skip to Main Content

রসনাবিলাস I রবীন্দ্রপ্রাঙ্গণে

চমকপ্রদ মেনু আর নজরকাড়া ইন্টেরিয়রের রাবীন্দ্রিক আবহে এক টুকরো অবসর। মজাদার খাদ্যসহযোগে চারপাশে রবীন্দ্রনাথ

বনানীর এক বাড়ির ছাদে গড়ে উঠেছে টেগোর টেরাস। কাচের ওপারে বিশাল গাছের নিচে রবীন্দ্রনাথের ভাস্কর্য, সেটার চারদিক সবুজে ঘেরা আড্ডার জায়গা। ডানে ঘুরে ভেতরে ঢোকার দরজা, বাংলার দারুশিল্পের চমৎকার এক নিদর্শন। কাঠখোদাই লতাপাতার নকশা। পরিচ্ছন্ন। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকা যায়। সেখানে তো বিস্ময় অন্তহীন। প্রথমেই হাতের ডানে চোখে পড়ে থরে থরে সাজানো কাপ, রবীন্দ্রসংগীতের অডিও সিডি, কাঠের মুখোশ, সাবেকি ঘরানার ঘড়ি- যেটা এখনো ঠিকঠাক সময় জানিয়ে চলেছে। রয়েছে দোতারা, অ্যান্থুরিয়াম গাছ। এসব পেরিয়ে কফি কাউন্টার।
ঘরের মাঝখানে আছে রবীন্দ্রনাথ-সম্পর্কিত বই। বাংলা ও ইংরেজি- দুই ভাষাতেই। তার ওপরে দোতারায় চমৎকারভাবে খোদিত রয়েছে বুদ্ধ। সেখানে ঝুলছে মানিপ্ল্যান্ট আর লাকি ব্যাম্বু। মাঝের এই শেলফকে কেন্দ্র করেই চারপাশে বসার আয়োজন। একদম মাথায় রয়েছে বেশ বড় জলরঙে আঁকা রবীন্দ্রনাথ, ঠিক দেয়ালের মধ্যিখানে। দুপাশে জানালার মতো গড়ন দেওয়া হয়েছে। সেখানেও খানিকটা সবুজের ছোঁয়া দিতে রাখা হয়েছে ফিলোডেন্ড্রন, দুপাশেই, রবীন্দ্রনাথের পেইন্টিংয়ের ঠিক নিচে। সেখানেই আয়েশ করে বসার ব্যবস্থা। কুশন ব্যবহার করা হয়েছে। এক পাশে শেলফে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন বই। টিভিতে চলছিল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে নির্মিত এক তথ্যচিত্র। মোদ্দা কথা, পুরো ফ্লোরটাই যেন রবীন্দ্রময়। আশপাশে আকাশ ছুঁতে চাওয়া বাড়ি না থাকায় কাচের দেয়াল চুইয়ে আলোর আগমন অবারিত। আলোর তীব্রতা এড়াতে রয়েছে চাটাইয়ের পর্দা। কানে রবীন্দ্রসংগীত সুধা ঢেলে চলেছে। এক পাশে রয়েছে সেই আদ্যিকালের গ্রামোফোন আর ফিলিপসের বাই এমপ্লি রেডিও। পুরো এলাকাকে সংগ্রহশালা বললেও অত্যুক্তি হয় না।
ইতালীয়দের ঘোলা পানি; যার মার্কিন নাম আমেরিকানো, তাতে চুমুক দিতে দিতেই পুরো রেস্টুরেন্ট ভ্রমণ করা যায়। কফির ওপরে ভেসে থাকা ক্রেমা জানান দেয় এখানকার বারিস্তার দক্ষতা। এসপ্রেসো বা আমেরিকানোর ওপরে ভেসে থাকা ফোমের লেয়ারটার নামই কফি অভিধানে ক্রেমা, যা তৈরি হয় ফ্রেশ ফাইন গ্রাউনাড কফির সলিউবল অয়েল আর এয়ার বাবলের মিশ্রণে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই মনে হলো, রবীন্দ্রনাথ কি কফি খেতেন? কল্পনার সুতো বেশি ছাড়তে হলো না, হঠাৎ করেই মাথায় খেলে গেল, কলকাতার ইন্ডিয়ান কফি হাউসে ছিল তার নিত্য আনাগোনা। কিছুক্ষণ পরেই এই হেঁসেলের প্রধান কারিগর অনন্ত সরকার জানালেন- দুপুরে পাতে কী নেব? জানালাম, যা দেবেন তা-ই সই। এরপর ক্ষণিকের অপেক্ষা, বইয়ে-সংগীতে খানিক বুঁদ হয়ে ছিলাম, ঘোর ভাঙল রেস্টুরেন্টকর্মীর হাতে আলুভাজা দেখে। পটেটো ওয়েজেস আর সঙ্গে সুইট চিলি সস। এখানকার পটেটো ওয়েজেসের স্বাদ খানিক আলাদা, একটু চটপটে আর ঝাল। তবে সুইট চিলি সসে ঝাল ব্যাপারটা স্বাদেন্দ্রিয়র সঙ্গে সমঝোতা করে নেয়।
এরপর এলো কর্ন অ্যান্ড বিন স্যালাড। লেটুস, শসা, টমেটো, ক্যাপসিকাম, পেঁয়াজের সঙ্গে কর্ন আর রেড কিডনি বিন, সামান্য হার্বস আর অলিভ অয়েলে, স্বাস্থ্যসচেতনদের জন্য পারফেক্ট। খেতেও চমৎকার। এরপর এলো সেট মেনু। দুটো পরোটার সঙ্গে তড়কা ডাল, ভেজিটেবল আর বাটার চিকেন মাসালা। বলা যায় পুরো মেনুটাই উত্তর ভারতীয়, আর এর আগের স্যালাড কন্টিনেন্টাল, পটেটো ওয়েজেস তো মার্কিন পতাকা গায়ে জড়িয়ে রেখেছে জন্মসূত্রে। বলে রাখা ভালো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনে কম ভ্রমণ করেননি, ভোজনরসিকও ছিলেন। জোড়াসাঁকোর হেঁসেলঘরে ভালো ভালো খাবার রান্না তো হতোই। পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের লেখনীতেও জোড়াসাঁকোর পেছনবাড়ির কুকিং ক্লাবের খোঁজ পাওয়া যায়, যেখানে দেশ-বিদেশের রেসিপি নিয়ে রীতিমতো গবেষণা হতো। তাই রবি-প্রাঙ্গণে যে খাবারের বৈচিত্র্য থাকবে, তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
যাহোক, মেইন ডিশের ব্যাপারে ফেরত আসি, উত্তর ভারতীয়, বিশেষত দিল্লিরীতির তড়কা ডালের স্বাদ রীতিমতো দ্বিতীয়বার এখানে আসবার আগ্রহ তৈরি করবে। মসলাদার এই ডাল টেক্কা দিতে পারে যেকোনো আমিষ খাবারের সঙ্গে। সবজিটাও খেতে ভালো। তবে যদি বলতে হয় সেদিনের ভোজের তারকার কথা, সেটা বাটার চিকেন মাসালা বা মুর্গ মাখানি ছাড়া অন্য কিছু নয়। অথচ অনেকেই জানেন না, এই খাবারের ইতিহাস ৭৫ বছরের কাছাকাছি। দেশভাগের বেদনা জড়িয়েও এই খাবার এত সুস্বাদু। ভারত বিভাগের পর পেশোয়ারের মুখে দা ধাবা থেকে দিল্লির মোতি মহলে আসা এই খাবারের ইতিহাসও মজার। রসবতীতে কাজের তাড়াহুড়োয় বেঁচে থাকা কিছু মুরগির টুকরো পড়ে যায় টমেটো, মাখন আর ক্রিমের গ্রেভিতে। তারপর সেই মুরগি এবং গ্রেভি থেকে উঠতে পারেনি, ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীময়, পেয়েছে কূটনৈতিক খাবারের মর্যাদাও- ইন্দিরা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, ফিরোজ গান্ধী- সবাই ছিলেন মোতি মহলের এই খাবারের ভক্ত। তাই ইন্দিরা গান্ধীর সিমলা চুক্তির খাবারের সরবরাহকারী হিসেবে পাওয়া যায় মোতি মহল আর খাবারের তালিকায় থাকা মুর্গ মাখানি। ফিরোজ গান্ধী তার দুই ছেলে- রাজীব ও সঞ্জয় গান্ধীকে নিয়ে নিয়মিত যেতেন এই খাবার খেতে। হোমি জাহাঙ্গীর ভব, বিজয় লক্ষ্মী পন্ডিত, ড. জাকির হোসেন, রাজ কাপুর, মোহন সিং ওবেরয়ের মতো মানুষেরাও যেতেন এই খাবারের আকর্ষণে। টেগোর টেরাসে বসে সেই দিনের স্মৃতি আরও একবার উঁকি দিয়ে যায়। স্বাদে-গন্ধে খুব একটা বেশি ফারাক নেই।
টেগোর টেরাসের খাবারের তালিকা বিশাল, মেনু ভাগ করা হয়েছে পানীয়, খাবার, শেষপাতের মিষ্টিমুখ আর প্রাতরাশ দিয়ে। তবে প্রাতরাশ কেবল শুক্রবারের জন্য। বিস্তারিত জানা যাবে তাদের ফেসবুক আর ওয়েবসাইট ঘাঁটলেই।
ফেসবুক: www.facebook.com/tagoreterrace
ওয়েব: www.delvistaa.com/tagoreterrace
ঠিকানা: টেগোর ট্যারাস (রবি প্রাঙ্গণ), বাড়ি ৪৪, সড়ক ১২, ব্লক ই, বনানী, ঢাকা ১২১৩।
 আল মারুফ রাসেল
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top