skip to Main Content

কভারস্টোরি I পোশাকের ভাষা

কেবল শরীর আবৃত করার মধ্য দিয়ে পোশাকের মর্ম নিঃশেষিত নয়। এর রয়েছে নানা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের প্রণোদনা। পবিত্রতা, দেশপ্রেম, প্রতিবাদ- এমন সামূহিক নীরব উচ্চারণেও এটি প্রকাশিত। ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি, অবস্থান, মূল্যবোধ পরিধেয় এসবও বুঝিয়ে দেয়। লিখেছেন শেখ সাইফুর রহমান

‘Clothes make the man. Naked people have little or no influence on society.’
―Mark Twain

দৃশ্যপট ১
আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের অভিষেক অনুষ্ঠান। সস্ত্রীক জো বাইডেন এবং সপতি কমলা হ্যারিস ২০ জানুয়ারি একাধিক অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের পোশাক ছিল অনুষ্ঠান উপযোগী। তা কেবল ফ্যাশনেবল ডিজাইনার আউটফিট ছিল না; বরং ছিল মহামিলনের বার্তা।

দৃশ্যপট ২
একই অনুষ্ঠানে লেডি গাগার নীল ও লালের সংমিশ্রিত পোশাকের উপরি অংশে জলপাই শাখা মুখে একটি পায়রা বসানো; এরপর আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। একইভাবে জেনিফার লোপেজ ছিলেন আপাদমস্তক শুভ্রবসনা। সেখানেও ছিল বিশেষ বার্তা।

দৃশ্যপট ৩
ইউএসওপেন ২০২০। মহিলা এককে বিজয়ী নাওমি ওসাকা প্রতিদিন কোর্টে প্রবেশ করেছেন একই ধরনের মাস্ক পরে। প্রতিটি মুখাবরণ ছিল কালো রঙের। তার ওপর সাদা অক্ষরে লেখা নাম। একেক দিন একেকজনের নাম ছাপা থাকত। এই মাস্ক কেবল সংক্রামক অণুজীব প্রতিরোধের বর্ম নয়; বরং তিনি এটাকে আমেরিকা এবং বৃহদর্থে বিশ্বের বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসেবে উপস্থিত করেছেন।
এমন অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেখানে পোশাকের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে নানা মাত্রার ভাষা; যা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে, প্রাণিত ও একাত্ম করেছে।
উল্লেখ করা যায় উইলিয়াম শেকসপিয়ারের কথা: পোশাক বস্তুত একজন মানুষের অন্তরাত্মা। কারণ, এটি আত্মার মতোই নিরুচ্চার। তাই তো বলা হচ্ছে পোশাক হলো নীরব ভাষা; যার অর্থ বিশদ। এর নানা আকার ও আকৃতি, রং ও টেকশ্চারে সেই অর্থ প্রতীয়মান হয়। মানুষের মুখের ভাষার মতোই এর রয়েছে বৈচিত্র্য। স্থান ও পাত্রভেদে দৃশ্যমান ভিন্নতাও। তবে মুখের ভাষার সঙ্গে পোশাকের ভাষার পার্থক্য হলো, এটি সরাসরি বলা হয় না। উপস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশ কখনো কখনো ভুল-বোঝাবুঝিরও সৃষ্টি করে। সেটা অবশ্য আমাদের কথাবার্তায়ও হয়ে থাকে।
পোশাক ব্যক্তিমানুষের, কোনো জাতি বা গোষ্ঠীর সদস্যের ব্যক্তিপ্রকাশ যেমন ঘটায়, তেমনি তাতে তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, কৃষ্টি আর পরম্পরার উন্মোচনও ঘটে থাকে। এ জন্য পোশাককে দর্পণ বললেও অত্যুক্তি হয় না।
