ফিচার I সিনেমার ব্যানারচিত্র
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ব্যানার পেইন্টিং পঞ্চাশের দশক থেকেই শিল্পকলার স্বতন্ত্র শাখার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। এর বিকাশের সঙ্গে গড়ে উঠেছিল চিত্রকরদের একটা শ্রেণি। কিন্তু আজ তা অতীত। লিখেছেন শাওন আকন্দ
বাংলাদেশে যেকোনো প্রেক্ষাগৃহের সামনে চলতি সিনেমার নায়ক-নায়িকা, ভিলেন কিংবা বিভিন্ন খ-চিত্রের সমন্বয়ে আঁকা উজ্জ্বল, রঙিন ও বৃহদাকৃতির সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং কিছুদিন আগেও ছিল। অঙ্কনশৈলী, কম্পোজিশন, রঙের ব্যবহার ইত্যাদি মিলে এটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল। এখন (২০২০) এই ধারার চিত্রকলা বিলুপ্তপ্রায়। হাতে আঁকা ব্যানারচিত্রের স্থান দখল করেছে ডিজিটাল প্রিন্ট। এটি দেখা যায় না বললেই চলে।
দুই
চলচ্চিত্রশিল্পকে কেন্দ্র করে ব্যানার পেইন্টিংয়ের ধারা বিকশিত হয়েছিল। প্রেক্ষাগৃহে বাণিজ্যিকভাবে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সূত্রপাত হলে দর্শকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিপণনের অংশ হিসেবে এর উদ্ভব ঘটে।
সিনেমার জন্ম পাশ্চাত্যে। এটির সঙ্গে ঢাকাবাসীর আনুষ্ঠানিক পরিচয় ঘটে ১৮৯৮ সালের ১৭ এপ্রিল। কলকাতার ব্র্যাডফোর্ড বায়োস্কোপ সিনেমা কোম্পানি ঢাকার ক্রাউন থিয়েটারে প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে। এটি লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় ক্রমশ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কিছু হল তৈরি হয়েছিল। তবে সিনেমার ব্যানার বলতে আমরা এখন যা বুঝি, অর্থাৎ কাপড়ের ওপরে বিভিন্ন উজ্জ্বল রঙে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের পোর্ট্রেট কিংবা ফিগার এবং গোটা গোটা অক্ষরে লেখা সিনেমার নাম ও অন্যান্য তথ্য- এ ধরনের কাজের সূত্রপাত ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরই হয়েছে। তার আগে ঠিক এ ধরনের ব্যানার পেইন্টিংয়ের প্রচলন না থাকলেও প্রচারণার তাগিদে প্রেক্ষাগৃহের নির্দিষ্ট দেয়ালে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের ছবি ও সিনেমার নাম বড় করে লেখা হতো। ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে, ঢাকার প্রেক্ষাগৃহের দেয়ালে এ ধরনের ছবি আঁকার কাজে যুক্ত ছিলেন এমন একজন শিল্পীর নাম জানা যায়- তিনি শাঁখারীবাজারের পীতলরাম সুর (১৯০২-১৯৮৭)।
দেশভাগের পর বিপুলসংখ্যক অবাঙালি মুসলমান কলকাতা ও ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসেন। তাদের অনেকেই কলকাতা, মুম্বাই ও মাদ্রাজে সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং কিংবা এ ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মূলত এদের হাত দিয়েই এখানে এই পেইন্টিংয়ের সূত্রপাত। উদাহরণ হিসেবে মোহম্মদ সেলিম ও আবদুল ওহাবের নাম উল্লেখ করা যায়। এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন স্থানীয় স্বশিক্ষিত শিল্পীদের কেউ কেউ। যেমন এ. জেড. পাশা, সুভাষ দত্ত, সুতান সরকার (দিনাজপুর), দাউদ উস্তাদ (রাজশাহী) প্রমুখ। এমনকি পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত অনেকে এই পেইন্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। যেমন বিখ্যাত শিল্পী ও ভাস্কর নিতুন কুন্ডু (১৯৩৬-২০০৬) এবং বর্তমানে চলচ্চিত্র পরিচালক আজিজুর রহমানের (জন্ম ১৯৩৯) নাম উল্লেখ করা যায়।
