এডিটরস কলাম I চুজ টু চ্যালেঞ্জ
আগে নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন সমাজের কাছে সে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বিশ্বজুড়ে মানুষ যখন বিপন্ন, তখন নারীর অস্তিত্ব ও আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার চাপজনিত ধারাবাহিকতা তো ছিলই, সঙ্গে যোগ হলো অতিমারি। এমন পরিস্থিতিতে নারী কী করবে, তা-ও এখনকার একটা চ্যালেঞ্জ বৈকি! এই বিবেচনায় যে, তার কর্মসংস্থানও সংকুচিত হয়ে এসেছে। কেননা, অন্তত শারীরিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য সারা পৃথিবীর মানুষ মরিয়া ও সতর্ক। এই অবস্থায় চিন্তা এবং কাজের ক্ষেত্র নির্বাচন দুরূহও বটে। নারীকে একদিকে যেমন লক্ষ রাখতে হয় পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার নানা বিষয়-আশয়ের দিকে, তেমনি আত্মপ্রতিষ্ঠার অনুকূল কাজ কী হতে পারে, সেদিকেও। এই দুয়ের মাঝখানে তার অস্তিত্বচিন্তাই বেশি প্রবল হয়ে উঠেছে। আমরা জানি, কৈশোর-উত্তীর্ণ প্রত্যেক মানুষের প্রতিদিনের চিন্তা ও কর্মের জন্য সে নিজেই দায়ী, ফলে ভবিষ্যৎ কিংবা পরিণামের কথা ভেবেই তাকে অগ্রসর হতে হয়। সমাজের অপরাপর ব্যক্তির মতো নারীর জীবনও তেমন। যদিও পুরুষের তুলনায় তার আত্মবিকাশের ক্ষেত্র অনেকখানি সীমিত। কিন্তু ভাই, স্বামী, বাবা, সহকর্মী, বন্ধু, প্রতিবেশী ও অন্যান্য পুরুষের সঙ্গেই তাকে চলতে হয়। অন্যদিকে, নানা ক্ষেত্রে বৈষম্য ও প্রতিকূল সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়াও অনিবার্য বাস্তবতা। আবার তার একার কথা ভাবলেও চলে না। মানে, তাকে ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক হয়ে উঠতে হয়।
২
ব্যক্তি থেকে সামষ্টিক হয়ে উঠতে গেলে প্রথমেই নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হয়, যাতে সমাজ তাকে নিজের অপরিহার্য অংশ হিসেবে ভাবতে বা গ্রহণ করতে পারে। সে জন্য সামাজিক চাহিদার কাছে যে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করতে হবে তা নয়। আগে নিজেকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন সমাজের কাছে সে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার চিন্তা ও কাজের একটা প্রভাব তৈরি করতে পারে। আবার তার নারীত্বের বিষয়টিও উপলব্ধি করতে পারে। বোঝা যাচ্ছে, সমাজে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও প্রভাব সৃষ্টির জন্য যা কিছু দরকার, তা নারীর নিজেকেই করতে হয়। কর্মপন্থা বেছে নেওয়া থেকে শুরু করে সক্রিয়তা পর্যন্ত। নিজেরও অন্যের প্রতি হতে হয় দায়িত্বশীল। কাজটি সহজ নয়। কোনোকালে ছিলও না। কেন, তা সবারই কম-বেশি জানা।
৩
নতুন বাস্তবতায় পুরুষের চেয়ে নারীর কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে বেশি। এমনও দেখা গেছে, চাকরি হারিয়েছে যে নারী, পুরো পরিবারই তার রোজগারের ওপর ছিল নির্ভরশীল। সেই নারীর সামনে যে বিপন্নতা এসে দাঁড়িয়েছে, তাকেই তা মোকাবিলা করতে হয়েছে। খুঁজে নিতে হয়েছে বিকল্প পথ। এর একটা ভালো দিক রয়েছে। তা এই, সে জেনেছে নতুন কোনো ভাবনা ও কাজ বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলার উপযুক্ত হতে পারে। ফলে তার সক্রিয়তা বেড়েছে আগের চেয়েও। এতে নারীর সম্ভাবনার নতুন এক প্রান্ত উন্মোচিত হয়েছে। দেখা গেছে, নির্ধারিত কাজের যে ছক, যেখানে সৃজনশীলতা ও নিজস্ব দক্ষতা প্রকাশের কোনো সুযোগ ছিল না, তা থেকেও নারী বেরিয়ে এসেছে। দায়িত্ব নিয়েছে আরও গভীর ও ভিন্নতর কাজের, হয়ে উঠেছে বেশি পেশাদার। বাস্তবিক, অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামই মানুষকে কার্যকর পথটি দেখিয়ে দেয়।
৪
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এবারের স্লোগান ‘চুজ টু চ্যালেঞ্জ’। নতুন স্বাভাবিকতায় এটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, অসমতার ধারাবাহিক বাস্তবতায় বিদ্যমান পরিস্থিতি নারীকে আরও চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করিয়েছে। এর মোকাবিলায় করণীয় কী হতে পারে, সে বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নিজস্ব চিন্তা ও কর্ম নির্ধারণ করতে হবে নারীকেই এবং এই সক্রিয়তা দিয়ে সমষ্টির অংশও হয়ে উঠতে হবে। অধিকারের প্রশ্নগুলো তো জারি থাকছেই। নারীর সফলতাকে অন্তরালে রাখা সমীচীন হবে না। উদযাপন করতে হবে তার অর্জনকে। তাতে সমাজকেও সঙ্গে রাখা দরকার। সামূহিক মনস্তত্ত্বের মধ্যে এই বোধ সঞ্চারিত করতে হবে যে, নারীর সফলতা সমাজের অগ্রগমনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।