ছুটিরঘণ্টা I বালি রাজার দেশে
মনোরম এক দ্বীপ। সেখানে পুরাণ, ইতিহাস আর কিংবদন্তি মিলেমিশে আছে। সমুদ্র, পাহাড়, অরণ্য- এসবের উপভোগ্য বিস্তৃতির মধ্যে। ঘুরে এসে লিখেছেন শুক্লা পঞ্চমী
আমরা তিন সহকর্মী বেরিয়ে পড়েছিলাম বালি রাজার দেশ দেখতে। ইন্দোনেশিয়ার একটি দ্বীপ। জাভা শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে। ইন্দোনেশিয়ার ৩৩তম প্রদেশ। বালিকে ‘পৃথিবীর অন্তিম স্বর্গোদ্যান’ বা ‘দ্য লাস্ট প্যারাডাইস অন আর্থ’ও বলা হয়।
কেন বালি রাজার দেশ বলা হলো? ছোটবেলা ঠাকুমার মুখে রামায়ণের গল্প শুনতাম। এই মিথের কাহিনিতে রাম, সুগ্রীব আর রাবণের যুদ্ধকালীন বালি দ্বীপের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। ভেবে আশ্চর্য হতাম- চারপাশে সমুদ্র, উঁচু উঁচু ঢেউ, মাঝখানে দ্বীপ; কেমন হবে দিব্যচক্ষুতে দেখতে! আমার সঙ্গী সেলিনা (রাখী) এবং জান্নাত আপা।
বালি ভ্রমণের আগে ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখে নিলাম দর্শনীয় স্থানগুলো। দ্বীপটিতে যেতে ভিসার দরকার হয় না। এয়ারপোর্টে নেমে শুধু একটি পারমিশন নিলেই চলে।
আমাদের বিমান ছিল মালয়েশিয়ান। যখন এয়ারপোর্টে নামলাম, তখন ভোর পাঁচটা। সূর্যের আলো নেই। মালয়েশিয়ার আবহাওয়াটাই এ রকম- কিছুটা গ্লুমি। তারপর প্রায় দুই ঘণ্টা আকাশে উড়ে নামলাম বালির মাটিতে। আগেই বলেছি, পারমিশন নিতে হয় থাকার জন্য। প্রত্যেকের আলাদা ফরম পূরণ করতে হলো। সব শেষ করে ট্যাক্সিযোগে রওনা দিলাম ‘রামায়ণা’ হোটেল অভিমুখে। তখন দুপুর বারোটা। থ্রি স্টার রামায়ণা হোটেলের প্রধান সুবিধা হলো এটি কুতা বিচের কাছে। বলতে গেলে যোগাযোগের জন্য বেশ ভালো। পথের দুধারে রয়েছে ছোট ছোট ম্যাসাজ সেন্টার, দোকানপাট, খাবারের দোকান। রয়েছে সারি সারি সি ফিশের অ্যাকোরিয়াম। আর আছে পাফ।
শহরে ঢুকেই চোখে পড়ল বড় বড় কাহিনিভিত্তিক স্ট্যাচু। রামায়ণ, মহাভারতের ঘটনাবলির ওপর নির্মিত সেসব। কারুকাজখচিত।
ঠিক হলো, কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে বের হব কুতা বিচের দিকে। হোটেলের রুম দেখে মন আরও ভালো হয়ে গেল। বিশাল রুম, সঙ্গে ডিলাক্স বেড। বারান্দা। এদিকে বিকেল গড়িয়ে গেছে, তবু মাথার উপর প্রখর সূর্য! স্নান সেরে রওনা দিলাম বিচের দিকে। সেখানে গিজগিজ করছে ট্যুরিস্টরা। রাস্তার দুপাশে নানা দ্রব্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে স্থানীয় লোকজন।