তবে এর উৎস সন্ধান করলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রথমত রাজা রবি বর্মার (১৮৪৮-১৯০৬) পেইন্টিং ও ছাপাই ছবির কাছে। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের মাধ্যমে প্রচলিত পাশ্চাত্যধারার সাদৃশ্যধর্মী চিত্রকলায়। গবেষকদের মতে, ইউরোপীয় একাডেমিক রীতি আত্মস্থ করে ভারতীয় বিষয়বস্তু, বিশেষ করে ধর্মীয় ও পৌরাণিক কাহিনিনির্ভর চিত্রকলা যে নতুন নান্দনিক বোধের জন্ম দেয়, তার সরাসরি প্রভাব পড়েছিল প্রথম দিকের ভারতীয় চলচ্চিত্রে। উল্লেখ্য, রাজা রবি বর্মাই প্রথম পাশ্চাত্য শৈলীতে ভারতীয় বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তেলরং মাধ্যমে, যা পরবর্তীকালে ছাপাই ছবি আকারে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই চিত্রভাষার ওপর ভিত্তি করে প্রথম পর্যায়ের ভারতীয় চলচ্চিত্র নিজস্ব রূপ খুঁজে পায়। উদাহরণ হিসেবে ডি. জি. ফালকে (১৮৭০-১৯৪৪) পরিচালিত ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ (১৯১৩)-এর নাম করা যায়। স্বাভাবিক কারণেই এসব সিনেমার প্রচার ও বিজ্ঞাপনের বিবিধ উপকরণ (যেমন পোস্টার, বুকলেট, ব্যানার) নির্মাণে একই রীতির প্রভাব পড়েছে। তবে ভারতীয় সিনেমার প্রচারণায় হাতে আঁকা পোস্টার বা ব্যানারের ক্ষেত্রে বাবুরাও পেইন্টারের (১৮৯০-১৯৫৪) নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। মহারাষ্ট্রের কোলহাপুরের একটি কারুশিল্পী পরিবারে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ছবি আঁকা ও ভাস্কর্য নির্মাণে পারদর্শী এই শিল্পী ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ দেখে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং তা প্রচারণায় ব্যানার-পোস্টারের বিষয়ে বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন। বিভিন্ন লেখক-গবেষকের মতে, বাবুরাও পেইন্টারই প্রথম নিজের সিনেমার প্রচারণার জন্য হাতে আঁকা পোস্টার বা ব্যানারের সূত্রপাত করেন। এখন পর্যন্ত পাওয়া ছাপানো পোস্টারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তারটিই পুরোনো। উল্লেখ্য, ‘কধষুধহ কযধলরহধ’ (১৯২৪) সিনেমাটির পরিচালক তিনিই। আর এটি আঁকার কৃতিত্বও দেওয়া হয় বাবুরাও পেইন্টারকে।
তিন
১৯৪৭-এর পর বাংলাদেশে মূলত দুটি শহরে সিনেমার ব্যানার পেইন্টিংয়ের ধারা বিকশিত হয়। প্রথমটি সৈয়দপুরে (বর্তমান নীলফামারী জেলার অন্তর্ভুক্ত) এবং দ্বিতীয়টি ঢাকায়। তবে বিচ্ছিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে কেউ কেউ কাজটি করেছেন। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, যশোর, কুষ্টিয়া, রাজশাহী ও রংপুরে এমন কয়েকজন শিল্পী কাজ করতেন বলে জানা যায়।