অনেক দেশে পোশাকের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে ধর্মীয় সংস্কৃতি আর ইতিহাসও। ফলে সেসব রাষ্ট্রে অন্য ধর্মাবলম্বীরা সেই সমাজের পোশাকের রীতি অনুসরণ করে থাকে। এমন উদাহরণ মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক দেশেই রয়েছে। আবার একটি অঞ্চলের কোনো জনগোষ্ঠীর বিশেষ পোশাক সেই দেশের অন্য জনগোষ্ঠী গ্রহণ করে। এমনকি সেই ভূমি থেকে নানা কারণে উন্মূল হলেও তাদের কাছে সেটি বিশেষ মর্যাদায় থেকে যায়। এমন উদাহরণ দেখা যায় ইরানের ইহুদিদের ক্ষেত্রে। ইরান ছেড়ে আসার পরও তারা হেরাতি চাদর ব্যবহার করে সমান যত্ন আর সম্মানের সঙ্গে।
পোশাক সমাজের শ্রেণির পরিচায়কও বটে। যেমন কলার ছাড়া উজ্জ্বল রঙের দামি কাপড়ের কোট বুখারা ও উজবেককিস্তানসহ ওই অঞ্চলের দেশে দেশে পরা হয়ে থাকে। এই কোট বা কালতাচাক একসময় ছিল ধনাঢ্য নারীর সসামাজিক মর্যাদার পরিচায়ক।
বস্তুত আমরা যে পোশাক পরে থাকি, তার মধ্য দিয়ে আমাদের ইতিহাস, পরিবেশ, স্বপ্ন, স্মৃতি, এমনকি আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। এই প্রসঙ্গেই বলা যায়, একজন মানুষের জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সব পোশাক এবং অনুষঙ্গ জমিয়ে রেখে দিলে তা হয়ে উঠবে তার আত্মজীবনী। ঠিক যেমন সুমনের গানের মতো ‘ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল/ঘাটের কাছে গল্প বলে নদীর জল’, তেমনি করে পোশাকও তো বলে আমাদের জীবনের গল্প। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, জয়-পরাজয়, অর্জন-ব্যর্থতার নকশায় পূর্ণ জীবনের সে জমিন; যা কাপড়ের মধ্য দিয়েও প্রকাশ পায়।
পোশাক আমাদের না বলা অনেক কথাও প্রকাশ করে। আবার সেটি দিয়ে শরীর আবৃত এবং অনাবৃত রাখা নিয়েও রয়েছে নানা ট্যাবু, বিভিন্ন বিতর্ক। তবে পোশাকের ওপর বিচিত্র সূচিকর্ম, মোটিফ কিংবা কোনো অনুষঙ্গ আর অলংকরণের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের মানুষের নানান ভাষা। ওষুধ আবিষ্কারের আগে পোশাকের ওপর চিহ্ন এঁকে বা সেলাই করে দেওয়া হতো; যেগুলো সেই সময়ের মানুষের রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিল। পরিধেয়ের ওপর লাল সুতোর অপ্রতিসম সূচিকর্মে বিশ্বাস করা হতো তাতে ঐশ্বরিক শক্তি রয়েছে। আবার সর্পিল প্যাটার্নকে ধরা হতো জীবনচক্রের প্রতীক হিসেবে।
অশুভ আর অমঙ্গল থেকে পরিত্রাণের জন্য আজও বিভিন্ন ধর্মানুসারী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আছে পোশাকে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ব্যবহারের রীতি।
বিয়ের পোশাক এখনো সব দেশের নারীদের কাক্সিক্ষত বিষয়; যা সারা জীবন রেখে দেওয়া হয়। এমনকি প্রজন্মান্তর ধরে চলে তার ব্যবহার। এই পোশাকেও স্পষ্ট সামাজিক মর্যাদা আর বিত্তের বিষয়। তবে অটোমানদের মধ্যে অদ্ভুত এক ঐতিহ্যের চল রয়েছে। বিয়ের পর সেই পোশাক নারীরা বিভিন্ন সময় পরেন। মৃত্যুর পর তার স্মরণে সেটি দিয়ে পর্দা বানিয়ে টাঙিয়ে রাখা হয়। সেটি হয়ে ওঠে স্মরণের উপলক্ষ। আবার আফগানিস্তানের ইহুদি নারীরা তাদের স্কার্ফ উপাসনালয়ে বেঁধে রেখে আসেন; যাতে তার মৃত্যুর পর তিনি স্মৃত হন।
প্রসঙ্গত, বিশ শতকের প্রথম দিকে বিবাহিত অটোমান নারীরা একধরনের স্লিভলেস লেয়ারড ড্রেস পরেছেন। রেশম বস্ত্রে তৈরি এই পোশাকগুলোকে বলা হতো এনটারি। এর সঙ্গে থাকত সিল্কের ব্রোকেড দেওয়া অ্যাপ্রন। এই পরিধেয়ের মধ্য দিয়ে দুটো বিষয় প্রতীয়মান হতো- মাতৃত্ব ও সেবা। এই ধরনের পোশাক অন্য দেশের নারীদের পরতে দেখা গেছে।
পোশাকের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ; যেমন মোটিফ, কাপড়, সূচিকর্ম কিংবা প্যাটার্ন। এসব এক দেশ থেকে আরেক দেশে গেছে। তবে এসব পোশাক অন্য স্থানে গিয়ে সময়ের পালাবদলে তার অর্থও বদলে গেছে।
উপকরণ, কারুকাজ আর ব্যবহারের নানা রীতির মধ্য দিয়ে বাঙ্‌ময় হয় পোশাকের ভাষা।
আবার বিভিন্ন সরকার বা গোষ্ঠী অন্য দেশে তাদের শাসন প্রতিষ্ঠা করার কারণেও পোশাকের পরিবর্তন ঘটেছে। রোমান, অটোমান কিংবা মোগলরা এর চমৎকার উদাহরণ হতে পারে। যেমন পাঞ্জাবি মোগলদের পোশাক ছিল না। কিন্তু তাদের আংরাখা এবং এই ধরনের ড্রেসের প্যাটার্ন থেকে পাঞ্জাবির উদ্ভব। এটিই আজ উপমহাদেশের উল্লেখযোগ্য ঐতিহ্যবাহী পোশাকে পরিণত হয়েছে। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে, উৎসব- প্রায় সব অনুষ্ঠানে পরা হয় পাঞ্জাবি। এমনকি আমাদের বৈশাখের সঙ্গে বস্ত্রটির কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এই উৎসব উদযাপনের অলিখিত জাতীয় পোশাকে পরিণত হয়েছে এটি। ফলে বদলে গেছে এর ব্যবহার উপযোগিতার সঙ্গে ভাষাও। কারণ, যে উপলক্ষে পোশাকটি পরা হচ্ছে, সেই ভাষাই প্রতীয়মান হয়।
ধরা যাক নেকটাইয়ের বিষয়টি। এর উদ্ভব একেবারে কাজের অনুষঙ্গ হিসেবে। শীত নিবারণই ছিল মুখ্য। কালে কালে সেটাই হয়েছে সামাজিক মর্যাদার উল্লেখযোগ্য উপাদান। কালক্রমে হয়েছে পেশাদারদের অনুষঙ্গ।
পোশাক আর এর ভাষা নিয়ে গবেষণা কম হয়নি। এসবে প্রথমেই উঠে এসেছে যে বিষয়টি তা হলো: পোশাক পরার মধ্য দিয়ে পরিধানকারী প্রকাশ করে তার ব্যক্তিত্ব। একটি বিষয় খুব জোর দিয়ে বলা হচ্ছে, পোশাক মানুষকে প্রভাবিত করে। তাই পরিধেয়ে অমনোযোগ অন্যকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। অর্থাৎ পোশাকের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত ভাষার তারতম্য এখানে স্পষ্ট। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কমলা হ্যারিসের কথা। তিনি কতটা প্রভাবিত করেছেন তার উদাহরণ হলো, শপথ গ্রহণের দিন যারা বাড়িতে বসে টিভিতে ওই অনুষ্ঠান দেখেছেন, তারা নারী-পুরুষনির্বিশেষে পরেছেন কনভার্স। আর মেয়েরা সেই সঙ্গে মুক্তার দুল। নির্বাচনী প্রচারণায় পরা তার অ্যাথলেজার বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এমনকি তিনি স্কার্টের বদলে পরেছেন প্যান্ট স্যুট। এই পোশাকের মধ্য দিয়ে তিনিও বিশেষ বার্তা দিয়েছেন। সেখানে রয়েছে স্বাভিমানের, স্বাধিকারের আর নারীমুক্তির প্রত্যক্ষ উচ্চারণ। অভিষেক অনুষ্ঠানে সেদিনের পোশাকের ভাষা নিরুচ্চার। অথচ ভীষণই অর্থবহ। কারণ, তারা পোশাকগুলো বানিয়ে নিয়েছেন অভিবাসী পরিবারের সন্তান কিংবা কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান ডিজাইনারদের কাছ থেকে। ফলে সেখানে রয়েছে মিলন, অন্তর্ভুক্তি, সম্পৃক্তির বার্তা।
রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রসঙ্গে আরও একটু বলা প্রয়োজন। যেটা আমাদের এই উপমহাদেশে লক্ষ করা যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ওয়েস্ট কোটের কথা। একেক রাজনীতিবিদের কল্যাণে এর নকশা যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলেছে এর ভাষাও। নেহরু কোট যেমন, তেমনি জিন্নাহ কোট। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের প্রাণিত করে মুজিব কোট। ছয় বোতামের এই কোট কালো এবং স্লিভলেস, ম্যান্ডারিন কলারের। নিচে দুটো পকেট। এর ডিজাইনও আলাদা অন্যদের থেকে। আর টিপিক্যাল ওয়েস্টকোট হয়ে বিশেষত্ব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। আর এই কোট হয়েছে প্রতিবাদের, আন্দোলনের, বিজয়ের, আবার প্রেরণারও।
এখানেই আসলে পোশাকের আবেদন ও তাৎপর্য। সোশ্যাল সাইকোলজিস্টদের ভাষায় পোশাক ‘স্ট্রাকচারাল ননভারবাল ইনফরমেশন’।
প্রতিবাদের ক্যানভাস
পোশাক প্রতিবাদের ভাষা। যুগ যুগ ধরে এটি চলে আসছে। লেখার শুরুতে নাওমি ওসাকার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, বিশ্বজুড়ে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের ব্যাপকতা, তীব্রতা। মিনিয়াপোলিসে কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েড পুলিশের হাতে নিহত হওয়ার পর বিষয়টির পালে বাতাস লাগে। বিশ্ব একাত্ম হয় এই আন্দোলনে। এই সময়ে উঠে আসে এমন একাধিক খুনের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি বর্ণবৈষম্য, নিপীড়নসহ নানা বিষয় চলে আসে সামনে। বিশ্ব দেখেছে পোশাকের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের ভাষা।
আবার গেল বছর আমাদের দেশে ধর্ষণের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। সেখানেও প্রতিবাদ কেবল মুখের ভাষাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি; বরং পোশাকেও তার প্রতিফলন দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ল্যাঙ্গুয়েজ অব ড্রেস বইতে উল্লেখ মেলে আফ্রিকার দাস ও মুক্ত নারীদের প্রসঙ্গ; যারা তাদের ফ্যাশন আর স্টাইলকে দাসপ্রথা বিরোধিতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তারা পৃথিবীর যে দেশেই অভিবাসী হয়েছে তাদের শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পোশাকও নিয়ে গেছে। নতুন ভূমিতে অভিযোজিত হলেও নিজেদের সেই পোশাককে তারা ছাড়েনি।
প্রতিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্ট। তখন থেকে হালের এই ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার। তবে উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনেও পোশাক হয়েছে প্রতিবাদের ভাষা। বিশেষ করে খাদি কাপড়, মোটা দেশি কাপড় সেই প্রতিবাদের অনুঘটক হয়েছে। কেবল পোশাক নয়, তা পরার ধরন বা স্টাইলও প্রতীয়মান করেছে এই ভাষাকে।
ডেনিমও ওই সামাজিক দাবি আদায়ের আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। ডেনিম মানেই কেজো পোশাক। এটাই এই পোশাক উদ্ভাবনের নেপথ্য ইতিহাস। তবে সেই ভাষায় বদল হয়েছে। এখন উন্নীত হয়েছে সামাজিক মর্যাদায়।
একসময় প্রতিবাদের পোশাক ছিল ফরমাল। কিন্তু সেই ধারায় এসেছে বদল। আসলে ভাষার মতো পোশাকের ভাষায়ও পরিবর্তন, পরিমার্জন ঘটেছে। এর উদাহরণ সেই ২০১১ সালের ওয়াল স্ট্রিটের ঘটনা থেকে হালের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার বা ধর্ষণের প্রতিবাদ।
