ছুটিরঘণ্টা I ছেঁউড়িয়া
সেখানে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন। তাতে জড়িয়ে আছে মরমি স্পন্দন ও তীর্থের পবিত্রতা। লিখেছেন কনক বিশ্বাস
ছেঁউড়িয়া মানেই বাউলসম্রাট লালন সাঁইয়ের তীর্থস্থান। লোকায়ত বাঙালির সাধন সংগীত ও লৌকিক দর্শনের বিকাশ এই অঞ্চলে পূর্ণতা পেয়েছিল। কুষ্টিয়া তথা ব্রিটিশ শাসনের সময়ে নদীয়াই হয়ে উঠেছিল মরমিসাধনার এক উর্বর ক্ষেত্র। সিরাজ সাঁই, লালন সাঁই, বলরামভজা, সাহেবধনী, কর্তাভজা প্রমুখের সংগীতাশ্রয়ী মানবধর্মমতের উদ্ভব ও বিকাশ ক্রমেই এই অঞ্চল ছাড়িয়ে এখন দেশ ও কালের সীমানা অতিক্রম করেছে। এদের মধ্যে লালনের গানই পেয়েছে বিপুল পরিচিতি। ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা এবং অসামান্য প্রতিষ্ঠাও অর্জন করেছে। তিনিই আখড়া তৈরি করেছিলেন ছেঁউড়িয়ায়।
কালীগঙ্গা নদীর তীরে অজপাড়া গ্রাম ছিল ছেঁউড়িয়া। এখন কুষ্টিয়া শহরের কেন্দ্রে। যদিও গ্রামটি কুমারখালী উপজেলার মধ্যে পড়েছে, কিন্তু এখন জেলা শহরসংলগ্ন। নাগরিক জীবনের কোলাহল ও শাহরিক সব আয়োজনে সেই প্রাচীন গ্রাম হারিয়ে গেছে। ১৮৯০ সালে লালন সাঁইয়ের মৃত্যুর আগেই এখানে জঙ্গলবেষ্টিত এলাকায় গড়ে উঠেছিল তার আবাসস্থল। স্থানীয় বা শিষ্যদের ভাষায় ‘আখড়া’। যেখানে বাস করত তার ভক্ত বাউলেরাও। লালন সাঁইয়ের কবর ঘিরেই প্রতিবছর হয়ে আসছে শিষ্যদের সাধন-ভজনের আয়োজন। কবরটি একসময় গ্রামের সাধারণ মানুষের মতোই ছিল। তবে ভক্তরা খড়ের চালার নিচে তা পরিচ্ছন্ন করে রাখত। সেখানেই চলত তাদের সাধুসঙ্গ ও সংগীতের মাধ্যমে অধ্যাত্মচর্চা। এখন সেই সমাধি রূপ পেয়েছে আধুনিক স্থাপনায়। সেখানে সম্প্রতি গড়ে তোলা হয়েছে লালন একাডেমি।
কুষ্টিয়া শহরের যেকোনো জায়গা থেকে অটো বা রিকশায় চলে যাওয়া যায় ছেঁউড়িয়ায়। আখড়ার প্রথমেই দর্শনার্থীদের স্বাগত জানাবে সাদা রঙের কংক্রিটের উঁচু তোরণ। তার মাথায় চারটি মিনার, নিচে জালিকাটা নকশা। অনেকটা ঝালরের মতো। গ্রিলের দরজা পেরিয়ে ভেতরে রাস্তার দুপাশে কাঁটা মেহেদি গাছের সারি, বাড়তি ডালপালা ছেঁটে দেওয়া। নানা রকম ফুলগাছ, পাতাবাহারের ঝাড় আর নারকেলবীথিও রয়েছে চত্বরজুড়ে। প্রকৃতির এমন শোভা যে কাউকে প্রশান্তি দেবে। কিছুটা এগোলেই সামনে লালন সাঁইয়ের সমাধি। প্রবেশ-দরজার বাইরে থেকেও সেটির শুভ্রতা চোখে পড়বে।
