skip to Main Content

স্বাদশেকড় I ঘৃতকথা

পৌরাণিক সময় থেকে এর কদর। ভোজ এবং যজ্ঞ- দুটোতেই

ধার করে হলেও ঘি খাও, চার্বাকের এই বক্তব্য প্রমাণ করে, এটি খাবারের জগতে কতটা কুলীন। সে কারণে মিটফোর্ডের ভেজাল মার্কেটে খোঁজ করলে ঘিয়ের ফ্লেভারও মিলবে। মধ্যবিত্ত বাঙালি থেকে খাদ্য ব্যবসায়ী- অনেকেই এখানকার ঘিয়ের গন্ধের খদ্দের।
ভারতীয় উপমহাদেশে এর প্রথম উল্লেখ পাই বেদের মন্ত্রগুলোয়। সেখানেই পাওয়া যায়- যিশুর জন্মের ১৫০০ বছর আগে থেকে আর্যরা ঘি খেত। অস্বাভাবিক নয় অবশ্য, পশুচারণের জীবনে এই দ্রব্য তাদের কাছে সহজলভ্যই ছিল। আর্যধর্মে ঘি বিশুদ্ধ আর শুভ। এ কারণে যেকোনো রান্নায় এর প্রাচুর্য দেখা যেত প্রাচীনকালে। মালপোয়ার মতো একধরনের পিঠার বর্ণনাও রয়েছে ঋগে¦দে, যবের আটার সঙ্গে গুড় বা মধুর মিশ্রণ তৈরি করে তা ছেড়ে দেওয়া হতো ঘি-ভর্তি কড়াইয়ে। আবার খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দের ভেতরে লেখা ধর্মসূত্রাবলিতে উল্লেখ রয়েছে ঘিয়ে ভাজা বটাকার (বড়া)। অষ্টম শতাব্দীতে নাকি এই দ্রব্যের ঘনতম অংশটিকে বলা হতো মন্ডম, যা বিভিন্ন মিষ্টি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো। ঘি পছন্দ ছিল গৌতম বুদ্ধেরও- লিখিত রয়েছে লঙ্কাবতারসূত্রে।
কেবল আর্যরা নয়, দক্ষিণ ভারতেও চল ছিল ঘিয়ের। সিন্ধু সভ্যতায় এর ব্যবহার হতো বলে জানা গেছে। তর্ক সাপেক্ষে আরও পুরোনো সভ্যতা, যাকে সরস্বতী সভ্যতা বলে দাবি করছেন ভারতের কট্টর জাতীয়তাবাদীরা, সেখানেও ঘিয়ের চল ছিল। দক্ষিণ ভারতে প্রাচীন যুগের ভাত রান্নার এক তরিকায় বলা হয়েছে, চাল, ডাল, চর্বিযুক্ত মাংস আর ঘি দিয়ে তৈরি হতো পোঙ্গাল। রন্ধনসূত্রে যা খিচুড়ির জ্ঞাতি। দক্ষিণ ভারত থেকে প্রাচীন রোমে চামড়ার ঝোলায় করে যেত এই দ্রব্য, সেখানকার বাজারে তা চড়া দামে বিকোত বাটারইন নামে। ক্রেতা ছিল সম্ভ্রান্ত লোকেরা, যারা রান্নায় আর যজ্ঞের কাজে এটা ব্যবহার করতেন। পেরুম পানুরু থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে দক্ষিণ ভারতে একজন নারীর কাছে স্বর্ণের চেয়েও মূল্যবান ছিল গাই-গরু বা মাদি-মহিষ। কারণ, এগুলোর দুধ থেকে তৈরি হওয়া ঘোল আর ঘিয়ের বিনিময়েই পাওয়া যেত চাল।
সুশ্রুত ও চরক সংহিতায় অনেকবার ঘিয়ের উল্লেখ রয়েছে। কয়লার আঁচে শূল্যপক্ব করার সময়ে মাংসের কিমার গোলকে মাঝেমধ্যে এই পদার্থের প্রলেপ দেওয়া হতো। ভেস-বড়া বানানোর প্রক্রিয়ায় মাংস প্রথমে পানিতে সেদ্ধ করে তা পাটায় পেষা হতো ঘি, লবণ, গুড়, গোলমরিচ আর আদা দিয়ে। তারপর সেটা আবার বড়ার মতো করেই ঘিয়ে ভাজা হতো। প্রাচীন ভারতীয় চিকিৎসাশাস্ত্রের দুটো বই- সুশ্রুত সংহিতা লেখা হয়েছিল খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে, আর চরক সংহিতা অবশ্য এক বা দুই শতাব্দী পরে। চরকে ঘি ও অন্যান্য জমানো চর্বিকে বলা হয়েছে শরীরের জন্য উত্তেজক- গরম হিসেবে। অন্যদিকে সরিষা আর তিলের তেলকে উল্লেখ করা হয়েছে শীতলকারক বা ঠান্ডা বলে।
চরক সংহিতার কথা মেনে নিলে ৩০০-৫০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে রান্নার মাধ্যম হিসেবে ঘিয়ের ব্যবহারে সংযত হয় অনেকে। সেখানে শরৎকালে ঘি, বসন্তে প্রাণিজ চর্বি, বর্ষায় নিরামিষ উৎস থেকে পাওয়া তেল আর সব সময়ের জন্য তিলের তেল ওষুধ তৈরি, রান্না ও ভাজার কাজে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। তবে দৈনিক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, মঙ্গলকাব্যের বর্ণনায় আছে শিবের মেজাজ বরাবরই চড়া, রাগী, উগ্র। তাই তার সামনে ঘিয়ের তৈরি খাবার পরিবেশন করা হতো না। তার জন্য থাকত সরিষার তেলে রাঁধা খাবার। চরক থেকেই জানা যায়, গরুর ঘি, বিশেষত কালো গাইয়ের দুধ থেকে পাওয়া এই দ্রব্য সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, অন্যদিকে ভেড়ার দুধ থেকে প্রাপ্ত ঘি সবচেয়ে নিকৃষ্ট। চরক সংহিতা থেকেই জানা যায় ‘ম্যাচিউরড ইন ক্লে-পট’ ঘি এর কথাও! মাটির পাত্রে তা এমনভাবে সংরক্ষণ করা হতো, যা এক শ বছরের বেশি সময় অবিকৃত থাকত। একাদশ থেকে শতবর্ষী ঘিয়ের নাম ছিল কুম্ভঘৃত, আর সেঞ্চুরি পার করা ঘিকে মহাঘৃত।
সুশ্রুত আর চরক থেকে জানা যায় সম্যব, ঘৃতপুর, পুপালিকা, উৎরিকা, বর্তিকা ইত্যাদি মিষ্টান্নের নাম, যেগুলো তৈরিতে কোনো না কোনোভাবে ঘিয়ের অবদান আছে।
মহাভারতেও এর বর্ণনা রয়েছে। রাজা যুধিষ্ঠির দশ হাজার ব্রাহ্মণ ভোজন করিয়েছিলেন বরাহ আর মৃগ দিয়ে। সঙ্গে ছিল দুধ, চাল, ঘি, মধু এবং ফল আর শিকড়-বাকড় দিয়ে তৈরি খাবার। মহাভারতে একটি বনভোজনের খাবারের তালিকাতেও আছে কচি মহিষের শূল্যপক্ব মাংসে ঘি ঢেলে তা পোড়ানোর কথা। আবার ভাজাও হয়েছিল খানিক। রামায়ণে সীতারও নাকি প্রিয় ছিল ঘি দিয়ে পোড়ানো শিকে গাঁথা হরিণের মাংস।
১১৩০ সালের দিকে লেখা মানসোল্লাস থেকে মধ্য ভারতের রাজা আর অভিজাতদের খাবারের কথা জানা যায়। তখন দরবারি রুটি, মান্ডা ও খামির বানাতে প্রয়োজন হতো ঘিয়ের। মিষ্টির তালিকায় দেখা মেলে গোলাকৃতির কাসার, খাজ্জাক (খাজা) আর ঘৃতপুরার। ১৬০০ সালে আন্নাজির লেখায় রয়েছে গৃহস্থ বাড়ির খাবারের বিবরণ- অন্য অনেক খাবারের সঙ্গে পেয়ালা ভর্র্তি করে দেওয়া হতো অম্বরের মতো দেখতে সদ্য প্রস্তুত ঘি আর ঘন ঘি- দুটোই। তার বর্ণনাতেই অতিরসা আর অবতাতু গারিগি নামের দুটি মিষ্টান্নেরও বিবরণ মেলে, যার গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ এটি। মধ্যযুগে উত্তর ভারতীয় এক রুটি চিরাত্তিও ঘিয়ে ভেজে চিনির প্রলেপ মাখিয়ে বসে থাকে কারোর পেটে পড়ার অপেক্ষায়।
ঘিয়ের প্রসঙ্গ এলে দিল্লি দরবারের কথাই-বা বাদ যায় কেন? মুহাম্মাদ বিন তুঘলকের আমলে দিল্লির কাজী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইবনে বতুতা দরবারে এতে ভাজতে দেখেছিলেন শিঙাড়া। আর অন্য খাবারে শুদ্ধ ঘিই তো ছিল। মোগল দরবারের প্রসঙ্গে তার ক্ষয়িষ্ণু সময়ে জেগে ওঠা লক্ষেèৗর কথাও আসে। এখানকার মিষ্টি ঘিয়ের বেশ কদর ছিল একসময়। অযোধ্যার প্রথম ‘বাদশা’ গাজীউদ্দিন হায়দারের পরোটাপ্রীতিতেও রয়েছে এই দ্রব্য- বাবুর্চি প্রতিদিন ছয়টা পরোটা বানাতেন তার জন্য, এতে প্রয়োজন হতো ৩০ সের ঘি! আমাদের চেনাজানা পরোটা তাওয়ার রুটিতে ঘিয়ের পুর এবং তাতে পাট ও পরত দিয়ে ভাজার কৌশল লক্ষেèৗর বাবুর্চিদের গবেষণার ফসল। মেটিয়াবুরুজে নির্বাসনে বিখ্যাত ওয়াজিদ আলী শাহের পর রইসজাদা মুনশী উস্সুলতান বাহাদুরের জন্য পাপড়ি সোহন হালুয়া বানাতে এক সের সুজিতে চল্লিশ সের ঘি প্রয়োজন হতো।
বাংলায়ও এর কদর রয়েছে। আলুভর্তা, গরম ভাত আর ঘি হলে বাঙালির পেটপূজা ভালো হয়। তবে তারা ঘিয়ের ব্যাপারে অনেকটা উদার। ভেজাল রাসায়নিক ঘি হলেও তার চলে। রূপকথার একটা সময়ে, মানে গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু আর পুকুর ভরা মাছ ছিল, তখন প্রতিটা বাঙালি গেরস্থঘরের নারীরাই দুধের সর সঞ্চয় করে তা জ¦াল দিয়ে তৈরি করত ঘি। দুধের মান আর জ¦াল দেওয়ার সময়ের ওপর নির্ভরশীল ছিল এর স্বাদ ও গুণগত বৈশিষ্ট্য।
গ্রামের বউভাত বা সনাতনি বিয়ের অনুষ্ঠানে নতুন বউ অতিথিদের ঘি ভাত খেতে দেয়। আর আমিষ-নিরামিষ রান্নায় এর চল তো রয়েছেই। পোলাও, ফ্রায়েড রাইস থেকে বিরিয়ানি বা জর্দায়ও পড়ে এই দ্রব্যের ছোঁয়া। একদা ঘি ছাড়া লুচি ভাজার কথা চিন্তা করা যেত না। রামনারায়ণ তর্কালঙ্কার কুলীনকুলসর্বস্বতে লিখেছেন, ‘ঘিয়ে ভাজা তপ্ত লুচি, দুচারি আদার কুচি/ কচুরি তাহাতে খান দুই।’ প্রাকৃত পৈঙ্গলে ঘিয়ের উদ্ধৃতির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, ‘কলাপাতায় গাওয়া ঘি সহযোগে সফেন ভাত’। শান্তিপুরে শ্রীচৈতন্যকে দেওয়া হয়েছিল ‘মধ্যে পীত ঘৃত সিক্ত শ্যাল্যন্নের স্তূপ’- এই দ্রব্যের পরিমাণ এতই বেশি ছিল যে ‘চারিদিকে পাতে ঘৃত বহিয়া চলিল’। মধ্যযুগে শাক রান্নায়ও ঘি ব্যবহার করা হতো। মনসামঙ্গলে (বিজয়গুপ্ত) পাই ‘সাজা ঘৃত দিয়ে রান্ধে গিমা তিতা শাক’। আরেক মনসামঙ্গলে (দ্বিজবংশী দাস) দেখি ‘কাঁটালের বীজগুলি ভাজিলেক ঘৃতে তুলি’ বা ‘নিরামিষ রান্ধে সব ঘৃতে সম্ভারিয়া’ আর ‘ঘৃতে ভাজে নিমপাত’। তবে স্বাস্থ্যসচেতন বাঙালি অন্য সব তেলের সঙ্গে ঘিও বিসর্জন দিয়েছে অনেকখানিই।
 আল মারুফ রাসেল
ছবি: ইন্টারনেট
তথ্যসূত্র
ইন্ডিয়ান ফুড: আ হিস্ট্রিক্যাল কম্প্যানিয়ন, কে টি আচার্য্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top