ফিচার I গম্ভীরা
সুর এবং সংলাপে তৈরি গানের নকশা। যাতে সমকালীন ঘটনা, সামাজিক বিচ্যুতি, সমস্যা ও সমাধানের কথা নাচের ঢঙে বলা হয়ে থাকে
লোকসংগীতের উল্লেখযোগ্য ধারা গম্ভীরা। লোকনাট্যের আঙ্গিকে বর্ণনামূলক গান। পশ্চিমবঙ্গে মালদহে এটি প্রচলিত। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁসহ আশপাশের জেলায় এটি দলবদ্ধভাবে গাওয়া শুরু হয়। মূলত শিবপূজাকে কেন্দ্র করে এর উদ্ভব। শিবের আরেক নাম ‘গম্ভীর’। এই দেবতার বন্দনাগীতিই হলো গম্ভীরা। ধর্মীয় উৎসব থেকে শুরু হলেও সমকালীন সমাজ বাস্তবতা, জীবন ও রাষ্ট্রের বিষয় এই গানের প্রতিপাদ্য। ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে সামাজিক চালচিত্রের প্রতিচ্ছবি এতে প্রতিফলিত হওয়ায় তা বরাবরই প্রাণবন্ত। একই সঙ্গে সামাজিক মূল্যবোধ, উন্নয়ন ও কল্যাণের জন্য লোকনাট্যের এই আঙ্গিকের ভূমিকা দীর্ঘকাল ধরে স্বীকৃত ছিল।
মালদহ জেলায় চৈত্রসংক্রান্তির শিবপূজা উপলক্ষে কয়েক বছরের প্রধান প্রধান ঘটনাবলি নৃত্য, গীত ও অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয় গম্ভীরায়। এতে সমালোচনামূলক তামাশা মুখোশনৃত্যের মাধ্যমে পরিবেশনের রীতি। বাংলাদেশে এই গানের রীতি অনেকটাই রূপান্তরিত হয়ে যায়। স্থানীয় সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ মিশে নতুন একটি আবহ সৃষ্টি হয়। রাজশাহী অঞ্চলে গম্ভীরা গানে নানা-নাতি মুখ্য চরিত্র। চরিত্র দুটি এতই জনপ্রিয়তা পায় যে, তা আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধ, গণজাগরণ, যেকোনো সামাজিক অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে এবং সমকালীন অনেক সংকটে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে, সাহস জুগিয়েছে, আনন্দও দিয়েছে।
গম্ভীরা গানের রয়েছে একাধিক পর্ব। প্রতিটিতেই আছে উৎসবের আঙ্গিক। প্রথম দিনের উৎসবের নাম ‘ঘর ভরা’। এদিন শিব ঠাকুরের উদ্দেশে ঢাকঢোল বাজিয়ে নদী থেকে ঘটে পানি নিয়ে তা স্থাপন করা হয় ম-পে। দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠান ‘ছোট তামাশা’। এতে শিব ও পার্বতীর পূজা রং, তামাশা, আনন্দ, রসিকতায় কাটে। তৃতীয় দিনের উৎসব ‘বড় তামাশা’। এদিন হয় মুখোশনৃত্য- চামু-, নরসিংহী, কালীর মুখোশ পরে ঢাকের তালে তালে উদ্দাম নাচের মধ্য দিয়ে গম্ভীরার বিশেষ রূপ প্রকাশ পায়। চতুর্থ দিন অনুষ্ঠিত হয় ‘আহারা’। বিকেলে সঙ বের হয়। বিভিন্ন সাজে সেজে সঙ গ্রাম-শহর প্রদক্ষিণ করে। সঙ আবার দুই ভাগ। প্রথম রীতি গান গেয়ে অভিনয় করা। এটিই গম্ভীরা লোকনাট্য।
গম্ভীরার উপস্থাপন কৌশলেও রয়েছে একাধিক ভাগ। প্রথমে ‘বন্দনা।’ এ অংশে মঞ্চে শিব এলে তাকে সব বিষয়ে জানানো হয়। সমাজের জন্য করণীয় বা সমস্যা সমাধানের উপায় নির্দেশ করে শিব। এরপর নারী ও পুরুষের অভিব্যক্তি নিয়ে আসে ‘দ্বৈত’ চরিত্র। যে গানের মধ্য দিয়ে সমাজ, রাজনীতি ও রাষ্ট্রের নানা বিষয় তুলে ধরে। পরে ‘চার ইয়ারি’ হিসেবে মঞ্চে আসে চারজন। পরের ভাগ ‘ব্যঙ্গ।’ যেখানে রসিকতার মাধ্যমে জরুরি কিছু কথা বলা হয়। শেষ পর্ব ‘সালতামামি।’ পুরো বছরের কাজের হিসাব উঠে আসে সংক্ষিপ্ত বিবরণে এবং সমাধানের একটা পথের নির্দেশ দিয়ে গম্ভীরা শেষ হয়।
