skip to Main Content

ফিচার I পট-পুতুলের ইতিকথা

গত শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রায় বিলুপ্তি ঘটলেও এখনো বাংলার শিল্পকলায় এর আবেদন অটুট

মোটা কার্পাস কাপড়ের ওপর আঁকা বিশেষ ধরনের ছবিকে বলা হয় পট, যেটি গুটিয়ে রাখা যায়। তবে পরবর্তীকালে কাগজেও তা আঁকা হয়েছে। কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে পাওয়া পটের প্রায় সবই কাগজে অঙ্কিত। যারা পট তৈরি করে তাদের বলে পটুয়া। বাংলা অঞ্চলে চন্দ্রগুপ্ত-চাণক্যের যুগে পাটলিপুত্র নগরে পটুয়ারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পট দেখিয়ে বেড়াতেন। হর্ষবর্ধনের আমলেও পট আঁকা হতো বলে জানা যায়। অনেকেই মনে করেন, ‘পট’ সংস্কৃত পট্টের বদলে অন্য কোনো অনার্য শব্দ থেকেও এসে থাকতে পারে। ফলে পটুয়া বা পটের ইতিহাস বেশ প্রাচীন, অর্থাৎ আর্য-পূর্ব যুগেই তার বিস্তার ঘটেছিল বলে ধরা নেওয়া যায়।
পট দুই ধরনের। জড়ানো আর চৌকো। জড়ানোটি লম্বায় ১৫-২০ হাত পর্যন্ত হতো। চওড়ায় অবশ্য খুব বেশি নয়। দেখতে অনেকটা সরু, লম্বা মাদুরের মতো। এই দীর্ঘ কাপড়ে খোপ খোপ করে আঁকা হতো ছবি। এগুলোর মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা থাকত বলে পর পর কয়েকটি ছবি মিলে তৈরি হয়ে যেত একটি কাহিনি। পটুয়ারা পট গুটিয়ে বগলদাবা করে বাড়ি বাড়ি ঘুরত। দেখানোর সময় সেটি খুলে ছবির সঙ্গে মিলিয়ে চলত গান। ফলে দর্শকের কাছে কাহিনিটি স্পষ্ট হয়ে উঠত। এসব গান লিখতেন পটুয়ারাই। তবে আঁকিয়েই যে সব সময় গান লিখতেন তা নয়, এ কারণে, পটুয়া অনেক সময় ছবির কাহিনির চেয়ে বাড়তি কিছু যোগ করে দিতেন। গানের বিষয়টি জড়ানো পটের সঙ্গেই কেবল চালু ছিল।
অন্যদিকে চৌকো পট ছোট, আয়তক্ষেত্র আকারের। তাতে ছবি থাকত একটাই। এগুলো বেশির ভাগ আঁকা হয়েছে বীরভূম আর কালীঘাটে। চৌকো পটের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো- এসব আঁকা হয়েছে সামাজিক বিষয় নিয়ে।
পট কেন আঁকা হতো? কেবল উপার্জনের উদ্দেশ্যে নয়; ধর্ম বা নীতিশিক্ষা প্রচার ছিল এর কারণ। তাই ধর্মীয় কাহিনি, পৌরাণিক উপাখ্যান- এসবই ছিল পটের বিষয়বস্তু। তবে কেবল বাংলা অঞ্চলেই নয়, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু চীন ভ্রমণে গেলে সেখানেও পটের মতোই বৌদ্ধচিত্রের সন্ধান পান। সেসবের মধ্যে তিনি বাংলার পটের বেশ মিল দেখেছিলেন। এ থেকে বোঝা যায়, ভারত-চীন-তিব্বত নিয়ে এক বিশাল ভূখ- জুড়ে পটশিল্পের বিস্তার হয়েছিল। তবে তা কেবল বৌদ্ধ ও ভারতের হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নয়, এর চল ছিল মুসলমান সমাজেও। জৈনদের মধ্যেও এই শিল্পের চর্চা ছিল বলে জানা যায়।
ইসলাম ধর্মাবলম্বী পটুয়ারা হজরত মুহাম্মদের জীবন, গাজীদের অলৌকিক ক্ষমতা ইত্যাদি নিয়ে পট আঁকত। ধর্ম প্রচারে এসব পটের বেশ ভূমিকা ছিল। এগুলোকে বলা হতো ‘গাজীর পট’। বাংলাদেশের ফরিদপুর, কুমিল্লা, পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর ইত্যাদি অঞ্চলে গাজীর পটের সন্ধান মিলেছে। সনাতন ধর্মাবলম্বী পটুয়ারা আঁকত তাদের দেব-দেবীর ছবি। তাদের তুলিতে অবশ্য দেবতারা হয়ে পড়তেন একেবারে ঘরোয়া। হরপার্বতীর বিয়ে নিয়ে আঁকা পট দেখলে মনে হবে গ্রামীণ কোনো পরিবারের বিবাহ-অনুষ্ঠানের দৃশ্য। শিব ছাদনাতলায় দাঁড়িয়ে, মা মেনকা বরণডালা নিয়ে তৈরি। বরকর্তা হয়ে এসেছেন ব্রহ্মা, নারদ। বিয়ের আসরে ত্রিশূল হয়তো বেমানান, তাই সেটি থাকে নন্দীর হাতে।
আবার কোনো কোনো মুসলমান পটুয়ার পটে হিন্দু দেবদেবীর ছবি দেখা গেছে। এর কারণ, আর্যরা যেমন অনার্যদের কোনো দিন ভালো চোখে দেখেনি, তেমনি দেবতাকে একেবারে ঘরোয়াভাবে আঁকার বিষয়টিও ব্রাহ্মণরা মোটেই পছন্দ করেনি। ফলে পটুয়ারা সমাজে অবহেলিত হতো। জাতপাতের বিষয়টি তো ছিলই। সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে এসব নিম্নশ্রেণির জনগোষ্ঠীর অনেকে বৌদ্ধ এবং পরে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ফলে তাদের জীবনাচরণে উভয় ধর্মের সংস্কৃতির অদ্ভুত একটা মিশেল দেখা গিয়েছিল।
এসব পটে কৃষ্ণলীলা, গৌরাঙ্গলীলা, বেহুলার কাহিনি, কমলে কামিনী, রামায়ণের কাহিনি, রামের দশভুজা বন্দনা ইত্যাদি দেখা গেছে। গাজীর পটে পাওয়া গেছে বাঘের পিঠে চড়ে বসেছেন গাজী সাহেব। বনের বাঘও যে তার বশ মানে- এই বিশ্বাসটিই এতে ফুটে উঠেছে।
গত শতকের ত্রিশ-চল্লিশের দশকে পটশিল্পের যুগ শেষ হয়েছে, তবে এখনো কোথাও কোথাও এটি দেখা যায়। উল্লেখ্য, ব্রতচারী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা গুরুসদয় দত্ত এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন কিছু পট সংগ্রহ করেছিলেন। সেসব কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়াম এবং ঠাকুরপুরে গুরুসদয় সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে।

