ফিচার I প্রবৃদ্ধিতে নারী
কাগজে-কলমে নারীর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ক্ষেত্রে যে হিসাব জাতীয়ভাবে আমরা পাই, তার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো সম্পর্ক নেই। যদি থাকত, তাহলে পাওয়া যেত ভিন্ন এক চিত্র। লিখেছেন মনীষা উজ্জয়িনী
শার্লট পারকিন গিলম্যান ১৮৮৯ সালে নারী ও অর্থনীতিবিষয়ক বইতে লিখেছেন, ‘একজন পুরুষ বেঁচে থাকার মতো অর্থনৈতিক কর্মকান্ড করার সাপেক্ষে একজন স্ত্রী পান, আর একজন স্ত্রী স্বামী পাবার সাপেক্ষে তার জীবনধারণের আয়োজন নিশ্চিত করেন।…যত দিন পর্যন্ত ঘরের কাজগুলো সম্পন্ন করার জন্য গৃহশিল্প গড়ে না ওঠে, তত দিন পর্যন্ত নারীর জন্য ঘরের বাইরের কাজে অংশগ্রহণ সম্ভব নয়।’ প্রায় সোয়া শ বছর পরেও ব্যবস্থা একই থেকে গেছে, শুধু উন্নয়নশীল দেশের জন্য নয়, পাশ্চাত্যের উন্নত রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও এটি সত্য। নারীবাদীরা বলে থাকেন, গৃহশ্রমের অসম বিভাজন থেকে এর ভিত্তি হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক শ্রমবিভাজন এবং তা থেকে পাওয়া মূল্যবোধ। নারীর গৃহশ্রম মূল্যায়নে সুসম সমাজকাঠামোর কথা ভাবা হলেও কোনো অর্থনৈতিক দর্শনই তা নিশ্চিত করেনি।
রোজা লুক্সেমবার্গ বলেছেন, ‘এই ধরনের কাজ, তা যতই সাফল্যের, ত্যাগের বা শ্রমসাধ্য হোক না কেন, বর্তমান ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে উৎপাদনী নয়। যত দিন পর্যন্ত পুঁজি ও মজুরি ব্যবস্থা শাসন করবে, তত দিন সেসব কাজই উৎপাদনী বলে বিবেচিত হবে, যা উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি করবে, যা পুঁজিপতির সুযোগ তৈরি করে’ [রোজা লুক্সেমবার্গ, ১৯১২]। এমন ‘আধুনিক’ পুঁজিতান্ত্রিক সমাজও দেখা যায়, যেখানে পরিবারের বন্ধন শিথিল হয়েছে, গৃহশ্রম পণ্যে রূপান্তর হয়েছে, পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ অপ্রকাশ্য রয়েছে, ঘরের ভেতরের কাজে নারী-পুরুষের দায় বণ্টন অনেকখানি সুষম হয়েছে।
একটি বিষয় অর্থশাস্ত্রে বরাবরই অনুচ্চারিত থেকেছে, নারীর জন্য [পুরুষের সমান] একই সুযোগগম্যতা ও সক্ষমতা তৈরির ব্যবস্থা শুধু অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয় নয়, শেষ ফলাফলের জন্য সামাজিক আরও অনেক প্রপঞ্চকে [যেমন দিবাযত্ন কেন্দ্র, পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ইত্যাদি] বিনিয়োগের আওতায় আনতে হবে, সাযুজ্যপূর্ণ আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং এগুলো রাজনৈতিক দর্শনের অংশ। তবে অর্থশাস্ত্রে, নারীর অ-আর্থিক বা বাজারবহির্ভূত শ্রমকে অর্থনৈতিক গণনায় এবং জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত করার তত্ত্বীয় চর্চা ৫০ বছর ধরেই চলছে। ১৯৫৩ সালে জাতিসংঘের প্রস্তাবিত সিস্টেম অব ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিং সংক্ষেপে এসএনএ পদ্ধতিতে [যা পরবর্তীকালে অধিকাংশ দেশেই গৃহীত হয়] যেসব পণ্য ঘরের সদস্যদের ভোগের জন্য উৎপাদিত হয় এবং যা বাজারজাত করা হয় না, তাকে জিডিপির বাইরে রাখা হয়। নারীবাদীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালে এসএনএ কিছুটা সংশোধন করে তাতে পারিবারিক ভোগের জন্য উৎপাদিত দ্রব্য ও সেবাকে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও জাতিসংঘের এসএনএ তার মূল অ্যাকাউন্ট বা হিসাব ঠিক রেখে পারিবারিক উৎপাদন