skip to Main Content

ফিচার I হারিয়ে খুঁজি, বধ্যভূমি

মুক্তিযুদ্ধকালীন বেশির ভাগ গণকবরের হদিস মেলে না। ফলে ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে

২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইট থেকে ১৪ ডিসেম্বরের গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যা, আরও একটু বাড়িয়ে নিলে পরের বছরের ৩১ জানুয়ারি মিরপুর মুক্ত হওয়া পর্যন্ত- পুরো সময়টাতে ঢাকা ছিল এক ভুতুড়ে শহর। নগরের বেশির ভাগ খালি মাঠ, শহরতলি, ডোবার ধারের মাটি একটু খুঁড়লেই বেরিয়ে এসেছে লাশ। ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির সূত্র ধরেই জানা যায়, ঢাকায় এই ধরনের স্থানের সংখ্যা ন্যূনতম ৭০। কটার কথাই-বা মনে রেখেছি আমরা।
নগর ঢাকায় থাকা ৭০টি বধ্যভূমির ভেতরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের তালিকা থেকে সন্ধান মেলে ২৩টির মতো। এগুলো হচ্ছে শিয়ালবাড়ি, মিরপুর বাঙলা কলেজ, হরিরামপুর গোরস্তান, রাইনখোলা, জল্লাদখানা, মুসলিম বাজার (নূরী মসজিদ), আদাবর গণকবর, মোহাম্মদপুর থানা উত্তর সীমান্ত, বছিলা ইটখোলা, রায়েরবাজার, মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা ইনস্টিটিউট, কৃষি সম্প্রসারণ ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, রমনা কালীবাড়ি, রোকেয়া হল গণকবর, জগন্নাথ হল, জগন্নাথ কলেজ গণকবর, এমএনএ হোস্টেল, ধলপুর ডিপো গণকবর, ঠাটারীবাজার মৎস্যপট্টি, জিঞ্জিরা, কুর্মিটোলা সেনানিবাস গণকবর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন বধ্যভূমি। অথচ ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির হিসাবে কেবল মিরপুরেই বধ্যভূমির সংখ্যা ২৩।
২৩টিই মিরপুরে। ঠিকঠাক খুঁজলে ৫-৬টির সন্ধান মেলে। নূরী মসজিদ, জল্লাদখানা, মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থান- এই কটি। মিরপুর বাঙলা কলেজের বধ্যভূমির অবস্থান এখনো চিহ্নিত করা যায়, তবে সেখানে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা সাইনবোর্ড নেই। আর বাকিগুলোর হদিস মেলে না। শিয়ালবাড়ির বধ্যভূমিতে এই কদিন আগেই মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে আধুনিক বিপণিবিতান। রাইনখোলার বধ্যভূমি স্থানীয়রা টিকিয়ে রাখলেও কোনো এক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এলাকাবাসীর তৈরি করা স্মারকস্তম্ভ ভেঙে রিকশার গ্যারেজ বানিয়েছে। মিরপুর শাহ আলী বোগদাদীর মাজারের পুকুরেও যে গণহত্যা হয়েছিল, তা জানা গেলেও নেই কোনো স্মারক বা পরিচিতি। সারেং বাড়ির বধ্যভূমির কোনো খোঁজ মেলে না। নূরী মসজিদের খননকাজ সেই যে একবার বন্ধ করা হয়েছিল ১৯৯৯ সাল নাগাদ, পুনরায় তা আর শুরু করা সম্ভব হয়নি। মসজিদের সব স্তম্ভ সাদা হলেও একদম সামনের সারির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণেরটি কালো টাইলসে মোড়া। কালাপানি বধ্যভূমিতে এখন আবাসিক ইমারত আর মসজিদ-মাদ্রাসা দাঁড়িয়ে। প্যারিস রোডের বটতলা, যেটাকে টেক-এলাকা (জলাশয়ের ধারের উঁচু স্থান) বলা হতো, সেটাও এখন মানুষের বসতি। এখানে বছর দশেক আগেও বাড়ি তৈরির জন্য মাটি খুঁড়লে বেরিয়ে আসত কঙ্কাল।
নূরী মসজিদ বা মুসলিম বাজার বধ্যভূমির খননকাজের সময়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পরিচালক ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরী। ফেসবুকের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, সে সময়ে মসজিদ কমিটি ছিল তার জন্য সবচেয়ে বড় বাধা। তার পরিচালনাকালেই ঢাকার অন্যতম বধ্যভূমি জল্লাদখানার খননকাজও শুরু হয়। ঢাকা শহরের তিনটি সুসজ্জিত ও সুসংগঠিত বধ্যভূমির একটি মিরপুর ১০ নম্বর এলাকার জল্লাদখানা।
মিরপুরের দুটো আর রায়েরবাজারের বধ্যভূমিটি ছাড়া ঢাকা শহরের অন্যগুলো অযত্নে পড়ে আছে। কুর্মিটোলা আর রাজারবাগের বধ্যভূমি টিকে রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বদান্যতায়। কেন এই দুর্দশা? পত্রপত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো বধ্যভূমির তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ সরকার। সরকারি-বেসরকারি হিসাবে মতের পার্থক্য থাকলেও এর ভেতরেই ২০০৯ সালে উচ্চ আদালত বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের নির্দেশ দেন। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত দেশে বধ্যভূমি ও গণকবরের সংখ্যা ২০৯, আর বেসরকারি সংস্থা ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংয়ের মতে সারা দেশে বধ্যভূমির সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি, আর শনাক্ত করা গেছে ৯৪২টি। অথচ সরকারিভাবে সংরক্ষিত বধ্যভূমি ও গণকবরের সংখ্যা ৩৫। এই ৩৫টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য কয়েক দফা বাজেট বরাদ্দ হলেও দুর্নীতি, অবহেলা আর অনিয়মে কাজ এগোয়নি কিছুই। পরে অবশ্য ২০১৮ সালে এসে ২৮১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের জন্য সরকার ৪৪২ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন দেয়, যার মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে এ বছরেই। কাজের অগ্রগতি সেই আগের মতো।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, যেসব বধ্যভূমি চিহ্নিত হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন। স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের নকশানুযায়ী ১৯ শতাংশ জমির প্রয়োজন হলেও সেই পরিমাণ জমি পাওয়া যাচ্ছে না। স্থাপত্য নকশায় পরিবর্তন এনে কাজ করতে হচ্ছে। তারপরও নির্ধারিত সময়ের ভেতরে শেষ হতে চলেছে মাত্র তিনটি বধ্যভূমির কাজ- পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার বাড়ৈবাড়ি, সাতক্ষীরার তালার জালালপুর ও ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আটানি বাজার বধ্যভূমি। শহর ঢাকার বধ্যভূমির হদিস মেলে না এখানেও।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কেন মন্ত্রণালয়ের এত অনীহা, তা জানা নেই। সারা দেশের বধ্যভূমি সংরক্ষণের এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে এবং দ্রুত করতে হবে। প্রয়োজনে যারা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা এবং শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতি সংরক্ষণে কাজ করেছেন বা করছেন, তাদের যুক্ত করতে পারে, পরামর্শ নিতে পারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও বধ্যভূমি সংরক্ষণ না করতে পারাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক।’
মুনতাসীর মামুনও মনে করেন, সরকারের সদিচ্ছা আর প্রকল্পে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করা মানুষদের অনুপস্থিতি এই ব্যর্থতার কারণ। তিনি বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে যারা থাকে, তারা বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়, কিন্তু আমাদের সমস্যা হলো এই প্রকল্পে যারা থাকে, তাদের প্রধান উদ্দেশ্যই বিদেশ ভ্রমণ। এরপর দেশে ফিরে তারা সবকিছু ভুলে যান।’
অবশ্য নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সরকারের যেমন দায় রয়েছে, তেমনি দায় রয়েছে স্থানীয়দেরও। বধ্যভূমি সংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপ চাইলে তারাও নিতে পারেন। তবে সম্ভবত আমাদের মধ্যে সেই বিবেচনাবোধ এখন নাই হয়ে গেছে।’

 আল মারুফ রাসেল
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top