দুই
পটুয়াদের অনেকেই পরবর্তীকালে পাল-পার্বণে পুতুল গড়ার কাজে যোগ দেন। তবে এর পেছনেও রয়েছে নানান লোকবিশ্বাস। যেমন নদীয়ার কোনো কোনো গ্রামে চৈত্রসংক্রান্তির দিন ‘বাঘ খেলা’ অনুষ্ঠান হতো। প্রথমে কয়েকজন ধান বোনার মতো অভিনয় করে। তারপর একজন বাঘ সেজে ফসল খেতে আসে, আর সবাই তেড়ে গিয়ে পশুটাকে মেরে ফেলে। ফসলভরা খেতে জীবজন্তুর উপদ্রব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই অনুষ্ঠান হতো। এ কারণে প্রয়োজন হয়েছিল পুতুল গড়ার।
অবশ্য, পুতুলের মধ্য দিয়ে যে কেবল শত্রু মেরে ফেলার ইচ্ছাই পূরণ হতো তা নয়, সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকার আকাক্সক্ষার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশে দশপুতুল ব্রত নামে একটি ব্রত ছিল। তাতে রাম, সীতা ইত্যাদি পৌরাণিক চরিত্রগুলোর দশটি পুতুল বানানো হতো। মেয়েরা এসব পুতুলে এক-একটি ফুল ছুঁইয়ে মনের ইচ্ছা জানাত- রামের মতো স্বামী পাব, সীতার মতো সতী হব ইত্যাদি।
আদ্যিকালে মানুষের জাদুবিশ্বাসের সঙ্গেও পুতুলের সম্পর্ক রয়েছে। তার একটি হলো টোটেম। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর টোটেম পূজা একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান। এ উপলক্ষে মূর্তি বা পুতুল গড়ার প্রয়োজন হতো। বাংলায় পুতুলের মধ্যে হাতি-ঘোড়ার চল ছিল, তার সঙ্গে টোটেম বিশ্বাসের যোগ আছে বলে মনে করা হয়। মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের একটি গ্রামে রয়েছে ঘোড়া পীরের মাজার। এ ছাড়া আরও কোনো কোনো অঞ্চলে অথবা পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বর্ধমান, বীরভূমের গ্রামে বড় গাছের নিচে অজ¯্র পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়া স্তূপ করে রাখতে দেখা যায়। কোথাও আবার লৌকিক দেবদেবীর প্রতীক হিসেবেও এই দুটি পশুর পুতুল রাখার চল আছে।
ব্যাপারটা যে কত প্রাচীন, তা এই পুতুলের গড়ন দেখলে বোঝা যায়। এগুলোতে অলংকরণ বা সূক্ষ্মতার বালাই নেই। নেহাতই হাতের আঙুলে টিপে বানানো হয়। তবে অঞ্চলভেদে এগুলোর গড়নে পার্থক্য দেখা গেছে।
মাটি পুতুল নির্মাণের প্রধান একটি উপাদান। এ ছাড়া কাঠ, শোলা, কাপড় বা কোনো ধাতু ব্যবহৃত হয়ে থাকে। প্রাচীন মানুষ অমঙ্গলের প্রতীক হিসেবে এসব উপাদানের সঙ্গে দাঁত-নখ ইত্যাদি মিশিয়ে দিত- এমন কথাও ইতিহাসে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে মাটি আর কাঠের পুতুলই প্রধান। তবে মাটির তৈরিগুলোই প্রাচীন। স্থায়িত্বের জন্য সেসব পুড়িয়ে নেওয়া হতো। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকাগুলোতে, যেমন মহাস্থানগড়, ময়নামতি, উয়ারী বটেশ্বর এবং পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার হরিনারায়ণপুর অঞ্চলে খনন করে পোড়ামাটির পুতুল পাওয়া গেছে। এখনো মানিকগঞ্জের ধামরাই, কিশোরগঞ্জ, ফরিদপুর, বরিশালসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় মাটির পুতুল তৈরির কারিগর আছে, যারা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এসব তৈরি করে।
বাংলার মাটির পুতুল বৈশিষ্ট্য বিচারে দুই রকম। প্রতীকধর্মী ও বাস্তবভিত্তিক। প্রত্নবস্তুর মধ্যে পাওয়া পুতুলগুলো প্রায় সবই প্রতীকধর্মী। এ-জাতীয় পুতুলের চেহারা, তা মানুষ বা জীবজন্তু- যা-ই হোক না কেন, তার স্বাভাবিকতা মোটেই অবিকল থাকে না। হাত-পা, চোখ-নাক অস্বাভাবিক হলেও সেগুলো চিনতে অসুবিধা হয় না। এগুলো তৈরিতে কোনো ছাঁচ লাগে না, আঙুলের চাপেই নির্মাণ করা যায়। নাক সামনের দিকে আগানো, চোখ দুটো চাপা, মাথার বদলে গোল মাটির টিপ বসানো, হাত থাকে বটে, তবে পা থাকে না বললেই চলে। সব মিলিয়ে অবয়বে একটা প্রাচীন ভাব ফুটে ওঠে। আবার মায়ের কোলে শিশু- এই ধরনের পুতুলও প্রতীকধর্মী হয় এবং এই টাইপটিই বেশি দেখা যায়।
বাস্তবধর্মী পুতুলের সৃষ্টি অপেক্ষাকৃত পরে। এর সঙ্গে মন্দিরশিল্পের প্রভাব রয়েছে। উপাসনালয় নির্মাণে তা অলংকরণের জন্য বাইরের দেয়ালে পোড়ামাটির ফলক বসিয়ে দেওয়ার চল শুরু হয়। এসব ফলকে ধর্মীয় কাহিনি, পৌরাণিক আখ্যান অথবা সামাজিক জীবনের ছবি স্থান পেয়েছিল। চরিত্রগুলো যতটা সম্ভব বাস্তব বা স্বাভাবিক রূপ দেওয়া হয়েছিল। কান্তজিউ মন্দিরসহ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মন্দিরের দেয়ালে এসবের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। এখনো সেসব টিকে আছে।
বাস্তবধর্মী পুতুল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো বানানো হয়। চৈত্রসংক্রান্তি, বৈশাখী মেলা বা অন্যান্য পার্বণের উৎসবস্থলের চারপাশে এগুলো বিক্রি করতে দেখা যায়। তবে এই পুতুলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ধারা হলো বীরভূমের। সেখানের পুতুলগুলো হয় ফাঁপা। বিশেষ রঙের আড়ম্বর নয়, হাত সরু নলের মতো বাঁকানো। কিছুটা প্রতীক ও বাস্তবধর্মী- এ দুয়ের মিশেলে তৈরি। পুতুলে একটিমাত্র চরিত্র দেখা গেলেও বীরভূমের কোনো কোনোটিতে দু-তিনটি অবয়ব থাকে।

তিন
তবে প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশ এবং প্লাস্টিক সামগ্রীর সাশ্রয়ী ও সহজলভ্যতার কারণে পট-পুতুল হারিয়ে যাচ্ছে। পোড়ামাটির পুতুল স্বল্পমাত্রায় দেখা গেলেও পটশিল্প নেই বললেই চলে। অথচ এ দুটোই এই অঞ্চলের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ।
 মনোজ দেব
ছবি:সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top