পেইন্টাররা কাজের অর্ডার পেতেন মূলত সিনেমার পরিবেশকদের কাছ থেকে। কখনো কখনো হলের মালিকও সরাসরি বায়না করতেন। ঢাকায় পরিবেশকেরা প্রযোজকদের কাছ থেকে কয়েক সেট আলোকচিত্রের অ্যালব্যাম নিয়ে পেইন্টারদেরকে ব্যানার আঁকতে দিত। সেই সঙ্গে, কখনো কখনো, অনেকগুলো পোস্টারও উৎস হিসেবে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হতো। আলোকচিত্র ও পোস্টার থেকে নিজেদের মর্জিমাফিক চরিত্র (প্রতিকৃতি, ফিগার কিংবা অন্যান্য অনুষঙ্গ) নির্বাচন করে নিজস্ব কম্পোজিশনে ব্যানার পেইন্টিংয়ের কাজ করতেন পেইন্টাররা। ক্ষুদ্রাকৃতির পোস্টার থেকে বৃহদাকৃতির ব্যানার আঁকার কাজে তারা গ্রাফ পদ্ধতির সাহায্য নিতেন। এতে আলোকচিত্র/পোস্টারের উপরে কলমের সাহায্যে গ্রাফ এঁকে নেওয়া হতো। ক্যানভাসে এটির জন্য অনুপাত ঠিক রেখে সুতলি ও গুঁড়া রং/অক্সাইড ব্যবহার করা হয়।
সিনেমার ব্যানার পেইন্টিংয়ের জন্য চারুশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রচলিত জলরং কিংবা তেলরং নয়, ব্যবহার করা হয় বিশেষ একধরনের ‘পেস্ট’ বা মিশ্রণ। সাধারণ গুঁড়া রঙের সঙ্গে তিসির তেল মিশিয়ে এটি তৈরি। প্রয়োজনে মেশানো হয় অ্যানামেল পেইন্ট। রং পাতলা বা তরল করার জন্য তারপিনের ব্যবহার প্রচলিত আছে। তবে ঢাকায় ষাটের দশক থেকে এর সঙ্গে প্রেসের রং ব্যবহার শুরু হয়। তা ব্যয় সংকোচনের জন্যই। তা ছাড়া এই রং প্রয়োগের কারণে ব্যানার উজ্জ্বলতর ও আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। ষাট বা সত্তরের দশকে ঢাকায় প্রথম ফ্লোরোসেন্ট কালারের ব্যবহার করা হয় ব্যানার আঁকার কাজে।
এ কাজের জন্য প্রথমে ক্যানভাস প্রস্তুত করতে হয়। একসময় চট ব্যবহার করা হতো। পরে মোটা মার্কিন কাপড়ের প্রচলন ঘটে। তবে ঢাকার কারখানাগুলোতে কখনো কখনো টেট্রন জাতীয় কাপড় ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ক্যানভাস তৈরি শেষ হলে ড্রইং। সাধারণত তরুণ শিক্ষানবিশেরা কাজটি করে থাকে। এরা ‘ড্রইং ম্যান’ হিসেবে পরিচিত। এরপর প্রাথমিক রং দেওয়ার পালা। এই পর্বে শিষ্যরা কেউ কাপড়ের (ড্রাপারি) কাজ, কেউ ফিগারের কাজ, কেউ প্রতিকৃতির কাজ করে। সবশেষে উস্তাদ-শিল্পী প্রয়োজনমতো ‘ফিনিশিং টাচ’ দিয়ে ব্যানার আঁকা শেষ করেন। নায়িকার কোমল মুখশ্রী, নায়কের বলিষ্ঠ চেহারা, ভিলেনের ক্রূরতার প্রকাশ দেখা যায় উস্তাদ-শিল্পীদের তুলির ছোঁয়ায়। সবশেষে লেটারিং করা হয়।
চরিত্র অনুসারে রঙের ব্যবহারে ব্যানারশিল্পীদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বকীয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। যেমন নায়িকার প্রতিকৃতিতে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়ার জন্য মুখম-ল ও গাত্রবর্ণ লাল, গোলাপি, হলুদ- এরূপ উজ্জ্বল রঙে আঁকা হয়। তবে চোখের আইশ্যাডো হিসেবে নীল, সবুজ, বেগুনি রঙের প্রচলন। এগুলোও মেকআপের রং। আবার পুরুষ ভিলেন চরিত্রের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘ডেঞ্জার কালার’। এটি হলো পরস্পর বিপরীতমুখী উচ্চকিত দুটি রঙের সহাবস্থান। যেমন লালের পাশে সবুজ, নীলের পাশে কমলা ইত্যাদি। মৃত্যু কিংবা পরকালের দৃশ্য বোঝাতে ছাই বর্ণ। তবে রং ব্যবহারে ব্যানারশিল্পীরা অতিরঞ্জনে আগ্রহী। সম্ভবত এমনটি ঘটেছে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশে।
ব্যানার অঙ্কনে কখনো কখনো নিরীক্ষার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, ষাটের দশকে এবং তারপর, স্প্রে করে কিংবা ‘পেপার কোলাজ’-এর মাধ্যমে বিশালাকৃতির ব্যানার নির্মাণ করা হয়েছিল (খান আতাউর রহমানের ‘ঝড়ের পাখি’ চলচ্চিত্রের ব্যানার করা হয়েছিল পেপার কোলাজ মাধ্যমে)। ‘কাঁচকাটা হীরে’ চলচ্চিত্রের ব্যানারে কাচের ভাঙা টুকরো ব্যবহৃত হয়েছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন উপকরণ যেমন সোলা, বোতাম, চুমকি, হার্ডবোর্ড কিংবা তুলার প্রয়োগও হয়েছে কখনো কখনো। এমনকি নায়িকার শাড়ি না এঁকে সরাসরি আসল শাড়ি সেঁটে দেওয়া হয়েছে ব্যানার পেইন্টিংয়ে (শাবানা অভিনীত ‘অবুঝ মন’ চলচ্চিত্রটির ব্যানারে, সত্তরের দশকের শেষে, এটা করেছিলেন গিরিন দাস)। তা ছাড়া ‘কাট আউট’ও ব্যবহার করা হয়েছিল, যেখানে নায়িকা শাবানার হাতটি যন্ত্রের সাহায্যে ওঠানামা করত ‘স্বাগতম/শুভেচ্ছা’ জানানোর ভঙ্গিতে।
লেটারিংয়ের ক্ষেত্রেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। সাধারণত কাহিনির ধরন ও বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল রেখে এটা করা হয়। অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্রের নামাঙ্কনে ছিল মোটা লাইনের অক্ষর। কোনো কোনোটির অক্ষর ছিল দেয়ালে নির্মিত সিরামিকের তৈরি ম্যুরালের মতো ফাটা ফাটা (ভিলেনের প্রতিকৃতিতেও এ রকম করা হতো)। রোমান্টিক ও সামাজিক সিনেমার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক আকৃতির বর্ণমালার ব্যবহার বেশি দেখা যায়। এগুলোতে বিভিন্ন ফুল, লতাপাতা, এমনকি ‘হার্ট’ চিহ্ন সংযোজন করা হয়।
চার
সিনেমার ব্যানার আঁকার কাজে বাংলাদেশে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাদের মূলত দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, অবাঙালি মুসলমান, যারা দেশভাগের পর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে) এসেছিলেন। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় নিম্নবর্গের (দাস, মনিদাস, ধর, সুর) হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, যাদের একটা অংশ বিভিন্ন ধরনের কারুশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে নানা অর্থনৈতিক কাঠামো ও ধর্মীয় পরিচয়ের কিছু ব্রাহ্মণও (চক্রবর্তী) এই কাজে যুক্ত হয়েছিলেন। তৃতীয় ধারায় আঁকিয়ে হিসেবে যুক্ত হয়েছিল স্থানীয় কিছু বাঙালি মুসলমান, তাদের সংখ্যা ছিল কম।
উল্লেখ্য, এই পেইন্টিং বংশের ধারাবাহিকতায় নয়, চলে এসেছে গুরু-শিষ্যপরম্পরায়। কিশোর/তরুণ শিক্ষানবিশ (শাগরেদ) হিসেবে কোনো উস্তাদ-শিল্পীর অধীনে কাজ শিখত। সাধারণত চার থেকে সাত বছর তার তত্ত্বাবধায়নে হাতে-কলমে সিনেমা ব্যানারের নানা কলাকৌশল আয়ত্ত করত তারা। পরবর্তীকালে একজন শিক্ষানবিশ নিষ্ঠা, দক্ষতা ও খানিকটা মেধার জোরে উস্তাদ-শিল্পী হয়ে উঠত। এভাবেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই শিল্পের ধারা গড়ে উঠেছে।
ব্যানার পেইন্টিংয়ের দোকান বা কারখানার আয়তন বেশ বড় হতো। কেননা, ব্যানারের দৈর্ঘ্য হতো কমপক্ষে দশ ফুট। কখনো কখনো একসঙ্গে অনেক ব্যানারের কাজ করতে হতো। বিশেষ ক্ষেত্রে রাস্তার ধারের খোলা জায়গায় কিংবা কারখানার কাছাকাছি কোনো মাঠেও চলত আঁকার কাজ।
ঢাকার সিনেমার ব্যানার পেইন্টাররা প্রতি বর্গফুট হিসেবে মজুরি পেতেন। পঞ্চাশের দশকে ছিল এক টাকা থেকে এক টাকা চার আনা। ষাটের দশকে তা দুই টাকার কিছু কমবেশি। সত্তরের দশকে চার থেকে ছয় টাকা। ২০০৫ সালে এই মজুরির পরিমাণ ছিল প্রতি বর্গফুটে ৮ থেকে ১০ টাকা। প্রয়োজনীয় খরচা শিল্পীকে এবং ক্ষেত্রবিশেষে কারখানার মালিককে বহন করতে হতো। ষাট, সত্তর কিংবা আশির দশকের শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, তখন কাজের ব্যাপক চাহিদা থাকায় রোজগারের পরিমাণ কমবেশি যা-ই হোক, ধারাবাহিকতা ছিল। তা দিয়ে তাদের সংসারও চলে যেত একভাবে। কিন্তু নব্বইয়ের দশক এবং তারপরে পরিস্থিতির ক্রমশ অবনতি ঘটে। বর্তমানে সিনেমার ব্যানার পেইন্টিংয়ের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ। একটি কারখানাও আর চালু নেই।
পাঁচ
মূলত পঞ্চাশ থেকে নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাংলাদেশে ব্যানার পেইন্টিংয়ের সুসময় ছিল। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে অবনতি শুরু হয়। এর একটা কারণ, সার্বিকভাবে চলচ্চিত্রশিল্পের অধঃপতন। ফলে সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং ক্রমশ গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা হারায়।
দ্বিতীয়ত, ইদানীং ডিজিটাল প্রিন্টিং হাতে আঁকা ব্যানারের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এটির আগমন ঘটে। ক্রমশ তা সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং সিনেমার প্রচারের কাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। ফলে হাতে আঁকা ব্যানার পেইন্টিংয়ের প্রতিষ্ঠিত ও ঐতিহ্যবাহী ধারাটি একুশ শতকের শুরুতেই অস্তিত্বের সংকটে পড়ে।
২০০৫ সালে ঢাকায় অন্তত ৭টি এবং সৈয়দপুরে ৩টি কারখানা সক্রিয় ছিল। সেগুলোয় পঞ্চাশজনের বেশি কারিগর কাজ করতেন। এখন একটিও চালু নেই। আঁকিয়েদের অনেকেই ইতিমধ্যে পেশা পরিবর্তন করে ফেলেছেন। যারা এখনো এটিকে পেশা হিসেবে ধরে রেখেছেন, তারা মূলত সাইনবোর্ড লেখা, রিকশা পেইন্টিং, পোর্ট্রটে আঁকা কিংবা অন্য যেকোনো ধরনের ছবি এঁকে জীবিকা নির্বাহ করছেন। যেমন অর্ডারের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্কুলের বা হোটেল/রেস্টুরেন্টের দেয়ালে ছবি কিংবা বিভিন্ন এনজিওর জন্য আঁকাআঁকির কাজ তারা করে থাকেন। কাচের বোতল কিংবা পুরোনো সিডির ওপর সিনেমার ব্যানার পেইন্টিংয়ের স্টাইলে ছবি এঁকে কেউ কেউ রোজগারের নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা করছেন। তবে সিনেমার জন্য ব্যানার তারা আর আঁকেন না। মূলত চাহিদা/অর্ডারের অভাবে এই কাজ বন্ধ হয়েছে। ফলে আঁকিয়েদের অনেকেই কোনোরকমে আর এ কাজের সঙ্গে যুক্ত নন। কেউ কেউ হাসপাতাল, হোটেল কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে (যেমন নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ইত্যাদি) কাজ করছেন বেঁচে থাকার তাগিদে। তবে সময় এবং পর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পেলে চমৎকার সিনেমার ব্যানার আঁকতে পারেন এমন শিল্পী এখনো বিরল নয়।
এসব সমস্যা ও সংকটের পরও কিছু আশাব্যঞ্জক সংবাদ জানা যায়। ইদানীং নাগরিক শিক্ষিত সমাজের মধ্যে সিনেমার ব্যানার পেইন্টিং বিষয়ে আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। ঐতিহ্য ও সমকালীনতাকে মেনে গড়ে ওঠা কেন্দ্র ‘যথাশিল্প’ বিষয়টি নিয়ে নানা উদ্যোগ ও তৎপরতা চালাচ্ছে। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির তত্ত্বাবধায়নে ঢাকা আর্ট সামিটে বাংলাদেশের দীর্ঘতম সিনেমা ব্যানারটি আঁকা হয়েছে। উস্তাদ মোহম্মদ শোয়েবের নেতৃত্বে ১৪ জন শিল্পী এই কাজে অংশগ্রহণ করে। শিল্পকর্মের বিষয় ছিল বাংলাদেশ ও আফ্রিকার বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা, পারস্পরিক সংগ্রাম ও সৌহার্দ্যরে গল্প। গত বছর যথাশিল্পের উদ্যোগে প্যারিসের বিখ্যাত প্যালাই দ্য টোকিওতে মোহম্মদ শোয়েবের একটি সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং প্রদর্শিত হয়। শিরোনাম ছিল ‘ঝড়ের পাখি’। প্রতিষ্ঠানটিসহ কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা (‘সন্তরণ’, ‘গ্যালারি জলরং’) এই আঁকিয়েদের তত্ত্বাবধানে তরুণ প্রাতিষ্ঠানিক/অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের নিয়ে কর্মশালার আয়োজন করেছে। এর একটি লক্ষ্য ছিল সিনেমার ব্যানারচিত্রের শৈলী সম্পর্কে তরুণ শিল্পীদের অবহিত করা।
২০১৪ সালে সিনেমা ব্যানার পেইন্টার মোহাম্মদ হানিফ পাপ্পু ও মোহম্মদ শোয়েব ডেনিস সেন্টার ফর কালচার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের আমন্ত্রণে ডেনমার্কে যান। সেখানে তাদের কাজ প্রশংসিত হয়েছে এবং কোপেনহেগেনে সেগুলো সংরক্ষিত হচ্ছে। শীতেশ সুর, আরেকজন সিনেমার ব্যানারশিল্পী, ‘বাংলাদেশ প্রজেক্টে’র আওতায় জাপানের সেতোচি ট্রিয়েনাল ২০১৩-এর অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া তার আঁকা সিনেমা ব্যানার পেইন্টিং লন্ডনে প্রদর্শিত হয়। ২০১৪ সালে আর্ট ম্যাগাজিন ‘ডেপার্ট’-এর উদ্যোগে সিনেমা ব্যানার, রিকশা পেইন্টিং ইত্যাদি কাজের সঙ্গে যুক্ত শিল্পী বাহরাম-এর একক চিত্র প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা আর্ট সেন্টারে। তাঁর কাজের বিশেষত্ব শিল্পরসিক ও সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
কোনো কোনো আধুনিক চারুশিল্পীর কিছু কাজেও সিনেমার ব্যানার পেইন্টিংয়ের প্রভাব লক্ষ করা যায়। যেমন চন্দ্রশেখর দে (জন্ম ১৯৫১), শিশির ভট্টাচার্য্য (জন্ম ১৯৬০), আবদুস সালাম (জন্ম ১৯৭১), সুমন ওয়াহেদ, মানিক বনিক প্রমুখ। তাঁরা নিজস্ব স্টাইলে সিনেমার পোস্টার কিংবা ব্যানার পেইন্টিংয়ের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য শিল্পকর্মে ব্যবহার করেছেন। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কোনো কোনো শিল্পীর কাজে এর প্রভাব দেখা গেলেও বাংলাদেশের কোনো চারুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনো এই বিশেষ রীতির শিল্পশৈলীর ব্যবহারিক অনুশীলন করে বলে জানা নেই।
ইদানীং এই শিল্পের বিশেষ শৈলী বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হতে দেখা যাচ্ছে। বিয়ে, গায়েহলুদসহ অন্যান্য অনুষ্ঠানে এই স্টাইলে পরিবারের সদস্যদের ছবি এঁকে তা দিয়ে ব্যাক ড্রপ তৈরি করার কথা জানা গেছে। এমনকি কাঠের টুল কিংবা জামাকাপড়ে এই পেইন্টিং ব্যবহারের সংবাদও আছে। ফলে মনে হয়, সিনেমা ব্যানারের এই বিশেষ শৈলীর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
ছবি: লেখক
শিল্পী ও গবেষক: পরিচালক যথাশিল্প