skip to Main Content

এডিটরস কলাম I ভাষার সুরক্ষা ও বিকাশ

জন্মসূত্রেই ভাষাটি সে পেয়ে থাকে। তা রক্ষা, পরিচর্যা ও বিকাশের দায়িত্ব যেমন ভাষাভাষীদের, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়

পৃথিবীতে ৬ হাজার ৭০০ ভাষা টিকে আছে। চলতি শতকে এগুলোর অর্ধেক হারিয়ে যেতে পারে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক সোসাইটির মতে, প্রতি চৌদ্দ দিনে একটি ভাষার মৃত্যু ঘটছে। এসব তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে, ভাষার সংখ্যা কমছে পৃথিবীতে; যদিও মানুষ বাড়ছে। এই বিপরীত চিত্রের কারণ কী? প্রথমত, ভাষাভিত্তিক উগ্র জাতীয়তাবাদের চাপ; দ্বিতীয়ত, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ব্যবহার্য ভাষার প্রতি রাষ্ট্রীয় উদাসীনতা কিংবা উপেক্ষা। তৃতীয়ত, বিলুপ্তির শঙ্কা আছে এমন ভাষাগুলোর স্বতন্ত্র কোনো লিখিত রূপ অর্থাৎ বর্ণমালা না থাকা ইত্যাদি। তবে নিজের ভাষায় কথা বলা ও লিখতে পারা মানুষের মৌলিক সাংস্কৃতিক অধিকার। কেননা, জন্মসূত্রেই ভাষাটি সে পেয়ে থাকে। তা রক্ষা, পরিচর্যা ও বিকাশের দায়িত্ব যেমন ভাষাভাষীদের, তেমনি সমাজ ও রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়।

দুই
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভাষা টিকে গেলেও তা যে পরিপূর্ণ রূপে অক্ষত ও বিকশিত হতে পারে, এমনটি নয়। সেটি বিকৃত হতে পারে, আংশিকতায় পর্যুদস্ত হওয়ার ঝুঁকিও থাকে। ফলে বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা এড়ানো যায় না। আমরা ভাবছি, বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই ভূখন্ডে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বীজ অঙ্কুরিত হয়, যা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পল্লবিত হয়েছে, কিন্তু যে ব্যবস্থায় ভাষা শুদ্ধ ও সুশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে, তা এখনো গড়ে ওঠেনি। প্রসঙ্গত, বাংলা ভাষার নিজস্ব ও পূর্ণাঙ্গ কোনো ব্যাকরণ নেই, যা আছে তা সংস্কৃত ও ইংরেজির মিশ্রিত অনুকরণে রচিত কিছু সূত্র; যেগুলো পরীক্ষা পাসের উপায় হিসেবে শিক্ষার্থীদের মুখস্থ করানো হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় তা-ও যথাযথভাবে শেখানো হয় না। উদাহরণস্বরূপ ইংল্যান্ডের সাত বছরের শিশু নির্ভুলভাবে তার নিজের ভাষায় লিখতে এবং বলতে পারলেও বাংলাদেশের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, যে জ্ঞানকান্ডেরই হোন না কেন, তাদের বিপুল-অধিকাংশ সঠিক ও শুদ্ধভাবে বাংলা বাক্য বলতে ও লিখতে প্রায়শ ব্যর্থ হন।
আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা এই ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, কারিগরি, বাণিজ্যবিদ্যা কিংবা বিজ্ঞানশিক্ষার জন্য ভাষাচর্চার কোনো প্রয়োজন নেই। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বিশ্বখ্যাত প্রযুক্তিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমআইটিতে (ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) পড়ানো হয় ভাষাতত্ত্ব। সেখানকার শিক্ষক নোম চমস্কি, যিনি পৃথিবীর বিখ্যাত ভাষাদার্শনিক।
দেখা যায়, পাশ্চাত্যের একজন ফ্যাশন ডিজাইনার বা বাজার ব্যবস্থাপক দর্শন, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি সম্পর্কে যেমন জ্ঞান রাখেন, তেমনি ভাষায়ও রয়েছে সমান দক্ষতা। বিশ্বের জ্ঞানজগৎ থেকে আমাদের পিছিয়ে পড়ার কারণ কি ভাষার শক্তি সম্পর্কে অজ্ঞতা? নইলে বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীদের মধ্যে এত অপারগতা ও নৈরাজ্য কেন? কেবল ফেব্রুয়ারি এলে কেন আমরা সর্বস্তরে বাংলা চালুর জন্য মরিয়া হয়ে যাই? প্রশ্নগুলো সুধী মহলের কাছে রাখতে চাই।

তিন
এই সব ভাবনা ও বাস্তবতা থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক, শুধু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা যে বিপন্ন হতে পারে, এমন নয়; বিপুল জনসংখ্যার ভাষাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। কেননা, পরিশুদ্ধ ও সুশৃঙ্খল চর্চার মাধ্যমে ভাষার সমৃদ্ধি ঘটানো সম্ভব না হলে বা বিকৃতি এড়ানো না গেলে তা-ও একধরনের বিপন্নতা। বিলুপ্ত ভাষার মতোই বিকৃত ভাষার অস্তিত্বও নিরর্থক। অধিকন্তু ব্যবহারকারীর সংখ্যা যত বিপুল হোক, সে ভাষার যদি নিজস্ব ও পূর্ণাঙ্গ কোনো ব্যাকরণ না থাকে, তা অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে এবং নানামুখী চাপে তার সত্তা হারিয়ে যেতে থাকে। উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, বাংলা ভাষায় নির্বিচারে বিদেশি শব্দ যোগ করা হচ্ছে। যেগুলোর একাধিক বিকল্প আছে বাংলায়। না থাকলেও তার সমার্থক বাংলা শব্দ সৃষ্টি করা আমাদের দায়িত্ব। বলতে হয়, বাইরে থেকে আমদানি করা এসব শব্দ ব্যবহারে আমরা কী প্রমাণ করতে চাইছি?
উল্লেখ্য, অনেক বিজ্ঞ ব্যক্তিকে দেখেছি, যারা বাংলায় কথা বলার সময় একটি বিদেশি শব্দও ব্যবহার করেন না। অথচ তারা নিজের ভাষা ছাড়াও দু-তিনটি ভাষায় সুপন্ডিত। প্রযুক্তির বিকাশ বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, নতুন শব্দের আবির্ভাব ঘটলে তার নিজস্ব প্রতিশব্দ সৃষ্টি করা দরকার। ভাষার বিকাশ ও সমৃদ্ধি এভাবেই ঘটে।

ইলাস্ট্রেশন: দিদারুল দিপু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top