সমুদ্রে তখন জোয়ার। বিশাল সব ঢেউ আছড়ে পড়ছে তীরে। এর আগে সমুদ্র দেখেছি বহুবার, কিন্তু এমন ঢেউ কল্পনাতেও ছিল না। জান্নাত আপা জানালেন, এর নাম ভারত মহাসাগর। খানিকক্ষণ কাটানোর পর আশপাশটা দেখতে বেরোলাম। যেখানেই যাচ্ছি মোবাইলে ছবি তুলে রাখছি। ঘুরে ঘুরে দেখলাম বাড়িঘর দোকানপাট আর রেস্টুরেন্ট। অভূতপূর্ব কারুকাজখচিত বাড়িঘর আর রেস্টুরেন্টগুলো। রাস্তার দুপাশে বসেছে দোকানপাট। ঘর সাজানোর জিনিস, অর্নামেন্ট, বিভিন্ন লোকজ দ্রব্য, মুখোশ, পুতুল, চুড়ি, বাটিকের তৈরি পোশাক ইত্যাদি পণ্য। কেনা ছাড়াও উপভোগ করা যায় বেশ।
রাতে বালির অন্য রকম আবহ। ট্যুরিস্টদের দৃষ্টি কাড়তে চলে মনোজ্ঞ আয়োজন। হোটেলগুলোতে চলে প্রতিযোগিতা। লাইভ কনসার্টে স্থানীয় শিল্পীরা গাইছে জিম মরিসন, রেইনবো, বব ডিলান, স্করপিয়ন্সের গান। মুগ্ধ হয়ে শুনলাম সেসব। রেস্টুরেন্টে ডিনার সেরে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস নিয়ে রুমে ফিরলাম। হোটেলে ঢুকে ট্যুর ডেস্ক থেকে পরের দিনের ঘোরার জায়গা ও গাড়ি ঠিক করলাম। এসব কাজে রাখী খুব এক্সপার্ট।
বেশ রাত অবধি রেস্টুরেন্টগুলোতে বেজে চলেছে গান। শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
চনমনে সকাল, হালকা রোদ। রাতে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে। ভেজা রাস্তা আর গাছগাছালির সতেজতা দেখে তাই মনে হলো। সকালে স্নান সেরে গেলাম নাশতা খেতে। বুকিং অনুযায়ী সকালের খাবার ফ্রি। আমরা রেডি হয়ে একেবারে নিচে চলে গেলাম। টেবিলের ওপর স্তরে স্তরে সাজানো নানা রকম খাবার। যার যা খুশি নিতে পারে। অসংখ্য ফরেন ট্যুরিস্ট, তারাও তাদের পছন্দমতো খাবার নিচ্ছে। আমাদের খাবারের তালিকায় রেখেছিলাম ওখানকার ট্র্যাডিশনাল পদ। বিশেষ করে ফল আর স্যালাদ।
খাবার শেষে নির্ধারিত ভাড়া করা গাড়িতে উঠলাম। প্রথমেই গেলাম বালির ট্র্যাডিশনাল ব্যারং থিয়েটারে নাটক দেখতে।
বালিতে টাকার হিসাব হয় লাখে। ভ্যাবাচেকা খাওয়ার মতো ব্যাপার। এক জোড়া জুতা কিনলেও লাখ টাকা। খুব আয়েশ করে নাটকের টিকিট কিনলাম লাখ টাকা দিয়ে। শুরুতেই লিফলেট দিল। তাতে ইংরেজিতে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেওয়া আছে। প্রাচীন লোকগল্প। কলাকুশলীদের পোশাক আর মুখোশ দেখেই বোঝা গেল। যতটা উৎসাহ নিয়ে নাটক দেখতে বসেছিলাম, এক ঘণ্টা পর তা আর থাকল না। দীর্ঘ সময়ের কারণে অনেকটা একঘেয়ে লাগল। যাহোক, ওখান থেকে বেরিয়ে রওনা দিলাম জীবন্ত আগ্নেয়গিরি দেখতে। বালি থেকে বেশ দূর।
জায়গাটার নাম কিন্তামানি। বালির গুরুত্বপূর্ণ ট্যুরিস্ট স্পট। যেতে যেতে দেখলাম ছিমছাম শহর, লোকসমাগম তেমন নেই। মনে হচ্ছিল মফস্বল। রাস্তার দুপাশে নারকেল পাতা দিয়ে বানানো নানা রকমের মনোজ্ঞ শিল্পকর্ম। সারি সারি সাজানো। প্রায় প্রতিটা বাড়ির সামনে সাদাকালো চেক কাপড়ে মোড়ানো বেদি। ইন্দোনেশিয়া মুসলিমপ্রধান দেশ হলেও বালিতে হিন্দু বেশি।