তবে প্রতিবাদের পোশাকে ভাষা সব সময় পরোক্ষ থাকে না। বরং প্রত্যক্ষ হয়ে যায় বিভিন্ন স্লোগান ছাপা থাকায়।
বিশ্ব বদলেছে, বদলেছে মনোভাবও। তাই পোশাকে প্রতিবাদের ভাষায়ও লেগেছে সেই বদলের হাওয়া। ফ্যাশন ডিজাইনাররাও সরাসরি তাদের সংগ্রহের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদে শরিক হয়েছেন এবং হচ্ছেন। তা যেমন সামাজিক তেমনি বৈশ্বিকও। নারীর আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তা যেমন ভাষা পেয়েছে, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের কুফলও তাদের প্রতিবাদের বিষয় হয়েছে। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রবাল গুরুং, আশীষ গুপ্ত, ভিভিয়েন ওয়েস্টউডের মতো ডিজাইনার, মিসোনি আর শ্যানেলের মতো ব্র্যান্ড।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য হ্যাশট্যাগমিটু আন্দোলন। বিশ্বজুড়ে এটা কেবল আলোচিতই ছিল না বরং এর পক্ষে সরব হয়েছেন নারীর সঙ্গে পুরুষও। এই আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশে ২০১৮ সালের গোন্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানের ড্রেস কোডই ছিল কালো। রেড কার্পেটে তারকারা আপাদমস্তক কালো পোশাকে আবৃত হয়ে হেঁটেছেন। কয়েকজনের নাম স্মরণ করা যেতে পারে। পেনিলোপি ক্রুজ, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, জেসিকা বিয়েল, মার্গট রবি, নিকোল কিডম্যান। এদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন ক্রিস হেমসওয়ার্থ আর ইওয়ান ম্যাগগ্রেগররাও।
এর পরপরই গ্রামি অ্যাওয়ার্ডের অনুষ্ঠানে অনেক তারকা পরেন সাদা। এ ক্ষেত্রে এটি হয়ে ওঠে প্রতিবাদের রং। কেউ কেউ আবার হাতে একগুচ্ছ সাদা গোলাপ নিয়ে প্রতিবাদে একাত্ম হন।
তাই রং, পোশাক, প্যাটার্ন, মোটিফ, কাপড় বিভিন্ন সময়ে প্রতিবাদের সোচ্চার কিংবা নিরুচ্চার ভাষা হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
রঙের ভাষা
রঙ মানুষের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলে। এর মনোবৈজ্ঞানিক প্রভাবও যথেষ্ট গুরুতর। ২০১৪ সালে সেন্ট্রাল চায়না নরমাল ইউনিভার্সিটির সাইকোলজিস্টরা একটি গবেষণা করেন। তারা জানান, পুরুষের কাছে লাল পোশাকের নারীরা বেশি আকর্ষক। একটি ডেটিং ওয়েবসাইটের ভাষ্য: লাল ড্রেস পরা নারীদের প্রোফাইল ছবিতে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে পুরুষ। মেয়েরা যে লাল পোশাকের পুরুষ বেশি পছন্দ করে, সেটাও গবেষণা থেকে উঠে এসেছে।
লাল অনেকেরই প্রিয় রঙ; আমাদের দেশে লাল বেনারসি না হলে মেয়েদের বিয়েই হয় না। এখনো রঙটি রয়েছে সবচেয়ে ওপরে। এটি আমাদের উৎসবেরও রঙ। বৈশাখের কথা আগেই বলা হয়েছে। এ ঋতুতে অবশ্য লালের সঙ্গে সাদাও থাকে। ঠিক আবার এই রঙ দুটো সান্তা ক্লজের পোশাকেও দেখা যায়। সান্তার পোশাক মানেই শিশুদের আনন্দের উপলক্ষ। বৈশাখ আর সান্তা উভয় ক্ষেত্রে দুটো রঙেই প্রতীয়মান আনন্দ, উৎসব, নতুন শুরু।
