skip to Main Content

ঘরেবাইরে I যেখানে নিদ্রিত বঙ্গবন্ধু

সেখানে হাজারো মানুষের পদচারণ। আছে নীরবতাও। ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার প্রকাশে স্থানটি উজ্জ্বল ও ভাবগম্ভীর। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল

টুঙ্গিপাড়া। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু এখানে শায়িত। ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত এই সমাধিসৌধ পরিচর্যায় রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগ ছিল না।
সৌধটির কর্মপরিকল্পনার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় সে বছর। কিন্তু অনানুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল আরও দুবছর আগে। তখন স্থপতি এহসান খান বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটিকে জাদুঘরে রূপান্তরের কর্মকান্ডে নিয়োজিত। তাকে পরিকল্পনা করতে বলা হয়েছিল এই সমাধিসৌধ নিয়ে। ১৯৯৪ সালে দায়িত্ব দিয়েছিলেন তখনকার প্রধান বিরোধীদলীয় নেত্রী। পরে, কাজটি ১৯৯৬ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ করা হয়।
টুঙ্গিপাড়া গ্রামটা বেশ নিচু; সহজেই প্লাবিত হয়। উঁচু বাসযোগ্য ভূমির সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য তাই ঘরের কাছেপিঠে, উঠোনে সমাহিত করার একটা চল সেখানে রয়েছে। বঙ্গবন্ধুকেও সমাধিস্থ করা হয়েছিল লোকালয়ের মধ্যেই, বাড়ির উঠোনে, তার বাবা-মায়ের কবরের পাশেই। এখানে সমাধিসৌধ তৈরির ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারত দেশ-বিদেশ থেকে আগত দর্শনার্থীদের স্থান সংকুলানের পাশাপাশি উপযোগিতাও। এই সমস্যা সমাধানই তাই নকশার গতি-প্রকৃতির প্রভাবক হয়ে দাঁড়ায়।
সমাধি কমপ্লেক্সে কবর এমন একটা অংশ, যেখানে দর্শনার্থীরা আসবে, সমাহিত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে, সেখানে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপার রয়েছে। আর এটা কেবল বর্তমান সময়ের জন্য বা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় আটকে থাকার বিষয় নয়, বিশেষত যেখানে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের লোকেরাও আসবেন। নকশা প্রণয়নে এ-ও মাথায় রাখা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণমানুষের নেতা, আর সেভাবেই তাকে তুলে ধরার চেষ্টা ছিল এই সৌধে। গ্রামের পরিবেশ, মানুষ, সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব- সব যেন এক সুতোয় গাঁথা হয়ে থাকে, সেই চেষ্টা দেখা যায় এই ইমারতে। এখানে দর্শনার্থী হবে, তারা আধ্যাত্মিক, ধর্মীয়, মানসিকভাবে জায়গার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে- এটাই পরিকল্পনায় ছিল। আর এটা করতে গিয়ে এখানে দুটো কোর্ট ইয়ার্ড বা প্রাঙ্গণ রাখা হয়- একটা আধ্যাত্মিক, অন্যটি উন্মুক্ত। বাইরের অংশটা মূলত নিচু পতিত জমিই ছিল, সেখানে পাবলিক ফাংশন- ক্যাফে, অভ্যর্থনা কেন্দ্র, জাদুঘর, পাঠাগার, নামাজ আদায়ের জায়গা, উন্মুক্ত থিয়েটার ইত্যাদি রয়েছে। এই দুটো আলাদা হলেও একটার সঙ্গে আরেকটার রয়েছে সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক; সে লক্ষ্যে মেঠো পথের মতো করেই দুটো প্রাঙ্গণকে সংযুক্ত করা হয়েছে ইটের তৈরি পথ দিয়ে। তবে মাথায় রাখতে হয়েছে, অসংখ্য লোকের সমাগম সত্ত্বেও যেন ব্যবস্থাপনা আর দেখাশোনার কোনো সমস্যা ও পরিবেশের পরিবর্তন না ঘটে। সে কারণেই গ্রামীণ প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনা হয়।
