ফিচার I কাঠের নান্দনিক বাড়ি
কেবল স্থানিক সংস্কৃতির চিহ্নবাহী নয়, এটি অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিও বটে। বলা হচ্ছে লোকশিল্পের ঐতিহ্যলালিত বাড়ির কথা। রং আর নকশার বৈচিত্র্যে সেগুলো সমৃদ্ধ
কাঠের বাড়ি বললে প্রথমেই জাপানের কথা মনে আসে। দেশটি ভূমিকম্প, সুনামিসহ অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার আঘাত। ফলে প্রায় নিয়মিত হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে সেখানে স্বল্প ব্যয় ও বিপর্যয়-সহনীয় বিকল্প স্থাপনা তৈরির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশে কাঠের বাড়ি এখানকার চিরায়ত ঐতিহ্যের অংশ। বিশেষত বিক্রমপুরে কালপরম্পরায় গড়ে ওঠা এই শিল্প এ দেশের সংস্কৃতির উজ্জ্বল হয়ে আছে।
নিখুঁত কারুকার্য আর আঞ্চলিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বিক্রমপুরের কাঠের বাড়ির বৈশিষ্ট্য হলেও তা স্থানিকতা অতিক্রম করে হয়ে উঠেছে সর্বজনীন। এমনকি বৈশ্বিক পরিম-লেও তা কিছুমাত্রায় আলোচিত। এগুলো নির্মাণের মূল উপাদান কাঠ ও টিন। তবে এর সঙ্গে মাটি, খড়, বাঁশ ও প্লেইন শিটও ব্যবহৃত হয়। কাঠই মূল উপকরণ এবং সেগুলোই কারিগরের দক্ষতায় শৈল্পিক রূপ পায়।
একটি ঘর তৈরির আগে তা বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হয়। এরপর অংশগুলো প্রতিটি আলাদাভাবে গড়ার পর জোড়া দিয়ে নির্মিত হয় পুরো বাড়ির আদল। ঘরের ভেতর থাকে কেবিন, বারান্দা, সিঁড়ি। এসবের সমন্বয়ে বাড়িটি হয়ে ওঠে বাসোপযোগী। তবে নকশাই কাঠের বাড়ির মূল আকর্ষণ।
জানলা, দরজা, কার্নিশ, বারান্দার রেলিং- প্রতিটি অংশই দারুশিল্পীর সূক্ষ্ম শিল্পকর্মে অনন্য হয়ে ওঠে। এসব নকশায় ফুল, লতাপাতা, পশু-পাখি অথবা কখনো পৌরাণিক কাহিনির নানান চিত্র কাঠ খোদাই করে অঙ্কিত হয়। কখনো তাতে ফুটিয়ে তোলা হয় গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন আচার ও সংস্কৃতি। কার্নিশের কাজে দেখা যায় জালিকাটা ডিজাইন। এমন নকশা জানালা অথবা দরজার ওপরেও আটকে দেওয়ার চল আছে। যেগুলো আসলে সানশেড। জালিকাটা নকশার জন্য তা আলো-বাতাস প্রবেশে সহায়ক। অর্থাৎ বাড়িগুলো কেবল প্রাকৃতিক উপাদানেই গড়ে তোলা হয় তা নয়, নির্মাণশৈলীতেও লক্ষ থাকে পরিবেশের সামঞ্জস্য সৃষ্টির বিষয়টি।
বাড়ির মূল ফটক বা দরজার ওপরের অংশটি হয় অনেকটা মন্দিরের চূড়ার মতো। সাধারণত এ অংশটি টিন দিয়ে তৈরি করা হয়। কঠের ব্যবহারও হয়ে থাকে। তবে মূল আকর্ষণ থাকে দৃষ্টিনন্দন নকশা।
ঘরের দেয়াল, জানালা-দরজার পাল্লায় কাঠ খোদাইয়ে করা হয় বিচিত্র কারুকাজ। এসব কাজে প্রাকৃতিক দৃশ্যও রূপময় হতে দেখা গেছে। আবার কোথাও প্রাধান্য পেয়েছে বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের টুকরা টুকরা ঘটনা। কিন্তু এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো, বাংলা অঞ্চলের জনসংস্কৃতির সঙ্গে মিশে থাকা আলপনাচিত্র। ফুল ও লতাপাতার বৈচিত্র্যময় অঙ্কনশৈলী সেসবের প্রাণ। কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা পাল-পার্বণ। সেসব উৎসবকে কেন্দ্র করে বাড়ির উঠানে আঁকা হয় আলপনা। মূলত নারীর হাতেই এই শিল্প দৃশ্যময় হয়ে ওঠে। সেখান থেকেই দারুশিল্পীরা অনুপ্রাণিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।