স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট হিসেবে অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ করে। অর্থাৎ [প্রধানত] নারীর সম্পাদিত বাজারবহির্ভূত, বিশেষত, গৃহশ্রমের অর্থনৈতিক হিসাব তত্ত্বীয়ভাবে করা সম্ভব হলেও এখনো তা মূলধারার জাতীয় আয়ের হিসাবের বাইরে থেকে গেছে। বর্তমানে পৃথিবীর ৮২টির বেশি দেশে গৃহকাজে ব্যয়িত সময়ের জরিপ পরিচালনা করা হলেও শুধু অস্ট্রেলিয়া এবং জার্মানি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিয়মিত স্যাটেলাইট অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
দুই
‘পরিবার’ হলো অর্থনৈতিক একক, প্রত্যেক মানুষ একজন আরেকজনের থেকে আলাদা এবং তাদের প্রত্যেকেই যৌগিক আচরণ করে। ‘পরিবার’ বলতে সাধারণ অর্থে ধরে নেওয়া হয় উপার্জনক্ষম স্বামী, তার ওপর নির্ভরশীল স্ত্রী, যিনি ঘরের সব কাজ করেন। সেটি স্বামী-সন্তান, শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করা, রান্না, ঘর গোছানো, কাপড় সেলাই, অন্যান্য সূচিকর্ম, কাপড় ধোয়া, গৃহপালিত পশু লালনপালন থেকে কৃষিকাজ পর্যন্ত। উল্লেখ্য, কৃষি বলতে কেবল মাঠে ফসল উৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত কাজই নয়, শস্য শুকানো, ঝাড়া, রক্ষণাবেক্ষণ, বীজ সংরক্ষণ- সবই এর আওতায় পড়ে। নারীর এসব গৃহকর্মের কোনো মজুরি কখনো বিবেচনায় আনা হয়নি।
গৃহকর্মের বাইরে দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। ২০১০-এর শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী নারী জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের হার ৩৬ শতাংশ; ১৯৮৫-৮৬ সালে যা ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। পুরুষের ক্ষেত্রে এই হার ৮২ দশমিক ৫ শতাংশ। কাজে নিয়োজিত আছে শ্রমশক্তির মাত্র ১৬ দশমিক ২ শতাংশ নারী, যার অধিকাংশই [৫৬ দশমিক ৩ শতাংশ] মূলত বিনা পারিশ্রমিকের পারিবারিক শ্রমের সঙ্গে যুক্ত। ‘বিনা পারিশ্রমিকের পারিবারিক শ্রম’ এবং ‘গৃহকর্মে নিয়োজিত শ্রম’ ধারণাগতভাবে পৃথক, প্রথমটি শ্রমশক্তির ভেতরে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। যখন কোনো ব্যক্তি তার সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ [বিয়ে, নির্ভরশীলতা, দত্তক ইত্যাদির সুবাদে] অন্য একজন পারিবারিক সদস্যের মালিকানায়/চালিত ফার্মে/ব্যবসায়/ রেফারেন্স সমন্বয়ের ন্যূনতম এক ঘণ্টা বিনা পারিশ্রমিক/মুনাফায় কাজ করে, তখন তাকে ‘বিনা পারিশ্রমিকের পারিবারিক শ্রম’ হিসেবে গণনা করা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ২০১০ সালে কৃষিসহায়ক উপকরণ বিতরণের লক্ষ্যে মাঠপর্যায়ে কৃষক শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া শুরু করে।
‘কৃষক’ কৃষি মজুর ইত্যাদি উৎপাদন সম্পর্কের ধরনের ওপর নির্ভর করে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জমির মালিকানার ভিত্তিতে ‘কৃষক’ শনাক্ত করে, নারী যেহেতু জমির মালিক নয়, তাই শ্রম দেওয়ার পরেও সে ‘কিষানী’ নয়।
এ পর্যন্ত ১ কোটি ৫৬ লাখ ‘কৃষক’ শনাক্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ১ কোটি ৩৮ লাখ কার্ড কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। অধিদপ্তরে কতজন ‘কিষানী’ এই কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ড পেয়েছে, তার কোনো তথ্য নেই। ফলে সেসব জিডিপিতে যোগ করাও হচ্ছে না।
১৯৯৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা যায়, ঘরের বাইরে ও ভেতরে নারীর কাজগুলোর অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করলে জিডিপিতে নারীর অবদান দ্বিগুণ হবে। অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের সাম্প্রতিক হিসাব অনুযায়ী গৃহস্থালি কর্মকান্ডে নারীর অবদানের অর্থনৈতিক মূল্য পরিমাপ করলে বাংলাদেশের জিডিপিতে তা হবে ৪৮ শতাংশ।
বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির সময় নারীর গৃহকর্মের বিষয়টিও ভেবে দেখা দরকার। এ সময় অনেক পুরুষ চাকরি হারিয়েছে। এমনকি ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আংশিক বা পুরোপুরি বেকার হয়ে পড়েছে অসংখ্য মানুষ। তখন সংসারের দৈনন্দিন খরচ নির্বাহের হাল ধরেছে নারীরা। বিশ্বব্যাপী এমন নারীর সংখ্যা অগণিত। তারা গৃহকর্মের পাশাপাশি খাবার তৈরি, কাপড় সেলাই, বিনোদন ও শিক্ষামূলক ভিডিও তৈরি ইত্যাদি নানান ধরনের কাজ করে সেসব অনলাইনে সরবরাহ করেছে। এতে যেমন নিজস্ব অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা সম্ভব হয়েছে, অন্যদিকে অনলাইনের মাধ্যমে এসব পণ্যসেবা অনেকের জীবনযাত্রাকে সহজ করেছে। বলা যায়, এ সময় নারীই অনেক পরিবারে অর্থনীতির হাল ধরেছে।
৩
বাংলাদেশে নারী আন্দোলনকারীদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে ২০০৬-০৭ অর্থবছরের বাজেটে ‘জেন্ডার বাজেটিং’ শিরোনামে মাত্র সাত লাইনের একটি অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে সেখানে নারীর জন্য খাতওয়ারি বরাদ্দের কোনো হিসাব ছিল না। এ সময় সরকারের নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় সেক্টরে দারিদ্র্য ও জেন্ডার সংবেদনশীল বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়া চালু হয়।
দারিদ্র্য নিরসন ও নারী উন্নয়নসংক্রান্ত বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোর প্রতিবেদন প্রণয়নের সক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে অর্থ বিভাগ কর্তৃক সুনির্দিষ্ট ছক এবং নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। দারিদ্র্য নিরসন ও নারী উন্নয়নের ওপর মন্ত্রণালয়ের কৌশলগত উদ্দেশ্যগুলোর প্রভাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের বাজেট কাঠামোর তৃতীয় অংশে তুলে ধরা হয়। বাজেট পরিপত্র-১ [অংশ-১]-এর সেকশন ৩-এ দারিদ্র্য নিরসন এবং নারী উন্নয়নের ওপর মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প ও কর্মসূচিগুলোর প্রভাবের মাত্রা সম্পর্কে তথ্য প্রদানের জন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে অনুরোধ জানানো হয়। এর মাধ্যমে মন্ত্রণালয়সমূহ দারিদ্র্য নিরসন ও নারী উন্নয়নের লক্ষ্যে গৃহীত তাদের বিভিন্ন কর্মসূচির কার্যকারিতা যাচাই করতে পারে। বাংলাদেশে আরসিজিপি [তথ্যভিত্তিক] রিকারেন্ট, ক্যাপিটাল, জেন্ডার অ্যান্ড পোভার্টি] মডেলের মাধ্যমে নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দকে আলাদাভাবে দেখানো সম্ভব হচ্ছে। সেসবের মধ্যে শিক্ষা খাত, জেন্ডার সংবেদনশীলতা, মানবসম্পদ উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক ধরা হয়েছে শিক্ষার হার ও মানের বিস্তৃতি।
তবে, এত কিছুর পরেও নারীর গৃহকর্মের মূল্যায়ন ও মজুরি নির্ধারণ এবং তা জিডিপিতে যোগ করা হলে অর্থনীতিতে একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন সূচিত হবে বলে অনেকের ধারণা।
ছবি: ইন্টারনেট