সমাধির পুরোটাই সাদা রঙের। কবরটি ঘিরে নির্মিত ঘর তৈরি হয়েছে জালিকাটা নকশায়। বাইরের আলো-বাতাস সেখানে প্রবেশ করতে পারে সহজেই। ঘরের চারপাশে চিকন থামওলা বারান্দা। ছাদের ওপরে চারকোনায় চারটি ছোট মিনার, মাঝখানে বড় একটি গম্বুজ। সেগুলোর চারদিক ঘিরে আছে কংক্রিটের রেলিং। মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর এই সমাধির বাইরে রয়েছে সারি সারি কবর। লালন সাঁইয়ের শিষ্যদের।
সাদা রঙের জন্য চারপাশে বিরাজ করে পবিত্রতার অনুভূতি। সমাধি পেরিয়ে লালন একাডেমির দুটি তিনতলা ভবন। একটিতে জাদুঘর। এখানে লালন সাঁইসহ অনেক বাউলের গানের পা-ুলিপি সংরক্ষিত। রয়েছে লালনের বসবার জলচৌকি, ভক্তদের ঘটিবাটি, বেশ কিছু দুর্লভ ছবি।
সমাধি এলাকার উল্টো দিকে বড় মাঠ। যেখানে উৎসবের সময় মেলা বসে। অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক কর্মকা-। বিশেষত আলোচনা ও বাউলগানের আসর। প্রতিবছর দুবার- লালনের মৃত্যু বা তিরোধান দিবসে, ১৭ অক্টোবর থেকে তিন দিন এবং দোল পূর্ণিমার সময়, ১ থেকে ১৫ মার্চের মধ্যে তিন দিন। চন্দ্রের তিথি গণনা করে সময়টি নির্ধারণ করা হয়। লালন সাঁই দোল পূর্ণিমার রাতে সাধুসঙ্গ করতেন। সেই থেকে তার ভক্ত-অনুরাগীরা সাঁইজির ধামে সমবেত হয়ে উৎসব করে। দেশ-বিদেশ থেকে তখন বাউল ও ভক্তবৃন্দ এখানে এসে জড়ো হন।
মাঠের একদিকে রয়েছে কালীগঙ্গা নদীর অবশিষ্টাংশ। একসময় এটি ছিল বেশ স্রোতোস্বিনী। এখন তার স্মৃতি হিসেবে টিকে আছে বিশাল একটি জলাশয়। বাকিটা মাটি ভরাট করে গড়ে উঠেছে মেলার মাঠ। উৎসবের সময় এখানে বসে লোকশিল্পের দোকান। নানান খাবার, বাউলগানের যন্ত্রানুষঙ্গ থেকে নাগরিক জীবনের বারোয়ারি জিনিসপত্রের দোকানও থাকে। মাঠের বাইরেও আছে লোকশিল্প ও যন্ত্রানুষঙ্গের স্থায়ী দোকান। এখানে পাওয়া যায় লোকসংগীতের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, বাউলের গেরুয়া পোশাক, অলংকার ইত্যাদি।
মাঠের একদিকে থাকে মূল মঞ্চ। যেখানে স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা ও লালন সাঁইয়ের গানের আসর। কিন্তু এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে আখড়ার বাউলদের কোনো সম্পর্ক থাকে না বললেই চলে। সমাধি চত্বর এবং একাডেমি ভবনের নিচে শত শত বাউল সাঁইজি গান করেন। মেতে থাকেন ভজনে, ভাব আলোচনায়। সেখানে ধনী-দরিদ্র, গোত্র-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের কোনো ভেদ থাকে না।
লালন উৎসবের সময় কেবল ছেঁউড়িয়া নয়, জেগে থাকে পুরো শহর।
