাগ। গম্ভীর প্রকৃতির। মধ্য ও সপ্তকে এর বিস্তার ঘটে। বসন্ত ঋতুর রাগ হিসেবে এটি সাধারণত এ সময়, ফাল্গুন-চৈত্রে গাওয়া হয়ে থাকে। এই রাগ রাত্রির শেষ প্রহরে গাওয়ার নিয়ম রয়েছে। প্রাচীনকালে এই রাগকে স্ত্রীলিঙ্গের বিচারে সংগীতবিদেরা বাসনী বা বাসন্তী নামে অভিহিত করেছেন। বসন্ত ঋতু এবং রসের বিচারে তা শৃঙ্গার। বিলাবল ঠাটের বসন্তটিকে বলা হয় শুদ্ধ-বসন্ত। আবার এর সঙ্গে বাহার ও মুখারি রাগের মিশ্রণও ঘটেছে। কাফি ঠাটের এই মিশ্র রাগটির নাম বসন্তবাহার। আর বসন্তমুখারি হলো হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের একটি রাগবিশেষ।
বসন্তের সঙ্গে আরও কিছু শব্দ যোগ হয়ে তার অর্থ বদলে গেছে। দাঁড়িয়েছে বিশেষ মানে। যেমন ‘দূত’, ‘তিলক’, ‘সখ’ ‘বায়’ ইত্যাদি। কোকিলের নাম বসন্তদূত। বসন্ততিলক সংস্কৃত ছন্দবিশেষ। ছন্দোমঞ্জরীকর্ত্তা সামন্যতঃ দুই প্রকার ছন্দের উল্লেখ করেছেন। কেবল অক্ষর গণনায় যে ছন্দ নিবদ্ধ হয়, তার নাম বৃত্ত। এটিকেই বলা হয়েছে বসন্ততিলক। যেমন:
ফুল্লং বসন্ততিলকং তিলকং বনাল্যাঃ
লীলঅপরং পিককুলং মলমত্র রৌতি। (ছন্দোমঞ্জরী)
হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষে বসন্তের অর্থ রূপে প্রথমেই লিখেছেন, ‘যাহাতে কামের বাস।’ দ্বিতীয়ত এর মানে ‘কামসখ’। দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি তুলে দিয়েছেন সংস্কৃত বাক্য: ‘সুহৃদঃ পশ্য বসন্ত কিং স্থিতম্।…অর্থাৎ, শব্দটির সঙ্গে হৃদয়ের যোগ রয়েছে। মানে ইন্দ্রিয়জ, যা থেকে কামের উদ্ভব। তাই এর অপর একটি সমার্থক পদ কামদেব। ভারতীয় পুরাণোক্ত কামদেব বা মদন প্রেম ও কামের দেবতা। বিভিন্ন পুরাণে তার কাহিনি কথিত হয়েছে। তার কাজ জীবজগতে কাম ও প্রেমের জন্ম দেওয়া। শ্রীমদ্ভাগবত ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে রয়েছে কামদেবের অপর নাম অনঙ্গ। ইনি পুষ্পময় পাঁচ প্রকার শর দ্বারা শোভিত। এই পাঁচটি শর হলো- সম্মোহন, উন্মাদন, শোষণ, তাপন, স্তম্ভন। এই পাঁচটি শর পাঁচটি ফুলের প্রতীকে শোভিত। ফুলগুলো হলো অরবিন্দ, অশোক, আ¤্র, নবমল্লিকা বা শিরিষ ও নীলোৎপল। যেগুলো সবই ফাল্গুন-চৈত্র-বৈশাখে ফোটে। এসব ফুল ও ধূপ-ধুনোসহ পূজা সারতে হয় কামদেবের। তারপর প্রজ্বলন করতে হয় বিশুদ্ধ ঘি-এর দীপ। এ কারণেই কি কামদেব বসন্ত শব্দের সমার্থক?
আবার বসন্ত মানে মসূরিকা। সংস্কৃত এই শব্দের বাংলা অর্থ চর্মরোগবিশেষ। বসন্তে প্রাদুর্ভাব হেতু এই নাম। গুটিকা বা গুটি বসন্তও।
অভিধানে বিভিন্ন অর্থে বসন্তকে অভিহিত করা হয়েছে। সবই প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। নেতিবাচকতা থাকলেও এই ঋতু নিসর্গ এবং জনজীবনে নিয়ে আসে প্রেম ও সৌন্দর্যের আবেগ।
সহায়ক গ্রন্থ
বঙ্গীয় শব্দকোষ (দ্বিতীয় খন্ড), হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্য আকাদেমি, কলকাতা, ২০০৪
সংগীত পরিচিতি (উত্তর ভাগ), শ্রী নীলরতন বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা, ১৯৭৯
সঙ্গীতশাস্ত্র, তৃতীয় খন্ড, শ্রীইন্দুভূষণ রায়, আদিনাথ ব্রাদার্স, কলকাতা।
ছবি: সংগ্রহ