রঙের বৈচিত্র্যও থাকে এসব বাড়ির নির্মাণকলায়। ঘরের দেয়ালে আয়তক্ষেত্রের খোপ দেখা যায়। পাতলা ও চিকন কাঠের বিট দিয়ে খোপগুলো ছককাটা থাকে। বিটের রং সাধারণত গাঢ় আর আয়তক্ষেত্রের হালকা। সাদা, হলুদ, নীল, খয়েরি, লাল, সবুজ ইত্যাদির ব্যবহার দেখা যায়। জানালা-দরজা ও ঘরের মেঝেতে কাঠের প্রাকৃতিক রং ও টেক্সচার শোভা পায়।
কাঠের বাড়ির কারুকাজের শিল্প-ইতিহাস কীভাবে সূচিত হলো তা সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায় না। তবে নারীর হাতে রূপায়িত আলপনারীতির সঙ্গে পুরুষ কারিগরের শিল্পরুচি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য-জ্ঞান মিশে তা অনন্য রূপ পেয়েছে। এমনকি বিক্রমপুরে কাঠের বাড়ি তৈরির সঠিক ইতিহাসও অজানা। অনেকে মনে করে, জাপানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাধ্যমে এই এলাকায় এটি গড়ে উঠেছে। বিক্রমপুরের একটি বড় অংশের মানুষ জীবিকার জন্য জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থান করে। আগেই বলা হয়েছে, এসব দেশ ভৌগোলিক কারণে ভূমিকম্পপ্রবণ হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের হার কমিয়ে আনতে কংক্রিটের পরিবর্তে কাঠের বাড়ির প্রচলন করে। বিক্রমপুরও উত্তাল পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। ফলে সেখানে প্রায় প্রতিবছরই নদীভাঙনে বিলীন হয় ঘরবাড়ি, জমিজমা। এ কারণে, ঘরগুলোর জোড়া খুলে সহজেই অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যায়। প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাই এই শিল্পের দ্বারস্থ হয়।
এ কথার যৌক্তিতা থাকলেও উল্লেখ করতে হয়, বিক্রমপুরের কাঠের কাজের ইতিহাস আরও প্রাচীন। সেখানকার দারুশিল্পের নির্দশনগুলো সে-কথাই বলে। কেবল বাড়ি নয়, সেখানে দরজা ও জানালার নকশা বহুকাল আগে থেকেই আলোচনা এবং শিল্পপ্রেমীদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল। টিন ও কাঠের গায়ে হাতুড়ি বাটালির সাহায্যে দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্ম ফুটিয়ে তুলেছে সেখানকার কারিগরেরা।
বিক্রমপুরে গড়ে উঠেছে কাঠের বাড়ির হাট। অনেক মানুষ এই পেশায় এখন নিয়োজিত। সদর উপজেলার কাটাখালী, হাতিমারা, টঙ্গিবাড়ী উপজেলার চূড়াইন, বজ্রযোগিনী, পাইকপাড়া, বেতকা, সিরাজদিখানের মালখানগর, লৌহজংয়ের কাঠপট্টি এলাকায় দেখা যায় নকশাখচিত নতুন নতুন বাড়ি সাজিয়ে রাখা হয়েছে বিক্রির উদ্দেশে। দোচালা, তিন চালা, চারচালা, সাত চালা আবার দোতলা, তিনতলা ঘরও সেখানে আছে। নকশাভেদে আড়াই থেকে বিশ লাখ টাকা দাম হয়ে থাকে এসব বাড়ির। একটি ২৩ বন্দর [২৩/১৩ ফুট] ঘরের দাম চার থেকে সাড়ে চার লাখ। একতলা ও দোতলা বাড়ির চাহিদা বেশি। তিনতলাও অনেকে কেনেন। ক্রেতারা ঘর কেনার পর কয়েকটি অংশ আলাদা করে নিয়ে যায়। বাড়িতে ভিটে তৈরি করে সেগুলো জোড়া লাগালেই হয়ে যায় বাসোপযোগী।
বিক্রমপুরের কাঠের কারুকার্যখচিত দরজা পাশ্চাত্যের শিল্পবোদ্ধাদেরও নজর কেড়েছে বলে শোনা যায়। অনেকে তা সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন নিজ দেশে। এখন অবশ্য সেই শিল্পের প্রাচীনতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমকালীন রুচি ও বিষয়-আশয়। তা হয়েছে দিনে দিনে কাঠের বাড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে। তবে শিল্পসংগ্রাহক ও বোদ্ধাদের কাছে এখনো এই অঞ্চলের প্রাচীন কাঠের শিল্পের চাহিদাই বেশি লক্ষ করা গেছে।
লাইফস্টাইল ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট