skip to Main Content

ঘরেবাইরে I প্রকৃতিলালিত পাঠাগার

ঢাকার কাছেই। অনেকটা গ্রামীণ আবহের মধ্যে বইয়ের সংগ্রহশালা। জ্ঞান আহরণের সঙ্গে নিসর্গের পাঠও নেওয়া যায়

জিন্দাপার্ক। জলাশয়ের ধারে দাঁড়ানো পাঁচতলা গোলাকার ইমারত। পাঠাগার। দৃষ্টিনন্দন। প্রকৃতিবান্ধবও।
জিন্দা গ্রামটা বছর তিরিশ আগেও এক বিচ্ছিন্ন জনপদ ছিল। বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য পাড়ি দিতে হতো বিস্তীর্ণ জলাশয়। প্লাস্টিকে বই-খাতা মুড়ে মাথার ওপরে তুলে জলাশয় পার হওয়ার কষ্ট কম ছিল না। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে লাগলেন এলাকার কিছু তরুণ। একটা কমিটি করে তারা তালপাতার ছাউনি দিয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৩ সালের দিকে তারা চিন্তা করেন একটি স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয় তৈরির। তখন পূর্বাচলের পরিকল্পনার একজন ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার চোখে পড়ে এই জায়গা। সেখানে ছয়টা ভিন্ন ভিন্ন পার্কের পরিকল্পনা আগে থেকেই ছিল। দেখা গেল, স্থানটি একত্র করে একটা উদ্যোগ রয়েছে গ্রামবাসীর, তখন এটাকে পার্ক নির্মাণের পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তারপর তা একটু ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে থাকে। পার্ক গড়ে ওঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবনা থেকে একটু সরে আসতে হয়। ফলে তারা স্কুলের কাজে হাত দেন। স্থপতি সায়েদুল হাসান রানা এ সময় তাদের সঙ্গে যুক্ত হন। স্কুল তৈরি হয়। কলেজ প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা বাতিল হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে যে পাঠাগার থাকার কথা, সেটি কিন্তু বাদ যায়নি। গড়ে তোলা হয় জলাশয়ের লাগোয়া এই পাঠাগার। এখানেই তৈরি হওয়ার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়।
পাঠাগারের প্রবেশমুখে বিশাল দরজা, সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেখানে পৌঁছতে হয়। নানা ধরনের গাছপালার সঙ্গে মিতালি রয়েছে এখানে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই লম্বা এক পিলার ঘিরে কাউন্টার। সেখানে বিক্রি হয় নানা ধরনের শিক্ষাসামগ্রী। লাইব্রেরিয়ানের বসার জায়গাও সেটি। বামে জুতা-ব্যাগ রেখে চাইলে ডানে বসে পড়াশোনা চালিয়ে নেওয়া যায়। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই বিশাল মাটির মটকা স্বাগত জানায়। সেখানে রয়েছে খানিকটা নিচু ফ্লোরে বসার ব্যবস্থা। তিনতলায় চারপাশে কাঠের টেবিল। চারতলায় পিলারটির মাথায়ও তা বসানো হয়েছে। সেটা ঘিরে রয়েছে বসার আয়োজন। নিচের ফ্লোর বাদ দিলে প্রতিটি তলাতেই দেয়ালের সঙ্গে লাগোয়া বইয়ের শেলফ আছে। আলো-বাতাসের জন্য জালির ব্যবহারের পাশাপাশি রয়েছে বড় কাচের জানালা। একদম শীর্ষে অর্থাৎ পঞ্চম তলা প্রায় পুরোটাই কাচ দিয়ে ঘেরা। দরজা পেরিয়ে বারান্দায়ও বসে বই পড়া যায়। এখান থেকে পুরো এলাকা দেখা যেতে পারে পাখির চোখে। যারা নিরিবিলি বসে পড়তে চান, তাদের কাছে সম্ভবত এই তলাটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
পাঠাগার নিয়ে কথা হয় আর্কিটেক্টস ডিজাইন স্টুডিওর শাহরিয়ার আহমেদের সঙ্গে। মূল স্থপতি সায়েদুল হাসান রানা ঢাকার বাইরে থাকায় তিনিই খানিকটা ধারণা দিলেন। শাহরিয়ার জিন্দাপার্কের ইতিহাস জানিয়ে দিলেন। বললেন জলাশয়ের কাছে হিজলগাছের মৌচাক থেকে কীভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে পাঠাগারের নকশাটা তৈরি হয়েছিল। সেটি প্রাকৃতিক হলেও আকৃতি ছিল অনেকটাই সংগঠিত, সিলিন্ড্রিক্যাল আর ইউনিফর্মড।
সায়েদুল হাসান রানার কাজ অনেকটাই প্রকৃতিঘেঁষা। তিনি যে ধারার স্থাপনাগুলো করছেন, তা হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত হয়ে আসছে। রানা জিন্দাপার্কে ব্লক দিয়ে নিরীক্ষা করেন।

কারণ, তিনি দেশের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ ভূপৃষ্ঠের উর্বর মাটি রক্ষা করতে চাইছিলেন। যেটা নষ্ট হচ্ছে ইট বানাতে গিয়ে। এমন নয় যে কংক্রিট প্রকৃতিবান্ধব, তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপট বিবেচনায় ইটের থেকে তা কম নয়। বালুর চেয়ে উর্বর মাটির মূল্য তো বেশিই। লাইব্রেরিতে বিভিন্ন ধরনের ব্লক নিয়ে নিরীক্ষা করা হয়েছে। এখানেই তিনি জালির কাজও শুরু করেন।
লাইব্রেরির সিঁড়িগুলো স্ট্যাগার (টলানো) করে উঠে গেছে। যাতে প্রাকৃতিক আলো বাতাস প্রবহমান থাকে বড় বড় ভয়েড-স্ট্যাগারিংয়ের মাধ্যমে। এই সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মাটি স্পর্শের অনুভূতি পাওয়া যায়।
মুঠোফোনে সায়েদুল হাসান রানা জানালেন, লাইব্রেরির মূল কনসেপ্ট ছিল লন্ঠন। জলাশয়ের পাশে চমৎকার প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে, বিশেষত রাতের বেলা যখন আলো জ¦লে, তখন সেটা লন্ঠনের মতোই দেখায়। সিঁড়িতে বসার ব্যবস্থাও আকর্ষণীয় করা হয়েছে, বিভিন্ন ধরনের পাঠকের কথা মাথায় রেখেই। যেহেতু এটা কমিউনিটি লাইব্রেরি, তাই নানান লেভেলে বসার ব্যবস্থা পৃথকভাবে করা হয়েছে, সেটাও ভিন্ন ভিন্ন জনরার বই আর স্বতন্ত্র বয়সের পাঠকের কথা ভেবে। কাচের ব্যবহার হয়েছে মূলত দুটো কারণে- প্রথমত বাইরের নৈসর্গিক দৃশ্যাবলি অনেকটা পেইন্টিংয়ের বিকল্প হিসেবে দেখা যাবে, দ্বিতীয়ত আলোর পর্যাপ্ততা নিশ্চিত করা। প্রাকৃতিক আলো, বাতাস, দৃশ্য আর এই পাঠাগার- সব মিলিয়ে এটা শিক্ষারই একটা অংশ হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্থাপত্যিক দিক থেকেও যেন এটা শিক্ষণীয় হয়, সেই চেষ্টাই করা হয়েছে।
প্রতিদিন বিকেল চারটা থেকে খোলা থাকে জিন্দাপার্ক পাঠাগার। শুক্র-শনিবার আর সরকারি ছুটির দিনগুলোতে সারা দিনই দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এখানে প্রবেশের জন্য রয়েছে ছোট্ট একটা শুভেচ্ছামূল্য।

 আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট

This Post Has One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top