সাঁইজির সমাধি প্রাঙ্গণে যাওয়ার পথে পড়বে টেগোর লজ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জমিদারি দেখাশোনার কাজে শিলাইদহে এলে প্রথমে উঠতেন কুষ্টিয়া শহরের এই ভবনে। লাল রঙের দ্বিতল ভবনটি কবির স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বন্ধ হয়ে যাওয়া বিখ্যাত মোহিনী মিলের কাছে। কিছু দূরেই, মজমপুরে, কুষ্টিয়া পৌরসভা পেরিয়ে, আছে রেনউইক যজ্ঞেশ^র কোম্পানি। গড়াই নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপে তৈরি হতো সুগার মিলের যন্ত্রাংশ। এখনো তা টিকে আছে। এই শহরেই নির্মিত হয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম রেলস্টেশন- জগতি। চিনিকলকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা স্টেশনটি এখন প্রায় বন্ধই বলা চলে। স্মৃতির বিষাদ নিয়ে জনবিরল এলাকায় দাঁড়িয়ে আছে তার লাল দালান। সারা দিনে একবার হয়তো রেলগাড়ি থামে ঝমঝম শব্দে। আবার কখনো সপ্তাহ ফুরিয়ে গেলেও তার দেখা মেলে না।
অন্যদিকে শহর পেরোলেই দেখে আসা যায় শিলাইদহে রবীন্দ্র-কুঠিবাড়ি। যাওয়ার পথে পড়বে মীর মশাররফ হোসেনের ভিটে, তার নামে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘর। কাঙাল হরিনাথ মিউজিয়াম। যেখানে রয়েছে তার প্রতিষ্ঠিত প্রেস। এখান থেকে প্রকাশিত হতো গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা। এই পত্রিকায় লিখেছেন মীর মোশাররফ হোসেনসহ অনেকেই। কাঙাল হরিনাথ সংগ্রহ করে ছেপেছেন লালনের গান।
কুষ্টিয়া শহরে থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থাও আছে। এখানে ছোট-বড়-মাঝারি মানের আবাসিক হোটেল পাওয়া যাবে। পদ্মা, হোটেল রিভারভিউ, গোল্ড স্টার, সানমুন বেশ মানসম্পন্ন। যেকোনো বেলার খাবারের জন্য জাহাঙ্গীর হোটেল, শিল্পী হোটেল, শফি হোটেল, হোটেল খাওয়া-দাওয়া, মৌবন রেস্টুরেন্টসহ রয়েছে অনেকগুলো চায়নিজ রেস্তোরাঁ। পাশাপাশি ফাস্ট ফুড থেকে দেশি খাবারের আধুনিক রেস্টুরেন্টের সংখ্যাও কম নয়। আছে নানা ধরনের মিষ্টি, কেকজাতীয় খাদ্যের জন্য বিখ্যাত শিশির বেকারি। এখানকার স্ট্রিট ফুডও চেখে দেখা যেতে পারে। সেসবের স্বাদও মন্দ নয়। স্বাস্থ্যসম্মতও। ছেঁউড়িয়াতে আছে তিলেখাজার কারখানা। আর শিলাইদহের কুলফি মালাইয়ের কথা না বললেই নয়। এ দুটি খাবারের স্বাদ এককথায় অনন্য।
শহরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে গড়াই নদী। বিকেল বা সন্ধ্যায় সেখানে নৌকা ভ্রমণ করা যেতে পারে। নদীর বাঁধানো পাড়ে আছে নানান খাবারের দোকান। চা-কফি, আখের শরবত এবং অন্যান্য পানীয়ও পাওয়া যায়। সন্ধ্যায় দুপারে আলো জ্বলে উঠলে তার প্রতিবিম্ব পড়ে নদীর পানিতে। তখন চারপাশ হয়ে ওঠে মোহনীয় ও অপরূপ।
ছেঁউড়িয়া মানে কেবল একটি সমাধিক্ষেত্র নয়, একটি সাংস্কৃতিক অঞ্চল।
ছবি: লেখক