কিন্তামানি পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় দেড়টা বেজে গেল। সূর্য ঠিক মাথার ওপর। কিন্তু রোদের তেমন তেজ নেই। তবু একটা গুমোট ভাব। চারদিকে উঁচু-নিচু পাহাড়। ঢাল ঘেঁষে নিচে নামলাম। ড্রাইভারই আমাদের গাইড। ভালো ইংরেজি জানে। গাড়িতে তার পাশের সিটে বসে এসেছি। সারা রাস্তা বালি সম্পর্কে জেনেছি। তখন সেখানে উৎসব চলছিল। কিন্তামানি পৌঁছে উৎসবের তেমন কিছু চোখে পড়েনি। পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে রেলিং করা। এরপর আর যাওয়া যায় না। দেখলাম বিরাট এলাকাজুড়ে ত্রিকোণা ‘চুল্লি’ বসানো। ১ হাজার ৭০০ মিটার উঁচু চুল্লি। হালকা কুয়াশার মতো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। পাহাড় বেয়ে ছড়িয়ে থাকা শীতল লাভা। মাউন্টের পাদদেশে আছে বালির সর্ববৃহৎ প্রাকৃতিক লেক বাতুর। পাহাড় থেকে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখার জন্য রয়েছে রেলিং দেওয়া বসার জায়গা।
গাইড বলল, ছয় বছর আগে একবার উদ্গিরণ হয়েছিল। আবার নাকি যেকোনো সময় হতে পারে। শুনে ভয় লাগছিল। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি জেগে উঠবে। জিজ্ঞেস করলাম, উদ্গিরণ হলে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জানাল, তখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। এখানকার লোকজনকে ত্রাণকেন্দ্রে সরিয়ে নেয়। সব ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়। দূষিত গ্যাস, ছাই ছড়িয়ে পড়ে।
আমরা ব্যারিকেড পর্যন্ত গেলাম। দেখে মনেও হলো না, যেকোনো সময় ভয়ংকর কিছু ঘটে যেতে পারে। পর্যটকদের জন্য সারে সারে বসেছে দোকানপাট। অল্পস্বল্প ট্র্যাডিশনাল জিনিসপত্র কিনলাম। নানা জাতের স্থানীয় ফল নিয়ে পসরা বসেছে। কিছু খেলাম, কিছু সঙ্গে নিয়ে নিলাম হোটেলে খাব বলে। ফেরার পথে নজরে পড়ার মতো ছিল স্ট্যাচু। বিভিন্ন রকম পাথর কেটে বানানো সেসব। ড্রাইভার বলল, বালির অর্থনীতিতে স্থানীয় স্ট্যাচু বড় ভূমিকা রাখে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এগুলো এক্সপোর্ট হয়। এক জায়গায় নেমে আমরা দেখলাম, টুকিটাকি জিনিস কিনলাম। যেমন ফটোফ্রেম, ছোট ছোট শোপিস ইত্যাদি।
এবার গন্তব্য মাংকি ফরেস্ট সাংচুয়ারি, উবুদ টেম্পল, উবুদ রাইস টেরেইস। ঝিরঝির হাওয়া, হালকা বৃষ্টি, ওয়েদার গ্লুমি। বালিতে দুটি ঋতু- গ্রীষ্ম ও বর্ষা। এখানে নাকি শীত নেই। বেলা তিনটার কাছাকাছি। আমরা মাংকি ফরেস্টের দিকে যত এগোচ্ছি, তত বৃষ্টির চাপ বাড়ছে। তখন জুন মাস। বৃষ্টির প্রকোপ বেশি। নিয়ম অনুযায়ী বর্ষাকাল। মাংকি ফরেস্টে পৌঁছে ঝমঝম বৃষ্টি পেলাম। গাড়ি থেকে নেমে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে উঠলাম। জায়গাটা ফরেস্টেরই। অনেকটা বাংলো টাইপের বাড়ি। ছিমছাম, গোছানো। সবুজের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পিচ ঢালা পথ। বৃষ্টির তখন তুমুল দশা। ভেতরে গিয়ে মাংকি দেখা সম্ভব নয়। তা ছাড়া বানরগুলো বৃষ্টির মধ্যে গাছ থেকে নামে না। রাখীর ইচ্ছে ছিল সাইকেলে চড়ে ফরেস্ট ঘুরবে, কিন্তু সে সম্ভাবনা নেই। দূর থেকে দেখেই তৃপ্তি মেটাচ্ছি।
ঘন সবুজ বন, বৃষ্টির জল পেয়ে যেন চকচক করে উঠছে। ড্রাইভারের ছাতা নিয়ে আমরা কয়েকটা ছবি তুললাম। বনে ঢোকার মুখে বিচিত্র স্ট্যাচু। গাড়িতে উঠে টেম্পলের দিকে রওনা দিলাম, তখন বৃষ্টি কিছুটা কমে এসেছে। প্রতিটা দর্শনীয় স্থানের জন্য আলাদা টিকিট। উবুদ টেম্পল বাইরে থেকেই দেখা যায় বেশ। তাই ভেতরে না ঢুকে বাইরে থেকে দেখেই চলে এসেছি। সুনিপুণ কারুকাজ আর সুউচ্চ চূড়ায় আলাদা মাত্রা প্রকাশ পেয়েছে। গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা দিলাম উবুদ রাইস টেরেইসের দিকে। ধানখেত দেখার কী আর আছে! ড্রাইভার বলল, পর্যটকেরা এটা না দেখে যায় না। নেটে আমরাও দেখে নিয়েছিলাম। স্বচক্ষে দেখতে পিছপা হলাম না। ততক্ষণে বৃষ্টিও থেমে গেছে। বাতাসের আর্দ্রতা শরীর-মনে ঠান্ডা শিহরণ তুলল। যা দেখছি তা-ই ভালো লাগছে। কিন্তামানি থেকে কিনে আনা ফল একটা-দুটো করে টেস্ট করেছি। সঙ্গে বিস্কুট-কলা খেয়ে বেশ চাঙা। দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম রাইস টেরেইসে। রাস্তা থেকে বেশ নিচে। পাশে দাঁড়িয়ে এবারও দেখে নিলাম মনোজ্ঞ দৃশ্য। ছোট ছোট টিলার ওপর আল তুলে সাজানো ক্ষেত্রফল, পাশে হাঁটার রাস্তা। আমরা বাঙালি বলেই ধানখেতে নামার ইচ্ছে হলো না। ফরেন ট্যুরিস্টরা আমাদের চেয়ে খুবই উদ্যমী। তারা ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। আমরা না নামলেও চোখ জুড়ালাম সবুজের গহনে।
বেলা প্রায় পড়ে এলো। বৃষ্টি আমাদের ভ্রমণে বিঘ্ন ঘটিয়ে দিয়েছে। মাংকি ফরেস্ট না দেখার বেদনা কেবলই তাড়িত করছে। মনকে শান্ত করতে উবুদের শপিং মলে ঢুকলাম। বালির বাটিক খুব বিখ্যাত। প্রিয়জনদের জন্য কেনার চেষ্টা করলাম। জান্নাত আপা, আমি, রাখী- তিনজনই টুকটাক কিনলাম। কিছুটা ভালো লাগা কিছুটা মন্দ লাগা নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতের কুতা বিচ দেখব, তারপর ডিনার সেরে রুমে ফিরব। যখন বিচে গেলাম তখন জায়গাটি প্রায় নির্জন। কিন্তু কোনো ভয় লাগেনি, বরং আমার ভেতর রবীন্দ্রসংগীত বেশ গুনগুন করে উঠল। মনে পড়ল তাসের দেশের সেই বিখ্যাত লাইন-
‘এলেম নতুন দেশে,
তলায় গেল ভগ্নতরী
কূলে এলেম ভেসে’
মনে হয় তখন অমাবস্যা আকাশজুড়ে। যদিও জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্ররাজি। সমুদ্রের গর্জন আর গানের ভাষা চিনে নিল একে অপরকে। [চলবে]
ছবি: লেখক