নির্মাণ উপকরণ হিসেবে কংক্রিট আর ইটের ব্যবহার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সমাধির পাশ থেকেই একটি সরু পথ বাঁকা হয়ে চলে গিয়েছিল। ডিরেকশনাল এক্সিসের এই সমস্যা দূর করতে মূল সমাধির নকশাটা হয়ে গেল বৃত্তাকার। স্থাপনাটি ব্যতিক্রমী করতে এটায় দরজা-জানালা কিছু রাখা হয়নি। এখানে কয়েকটা ওপেনিং রয়েছে। চারপাশে বৃত্তাকার কোর্ট ইয়ার্ড, মাঝখানে সমাধি। আর দেয়ালগুলোকে ছিদ্রবহুল করা হলো, যেন আলো-বাতাসের চলাচল স্বাভাবিক থাকে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এখানে একটা ধারণা তৈরি করা হলো, যা সময়োপযোগী ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ নিতেও প্রস্তুত।
এই সমাধিসৌধ তৈরিতে স্থপতি এহসান খান মূলত অনুপ্রেরণা খুঁজে পেয়েছিলেন নির্দিষ্ট অক্ষরেখায় নির্মিত দিল্লির হুমায়ূনের সমাধি ও উনিশটি পাথরের জালি দিয়ে ঘেরা ফতেহপুর সিক্রির সেলিম চিশতি (র.)-এর সমাধি থেকে। সেলিম চিশতির সমাধির আদলেই বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধের প্রথম লেয়ারটি তৈরি করা হয়। এরপর প্রদক্ষিণ পথ, তারপর একটা অষ্টভুজ, সেখান থেকে চতুর্ভুজ, চতুর্ভুজের ওপর একটা গম্বুজ। গম্বুজ না বলে আসলে শামুকের আকৃতি বলাটাই ভালো। একটা ভাসমান শামুক- চারটা কোনায় স্থাপন করা, যেটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক আকৃতির বা ফর্মের ধারণা দেয়। সেখান থেকে দিনের বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের আলোর প্রবেশও ঘটে কাচ ভেদ করে। আলো আমাদের মধ্যে অনুভূতি তৈরি করে, স্থানের সংকেত দেয়, আধ্যাত্মিক প্রভাব ফেলে। একটা ইমারতকে আধ্যাত্মিকভাবে সংযোগ করানো হয় আকৃতি (ফর্ম) এবং স্থান (স্পেস) দিয়ে, আর সেটাকে পূর্ণতা দেয় আলো।
কোনো প্লাস্টারের ব্যবহার নেই এই প্রাঙ্গণে। কংক্রিট ব্লক রাখা হয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য সৃষ্টির জন্য। এক্সপোজড ম্যাটেরিয়াল বা কংক্রিটের ইট আর শেল সাইটে তৈরি করে ব্যবহার করা হয়েছিল। বিশুদ্ধ আকার, উপকরণ আর স্থাপত্যিক ধারণার দিক থেকে এটা কখনো পুরোনো হবে না, কেবল এর শরীর ধুলেই হয়ে যাবে, আবার সময়ের সঙ্গে এর এজিংও হবে- এইটাই ছিল মূল ধারণা।
আধ্যাত্মিক প্রাঙ্গণের মূল আকর্ষণ হলো বঙ্গবন্ধুর সমাধির জায়গাটা। বহিরাঙ্গনের বেশির ভাগ ইমারত তৈরি ইট দিয়ে, বাংলা ভূখন্ডে যার ঐতিহ্য হাজার হাজার বছরের। ২০০ ফুট গুণন ২০০ ফুটের বহিরাঙ্গনে সময়ে সময়ে বিপুল দর্শনার্থী হাজির হয়; বিভিন্ন কর্মকান্ড, অনুষ্ঠান, জনসমাগম, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও হয়। আবার কখনো প্রায় নীরব; তখন সমাধিপ্রাঙ্গণটি ভাবগম্ভীর হয়ে ওঠে।
স্থাপত্যের ধারণায় একটি স্থানের অনেকগুলো ডাইমেনশন রয়েছে। একটা কনসেপচুয়াল আর একটা ফেনোমেনোলজিক্যাল। মাস্টারপ্ল্যানে বস্তুগত ধারণার বাইরে গিয়ে পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আদি-অস্তিত্বের ধারণা দেওয়া যায় কি না- উপকরণ, গঠনবিন্যাস, রঙ দিয়ে আধ্যাত্মিক, মানসিক ও দৃশ্যগতভাবে- সেটা তৈরির চেষ্টা ছিল। আর ক্লায়েন্টের ব্রিফে ছিল কিছু ফাংশনাল দিক; যেমন সেখানে নামাজ, লাইব্রেরি, জাদুঘর, ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা রাখা। এটাও বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। ‘আমাদের উপমহাদেশে নেতাদের কীভাবে স্মরণ করা হবে, সেটার জন্য হুমায়ুনের সমাধিসৌধ বেশ শক্ত এক উদাহরণ, আমরা সেটাকে ভেঙে দিতে চেয়েছি। বঙ্গবন্ধু যেমন জনসাধারণের নেতা, সাধারণ মানুষ যেন তাকে নিজেদেরই একজন মনে করেন, সেভাবেই এই সমাধিসৌধ তৈরি করা হয়েছে, যাতে মনুমেন্টালিজম থাকবে, একই সঙ্গে খুবই হিউম্যান স্কেলের হবে, এমনটা তৈরির পরিকল্পনা ছিল আর সম্ভবত আমরা খানিকটা হলেও সেটা করতে পেরেছি’- জানিয়েছেন স্থপতি এহসান খান।

স্কেচ: স্থপতি এহসান খান
ছবি: স্থপতি এহসান খান ও লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top