পোশাকের মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে পৌরুষ। সেই ভাষাও পড়ে ফেলে নারী। একইভাবে নারীর পোশাকের ভাষায় পুরুষ খুঁজে নেয় বৈশিষ্ট্যের নানা দিক। ঢিলেঢালা পোশাকে স্পষ্ট হয় পুরুষের অমনোযোগ; অন্যদিকে নারীর চোখে ফিট পোশাক মানেই স্মার্ট, পৌরুষদীপ্ত। না, এটা কোনো মুখের কথা নয়, বরং ১৯৮৬ সালের এক গবেষণার ফল।
কেবল স্মার্টনেসই নয় পোশাক আরও ফুটিয়ে তোলে বিত্ত, সামাজিক মর্যাদার বিষয়গুলোও। আবার কখনো কখনো কেবল রং নয়, যে কাপড় দিয়ে পোশাক তৈরি হচ্ছে তার ডুরে বা ছাপাও প্রকাশ করে নানা ভাষা। একসময় স্ট্রাইপড পোশাক পরা মানুষদের মনে করা হতো অভিশপ্ত। সেই ভাবনা থেকে সম্ভবত জেলখানার পোশাকও স্ট্রাইপড। আবার ফুল, লতাপাতা বা অন্য যেকোনো ধরনের উজ্জ্বল প্রিন্টে ফুটে ওঠে উচ্ছলতা।
এবার এই রঙের বিপ্রতীপ ভাষা নিয়ে আলোচনা করা যাক। যেখানে দেশভেদে কিংবা একই দেশে বদলে যায় ভাষা। প্রসঙ্গত, পিকে ছবিতে পিকে (অ্যালিয়েন আমির খান) দেখিয়ে দেয় সভ্যতাগর্বী বিশ্বের অনেক অসংলগ্নতা। এতে রঙও একটি উপাদান। আমাদের কাছে, বিশেষত এই উপমহাদেশে সাদা মানে বিধবাদের রঙ। অর্থাৎ সাদায় প্রকাশিত হয় নারীর নিঃসঙ্গতার ভাষা। আবার এই সাদা এখানে কিংবা অন্য দেশে বিশেষত খ্রিস্টানদের কাছে মিলনের রঙ। এই রঙ তখন হয়ে যায় জীবন উদযাপন ও মিলনের ভাষা। অন্যদিকে এই সাদাই বিশ্বজুড়ে শান্তির বার্তা দিয়ে থাকে। পরোক্ষে তা পবিত্রতারও প্রতীক। আবার কালো মানে শোক। অথচ এই রঙের বোরকা পরে মুসলমান নারীরা। তখন থাকে না শোকের প্রকাশ, বরং সেটাই স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এভাবেই রঙও প্রকাশ করে নানা ভাষা। কখনো কখনো সেই ভাষায় প্রকাশ পায় একাধিক অর্থ ও উদ্দেশ্য।
উৎসবেও তো রঙের ভূমিকা রয়েছে। ভ্যালেন্টাইন দিবসে যেমন লাল তেমনি ফাল্গুনের বাসন্তী। আবার দোলের মূল রঙ আবির বা ফাগ। এভাবেই নানা রঙে প্রতিভাত হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উৎসব উদ্যাপন। এর মধ্য দিয়ে বাঙ্ময় হয় রঙের ভাষা।
বিভিন্ন ধর্মের উপাসক এবং পুরোহিতদেরও রয়েছে জ্যেষ্ঠতা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন রঙের পোশাক। এখানেও রঙ প্রকাশ করে তাদের পদমর্যাদা।
কালার আমাদের মনোজগৎ তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। রঙের ভাষায় আমরা নানাভাবে প্রভাবিত হই।
পোশাক এবং এর রঙ আমাদের কখনো আন্দোলিত করে, কখনোবা বিচলিত। এটাই হয়ে আসছে অনাদিকাল থেকে। তাই হয়তো তুতেনখামেনের কবর খুঁড়ে পাওয়া গেছে ২৫০ পোশাক আর বেশ কিছু থান কাপড়। তিনি হয়তো অনাগতকালের প্রজন্মকে তার পোশাকের ভাষায় বলে যেতে চেয়েছেন অনেক কথা, ইতিহাস আর বীরত্বগাথা। অতএব এসব পোশাক হয়ে ওঠে গল্পকথক। পোশাকের এই ভাষা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। থেকে যায় গবেষণার বিপুল অবকাশ। এমনকি গবেষণা হতে পারে আমাদের এই ভূখন্ডের পোশাকের ভাষা নিয়েও।

sksaifurrahman@gmail.com
মডেল: মিথিলা, এনা এবং ইমরান
ছবি: জিয়া উদ্দিন
ওয়্যারড্রোব: ক্যানভাস
মেকওভার: পারসোনা
কৃতজ্ঞতা: মেহেদী হাবিব ডন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top