এই লোকনাট্য বা গানে বিশেষ ভূমিকা রাখে তালবাদ্য। হারমোনিয়াম, তবলা, করতাল, ট্রাম্পেট ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয় গম্ভীরা গানে।
আগেই বলা হয়েছে, কেবল ধর্মীয় মোড়কে এই গান পরিবেশিত হয় না, সাধারণ মানুষকে সচেতন করার ভূমিকা রেখেছে এই লোকসংস্কৃতি। ক্রমেই শিবের পরিবর্তে নানা-নাতির ভূমিকায় দুজন অভিনয় করে গম্ভীরা গানে। তাদের সংলাপ ও সংগীতের মধ্য দিয়ে দ্বৈতভাবে এটি পরিবেশিত হয়। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এসব কথা ও সুরের মাধ্যমে একটি বিষয়কে তুলে ধরে। গানের একটি ধুয়া থাকে। সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে গানগুলো ধুয়ার সুরে গীত হয়।
নৃত্য, গীত, কৌতুক, অভিনয় আর রঙ্গরসের সংমিশ্রণে গম্ভীরা গানে নানা-নাতির উপস্থিত বুদ্ধি, বাকচাতুরী ও অঙ্গভঙ্গি সবাইকে মুগ্ধ করে। নানার পোশাক লুঙ্গি ও গেঞ্জি। মুখে পাকা দাড়ি, হাতে লাঠি, মাথায় মাথাল। আর নাতির পোশাক লুঙ্গি, ছেঁড়া গেঞ্জি, কোমরে গামছা। অর্থাৎ পোশাকেও স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি প্রতিফলিত হয়। রঙ্গকৌতুকের সঙ্গে নানা-নাতির পরিধেয়ও সাধারণ মানুষের আবেগ ও দৈনন্দিন জীবনের সংস্কৃতি মেনেই ভাবা হয়ে থাকে।
গম্ভীরা একসময় একতাল, ত্রিতাল, দাদরা, খেমটা, কাহারবা প্রভৃতি তালে গাওয়া হতো। এ ছাড়া এতে লোকনাট্যের বিভিন্ন বিষয়, চরিত্র, সংলাপ যুক্ত হয়েছে। ক্রমেই তাতে সুরের পরিবর্তন ঘটে। হিন্দি ও বাংলা চলচ্চিত্রের গানের সুর যোগ হয়। ফলে এই গানের আদি রূপটি পরিবর্তিত হলেও নতুন রীতিও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।
যাদের পরিবেশনা স্বমহিমায় বিরাজমান, তাদের প্রায় সবাই আজ প্রয়াত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের কুতুবুল আলম, রকিব উদ্দিন, বীরেন ঘোষ, মাহবুবুল আলম প্রমুখ শিল্পী। পশ্চিমবঙ্গেরও কয়েকজন শিল্পীর নাম বলতে হয়- ধনকৃষ্ণ অধিকারী, কৃষ্ণধনদাস গোস্বামী, মহম্মদ সুফি, গোপালচন্দ্র দাস, কিশোরীকান্ত চৌধুরী, যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরী প্রমুখ। কেবল মালদহ নয়, অবিভক্ত দিনাজপুরের শিল্পী যোগেন্দ্রনাথ চৌধুরীকে বলা হতো ‘গম্ভীরা স¤্রাট’।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কুতুবুল আলম, রকিব উদ্দিনও জীবদ্দশায় প্রায় কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন। এরা দুজনে নানা-নাতির ভূমিকায় অভিনয় করতেন। সমাজের গঠনমূলক সমালোচনা করতে যে গভীর পর্যবেক্ষণ শক্তি, জ্ঞান, সাহস ও বলিষ্ঠ মানসিকতা দরকার কুতুবুল আলমের সেসব ছিল।
পরিবেশনের অভিনবত্ব, সমাজ-রাষ্ট্রের সংকট চিহ্নিত করে তা সমালোচনার যে ধারা এই গানের মধ্য দিয়ে কুতুবুল আলম অর্জন করেছিলেন তা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তাই তিনি রাষ্ট্রীয় কাজের বিচ্যুতি ও সমাধান নিয়ে এই শিল্পীকে গম্ভীরা পরিবেশনের জন্য বলতেন। সে সময়ের উল্লেখযোগ্য সমস্যাগুলো নিয়ে পরিবেশিত গম্ভীরার আটটি তথ্যচিত্র নির্মিত হয়েছে বলে জানা যায়।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট